একটি ফরজ ইবাদত

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মানবজীবনের সঙ্গে জীবিকা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জীবিকা ব্যতীত জীবিত থাকার বিকল্প কোনো উপায় নেই। তাই প্রত্যেক মানুষই কোনো না কোনোভাবে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কেউ করে বৈধ বা হালাল পদ্ধতিতে আর কেউ করে অবৈধ বা হারাম পদ্ধতিতে। ইসলামে কেবল হালাল পদ্ধতিই গ্রহণযোগ্য। হালাল পদ্ধতিতে জীবিকা নির্বাহের জন্য স্বয়ং আল্লাহপাকই নির্দেশনা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন সালাত সমাপ্ত হয় তখন তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) অনুসন্ধান কর।’ (সূরা জুমাা : ১০)। অন্য আয়াতে আল্লাহপাক আরও স্পষ্ট করে বলেন, ‘হে মানব ম-লী, তোমরা পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তু-সামগ্রী হতে ভক্ষণ কর।’ (সূরা বাকারা : ১৬৮)।

হালাল জীবিকানির্বাহের জন্য হালাল উপার্জন অপরিহার্য। এ ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, ‘হালাল রুজি অন্বেষণ করা ফরজের পরেও একটি ফরজ।’ (বায়হাকী)। সেই সঙ্গে বিশ্বনবী (সা.) হালাল উপার্জন করা বা তাতে নিয়োজিত থাকাকে আল্লাহর রাস্তায় প্রতিষ্ঠিত থাকার সমতুল্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যেমন এ ব্যাপারে হাদিসে এসেছে, ‘একদা রাসুল (সা.) সাহাবিদের নিয়ে মসজিদে বসে ছিলেন। এমন সময় এক যুবক মসজিদের পাশ দিয়ে গেলেন। সাহাবিরা বললেন, এই যুবক যদি আল্লাহর রাস্তায় তথা নামাজ, রোজা ও জিকির ইত্যাদিতে নিয়োজিত থাকত তবে কতই না ভালো হতো। রাসুল (সা.) বললেন, ‘যদি সে নিজ স্ত্রী-সন্তানের ভরণপোষণের প্রয়োজনে উপার্জনের জন্য বেরিয়ে থাকে তবে সে আল্লাহর রাস্তায় আছে। যদি সে বাবা-মাকে খাওয়ানোর জন্য উপার্জনে বেরিয়ে থাকে, তবে সে আল্লাহর রাস্তায় আছে। এমনকি সে যদি নিজের প্রয়োজনে উপার্জনের জন্য বেরিয়ে থাকে তবে সে আল্লাহর রাস্তায় আছে।’ (তাবারানি)।

শুধু তাই নয়, হালাল পথে উপার্জনকৃত ধন-সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে যদি কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে তবে সে শহীদের মর্যাদা লাভ করবে। এ ব্যাপারে নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজ ধনসম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হন সে শহীদ।’ (আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ)। সর্বোপরি হালাল উপার্জন করত হালাল খাদ্য ভক্ষণকারীর জন্য জান্নাতের সুসংবাদ রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হালাল খাবার খেয়েছে, সুন্নাহ মোতাবেক আমল করেছে ও মানুষকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে, সে জান্নাতে যাবে।’ (তিরমিজি)।

আমাদের দেশে সাধারণত কৃষি বা কৃষিজাতীয় কর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য, শ্রমকর্ম ও চাকরি ইত্যাদিকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এসব কর্মই ইবাদত হিসেবে পরিগণিত হবে যদি সেগুলো কুরআন-হাদিসের বিধান মোতাবেক করা হয়।

কৃষি কাজের সঙ্গে হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে বিশ্বনবী (সা.) পর্যন্ত প্রায় সব নবী-রাসুলই জড়িত ছিলেন। নিয়মিত কৃষিজমি আবাদকরণের গুরুত্ব দিতে গিয়ে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ভূমি আবাদ কর। কেউ যদি নিজে আবাদ করতে না পারে, সে যেন ভূমিটি অন্য ভাইকে দিয়ে দেয়, যাতে সে আবাদ করে ভোগ করতে পারে।’ (মুসলিম)। নবী (সা.) আরও বলেছেন, ‘যদি কোনো মুসলমান গাছ লাগায় কিংবা জমি চাষ করে, অতঃপর কোনো পাখি বা মানুষ কিংবা কোনো চতুষ্পদ জন্তু তা থেকে ভক্ষণ করে, তাহলে তা তার জন্য সদকা হিসেবে বিবেচ্য হবে।’ (সহিহ বুখারি)। সুতরাং কৃষিকাজ কুরআন-হাদিস নির্দেশিত সওয়াবের কাজ।

উপার্জনের ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্য অন্যতম মাধ্যম। ব্যবসার ব্যাপারে আল্লাহপাক বলেন, ‘তিনি ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।’ (সূরা বাকারা : ২৭৫)।

ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যদি ব্যবসায়ীরা ওজনে কম না দেয়, পণ্যে ভেজাল না মেশায় ও কোনো ধরনের ছল-চাতুরীর আশ্রয় না নেয় তবে ওই ব্যবসাও ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে। এ ধরনের ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সৎ ও ন্যায়পরায়ণ ব্যবসায়ী পরকালে নবী, সিদ্দিকীন ও আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের সঙ্গী হবে।’ (তিরমিজি)।

সবকর্মেই শ্রম দিতে হয় কিন্তু যারা মাঠের শ্রমিক তারা সরাসরি গায়ে খেটে দু’হাতে উত্তম খাদ্য উপার্জন করে থাকে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দু-হাতের উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কেউ কোনো দিন খায়নি।’ (বুখারি)। হাদিসে শ্রমিকদের সরাসরি আল্লাহর শ্রমিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নবী (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমিক বা কর্মচারীদের তাদের কাজের লভ্যাংশ দিয়ে দাও। কেননা আল্লাহর শ্রমিকদের বঞ্চিত করা যায় না।’ (মুসনাদে আহমদ)। সুতরাং এ ধরনের শ্রমকর্মী যেমন- রিকশা-ভ্যানচালক, কিষান বা দিনমজুর, কুলি, পোশাক কর্মী বা এ রকম শ্রমজীবী  যদি সত্য ও ন্যায় তথা ইসলামের পথে থাকে তবে তাদের এ শ্রমও ইবাদত।

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়ই জাহান্নামি।’ (তাবারানি)। সুতরাং ঘুষের লেনদেন ও যে কোনো দুর্নীতি না করে তথা অর্পিত দায়িত্ব ন্যায়ের সঙ্গে পালনকরত (বৈধ প্রতিষ্ঠানে) যদি কেউ চাকরি করে তবে সেটিও ইবাদত। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই এক একজন দায়িত্বশীল। তোমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (বুখারি)। অর্থাৎ আল্লাহপাকের ফরজ হুকুমগুলো আদায়করত যে কোনো হালাল মাধ্যমে উপার্জেয় বস্তু হালাল হওয়া সাপেক্ষে উপার্জন করা একটি ইবাদত।

সুতরাং হালাল উপার্জনের জন্য অনেক পথ ও পাথেয় খোলা রয়েছে। তাই সবসময় হালাল উপার্জনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। যদি কখনও সহজে তা না পাওয়া যায় তবে হারাম পথে পা না বাড়িয়ে প্রয়োজনে অপেক্ষা করতে হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং হালাল জীবিকা অন্বেষণে সর্বাত্মক চেষ্টা কর। ইহা পেতে দেরি হলে আল্লাহর অবাধ্য হইও না।’ (বায়হাকি)।

এরপরও যদি কোনো মুসলমান হারাম উপার্জনের দিকে পা বাড়ায় এবং হারাম উপার্জন দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে তবে তার দান-সদকা, দোয়া, নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত ইত্যাদি আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। তার যে দোয়া কবুল হবে না এ ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, ‘কেউ যদি হারাম খাদ্যের এক গ্রাসও মুখে নেয়, টানা চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার দোয়া কবুল হবে না।’ (মুসলিম)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘বহু লোক দীর্ঘ সফর শেষে অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে দু-হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকে, হে আমার রব! কিন্তু যেহেতু সে ব্যক্তির পানাহার সামগ্রী হারাম উপার্জনের, পরিধেয় পোশাক হারাম অর্থে সংগৃহীত, এ অবস্থায় কী করে তার দোয়া কবুল হতে পারে?’ (মুসলিম ও তিরমিজি)।

তার দান-সদকা কবুল না হওয়ার ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হারাম সম্পদ উপার্জন করে, যদি সে সদকা করে তা কবুল হবে না। আর যদি ব্যয় করে তবে তাতেও কোনো বরকত হবে না। আর যদি রেখে মৃত্যুবরণ করে তবে তা জাহান্নামে যাওয়ার পাথেয় হবে। আল্লাহ তায়ালা মন্দ দ্বারা মন্দকে মিটিয়ে দেন না, ভালো কাজ দ্বারা মন্দকে মিটিয়ে দেন, নিঃসন্দেহে নাপাকিকে নাপাকি দূরীভূত করতে পারে না।’ (মুসনাদে আহমদ)।

হারাম ভক্ষণ তো দূরের কথা কোনো ব্যক্তির পরনের কাপড়বাবদ ব্যয়কৃত অর্থের কিছু অংশ হারাম হলে তার নামাজ কবুল হবে না। এ ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দশ দিরহাম দিয়ে কোনো কাপড় কিনল এবং তার মধ্যে এক দিরহাম অসৎ উপায়ে অর্জিত, সে যতদিন ওই কাপড় পরিহিত থাকবে ততদিন তার নামাজ কবুল হবে না। ‘(মুসনাদে আহমদ)।

রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হারাম অর্থ ব্যয় করে হজে গিয়ে বলে ‘লাব্বাইক’ (হে আল্লাহ! আমি হাজির), তাকে একজন ফেরেশতা বলে, তোমার লাব্বাইক গ্রহণযোগ্য নয়। তোমার হজ তোমার মুখের ওপরই ছুড়ে দেওয়া হলো।’ (তাবারানি)।

মোটকথা, হারাম উপার্জনে জীবিকা নির্বাহকারীর কোনো ইবাদতই কবুল হবে না। বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, ‘হারাম উপার্জনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করলে তার ইবাদত কবুল হয় না।’ (বায়হাকি)। শুধু তাই নয়, যদি হারাম গ্রহণের আগে বা কখনও কোনো আমল গ্রহণযোগ্য হয়েও থাকে তবে হারামের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে  কেয়ামতের দিন তা নষ্ট হয়ে যাবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন কিছু লোক পাহাড় সমান সৎ কর্ম নিয়ে উপস্থিত হবে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা সঙ্গে সঙ্গেই তাকে ধূলিকণার মতো উড়িয়ে দেবেন। রাসূল (সা.)কে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল, এটা কীভাবে সম্ভবপর হবে? রাসুল (সা.) বললেন, ‘এই লোকগুলো নামাজ পড়ত, রোজা রাখত, জাকাত দিত ও হজ করত। কিন্তু যখনই কোনো হারামের সংস্পর্শে আসত, অমনি তাতে লিপ্ত হয়ে যেত। তাই আল্লাহ তাদের সব নেক আমল বাতিল করে দিয়েছেন।’ (তাবারানি)।

পরিশেষে এমন জীবিকা নির্বাহীদের জন্য পরকালীন আবাসস্থল হবে জাহান্নাম। যেমন রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হারাম খাদ্যে পরিপুষ্ট যে দেহ, নরকাগ্নিই তার জন্য উপযুক্ত স্থান।’ (আহমাদ, দারিমী, বায়হাকি)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ কোথা থেকে অর্জন করে, সেই ব্যাপারে পরোয়া করে না; আল্লাহ তায়ালা তাকে কোন দরজা দিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন, তা নিয়ে তিনিও পরোয়া করেন না।’ (মুসনাদে আহমদ)।

দুনিয়ার জীবনে যা কিছুই করি না কেন পরকালে সবাইকে সব বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে। বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত আদম সন্তান এক কদমও নড়তে পারবে না। ওই পাঁচটি প্রশ্নের মধ্যে অন্যতম দুটি হলো, কোনো পথে সম্পদ উপার্জন করেছে এবং কোন পথে তা ব্যয় করেছে। ‘(তিরমিজি)। সুতরাং যে কোনো মুসলমানকে হালাল ও হারাম দুটি পথের মধ্যে প্রশ্নাতীতভাবে হালালটিকেই বেছে নিতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর