বাইতুল্লাহর হাজীদের বিদায়ী অভিনন্দন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাইতুল্লাহর হজ আদায়কারীদের জন্য অভিনন্দন, আল্লাহ আপনাদের হেদায়েত দান করেছেন, আপনাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, আপনাদের সম্মানিত করেছেন। তিনি আপনাদের জন্য হজ আদায় সহজ করে দিয়েছেন, যেখানে অন্যান্য অনেক মানুষ তা আদায়ে সমর্থ হয়নি। আপনাদের অভিনন্দন, আপনারা ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হজের নির্ধারিত বিধানগুলো আদায়ের তৌফিক লাভ করেছেন। আপনারা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়েছেন। সুন্দরভাবে সব সম্পন্ন করেছেন। আপনাদের অভিনন্দন, আপনাদের মর্যাদা উন্নীত করা হয়েছে, গোনাহ ক্ষমা করা হয়েছে, পাপ হ্রাস করা হয়েছে, দোষত্রুটি ঢেকে দেওয়া হয়েছে।

আপনাদের জন্য অভিনন্দন, আপনারা অর্থ খরচ করেছেন, সময় ব্যয় করেছেন, শ্রম ও শক্তি নিয়োগ করেছেন। ক্লান্তি ও কষ্টের কঠিন পরিস্থিতিতে প্রবেশ করেছেন। প্রিয় ও মূল্যবান জিনিস দান করেছেন। মহান মহিমাময় আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশ ও পরিবার-পরিজন ছেড়ে এসেছেন। আপনারা সর্বোত্তম স্থানে সর্বোত্তম সময়ে এসে সমবেত হয়েছেন। আপনাদের সাজসজ্জা ও নিত্য পোশাক থেকে মুক্ত থেকেছেন। লাব্বাইক বলে বলে জীর্ণ বেশে, বিনম্র ভঙ্গিতে, প্রশান্ত চিত্তে, নত হয়ে আল্লাহর দিকে অগ্রসর হয়েছেন। আন্তরিক হয়ে একমাত্র আল্লাহর কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। সুতরাং, আপনারা সুসংবাদ গ্রহণ করুন, কারণ আল্লাহ সবেচেয়ে বড় দয়ালু, সবচেয়ে বেশি করুণাময়।

‘আরাফার দিনেই আল্লাহ সবচেয়ে বেশি বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করেন। আল্লাহ নিকটবর্তী হয়ে আরাফায় অবস্থানকারীদের নিয়ে ফেরেশতাদের সামনে গর্ব করে বলেন, এরা আমার বান্দা, দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে জীর্ণ বেশে ধূলি ধূসরিত হয়ে তারা আমার কাছে এসেছে। তারা আমার শাস্তিকে ভয় করে, আমার রহমতের প্রত্যাশা করে। তারা যদি আমাকে দেখত তাহলে কেমন অবস্থা হতো? সুতরাং তোমাদের গোনাহ যদি বালুকারাশি ও সাগরের ফেনার পরিমাণও হয় আমি তা ক্ষমা করে দিলাম। হে আমার বান্দারা, তোমরা অবস্থান করে দ্রুত ধাবিত হও, তোমাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা।’ (ইবনে হিব্বান)।

হাজীরা এখনকার দিনগুলোতে পবিত্র বাইতুল্লাহকে বিদায় জানিয়ে যাচ্ছে আর তাদের দেখে মনে হচ্ছে যেন তারা বলছে, আমরা রবের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে করতে তওবা করে ফিরে আসছি। আনন্দ তাদের নিজ নিজ দেশ ও মাতৃভূমির দিকে টেনে নিচ্ছে। তারা তাদের হজের নির্ধারিত বিধানগুলো পালন করেছে। তারা তাদের ভারী দায়িত্বের বোঝা হালকা করেছে। ‘বলুন, আল্লাহর অনুগ্রহে ও দয়ায় এটা হয়েছে? তারা যেন তাই নিয়ে আনন্দিত হয়। তারা যা সঞ্চয় করে তার চেয়ে এটা বেশি উত্তম।’ (সূরা ইউনুস : ৫৮)।

তারা যেন নিজ নিজ দেশে ওই দিনটির মতো ফিরে যাচ্ছে যেদিন তাদের মায়েরা তাদেরকে জন্ম দিয়েছিল। কেননা তারা এমন একটি গনিমত বা সম্পদ নিয়ে ফিরছে যা আল্লাহর প্রশংসা করা ও শোকর আদায় করাকে অবধারিত করে দেয়। গোনাহ ক্ষমা করা হয়েছে, দোষ ঢেকে রাখা হয়েছে, পাপ মোচন করা হয়েছে। তাই সব প্রশংসা আল্লাহর। তাঁর বড়ত্ব ও মহত্ত্ব সীমাহীন। তিনি আমাদের হেদায়েত না করলে আমাদের হেদায়েত লাভের কোনো পথ ছিল না। প্রত্যেক আগমনের প্রস্থান রয়েছে। প্রত্যেক সমাবেশের রয়েছে বিচ্ছেদের বার্তা। আমরা দেখেছি, দূর-দূরান্তের প্রতিটি পথ ও দেশ অতিক্রম করে হাজীরা এখানে আসেন তাদের কল্যাণকর স্থানগুলো প্রত্যক্ষ করতে।

হজের পবিত্র স্থানগুলোতে বিশাল বিশাল দল ও বাহিনী সমবেত হয়। তাদের ভাষা, বর্ণ, দেশ, জাতিয়তা ও বয়স ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু ইসলাম তাদের সবাইকে একত্র করে দিয়েছে, তাদের কেবলা এক করেছে। তাদের ইবাদতের নির্ধারিত বিধান অভিন্ন করেছে। তারা একটি ভূমিতে সমবেত হয়েছেন। আল্লাহ তাদের হৃদয়গুলোকে এক করে দিয়েছেন। ‘যদি আপনি দুনিয়ার সবকিছুও খরচ করতেন তবুও তাদের হৃদয়গুলোকে এক করতে পারতেন না; কিন্তু আল্লাহ তাদের মাঝে একতা সৃষ্টি করে দিয়েছেন।’ (সূরা আনফাল : ৬৩)।

হজের বিধানগুলো আদায়ের পরে এ বিশাল সংখ্যার হাজিরা এখন পবিত্র স্থানগুলোকে বিদায় জানাচ্ছেন মুখরিত ভরপুর হৃদয় নিয়ে। আর তাদের অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তারা যেন বলছে, ‘হে কাবা, হৃদয়ে তোমার জন্য রয়েছে বিশেষ আসন।’

বিশাল সমাবেশের এ বিদায়ের দৃশ্যটি অনেক বড় একটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করছে, অল্প সময়ের এ সমাবেশ দুনিয়া থেকে বিদায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। এখানে এক প্রজন্মের পর আরেক প্রজন্মের আসা-যাওয়া। জন্ম নেওয়ার পরে একটি প্রজন্মকে স্বাগত জানানো হচ্ছে আর অন্য এক প্রজন্মকে শোক প্রকাশ করে বিদায় দেওয়া হচ্ছে। দুনিয়ার সবকিছুই ধ্বংস হবে। থাকবে শুধু আপনার রবের মহামহিম মহিয়ান অস্তিত্ব। যে উপদেশ গ্রহণ করে তার জন্য হজের মাঝে আছে বড় শিক্ষা।

অন্তরে ইবাদতের প্রভাব ও ফল দেখা যায়। নামাজ অশ্লীলতা ও অন্যায় থেকে বিরত রাখে। হজ তাকওয়া অর্জনের উর্বর উৎস। ‘তোমরা পাথেয় সংগ্রহ করো, সর্বোত্তম পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া।’ (সূরা বাকারা : ১৯৭)। ইবাদত যদি আল্লাহর কাছাকাছি নিয়ে না আসে এবং হারাম কাজ থেকে দূরে না সরায় তাহলে বুঝতে হবে সেখানে দ্বীনের লঙ্ঘন ও বিরোধিতা রয়েছে। তাকওয়া অবলম্বনকারীদের আমলই কবুল করা হয়।

হে হাজী মহোদয়, আপনার দায়িত্বে যে ফরজ রয়েছে তা পালন করুন। পৃথিবীতে কোনো প্রতিপক্ষ থাকলে তাকে সন্তুষ্ট করুন। কোনো হক থাকলে তা আদায় করুন। আল্লাহর ফরজ বিধানগুলো প্রতিষ্ঠিত করুন। এক্ষেত্রে সর্বাত্মক সাধনা করুন। আল্লাহর রাসুলের সুন্নাহ আঁকড়ে ধরুন। এক্ষেত্রে অঙ্গীকারবদ্ধ হোন। মুক্তি ও নাজাত সন্ধান করুন। নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা ও দৃঢ়তার সঙ্গে আল্লাহর সঙ্গে প্রতিশ্রুতি নবায়ন করুন।

আল্লাহ সবকিছুর সাক্ষী। যে কোনো কথা উচ্চারিত হলে তার জন্য অতন্দ্র প্রহরী রয়েছে। আপনাদের কণ্ঠ সাক্ষীদের সামনে সরব হয়েছে। আপনারা তৌহিদের বাণী বারবার উচ্চারণ করছিলেন। মক্কার পাহাড়গুলো ঈদের দিন পর্যন্ত আপনাদের তালবিয়া পাঠের প্রতিধ্বনি দিয়েছে। ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাকা।’

তাই শিরক থেকে মুক্ত থাকুন, শিরক থেকে দূরে থাকুন। আল্লাহ এমন কোনো আমল কবুল করেন না যাতে তিল পরিমাণ শিরক থাকে। আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি শরিকদের শিরক থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। যে ব্যক্তি এমন আমল করে যাতে আমার সঙ্গে অন্যকে শরিক করে, আমি তার আমল ও তার শিরককে পরিত্যাগ করি।’ (মুসলিম)। আপনারা আল্লাহর ইবাদত করুন। তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুই শরিক করবেন না। আপনাদের শরিয়তকে আঁকড়ে ধরুন। আপনাদের দ্বীনের ওপর যতশীল হোন। আপনাদের রব এক। আপনাদের পিতা এক।

সাবধান, তাকওয়া অবলম্বন ছাড়া কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কিংবা শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই? আল্লাহ আপনাদের রক্ত, সম্পদ ও মর্যাদাকে এমনভাবে সুরক্ষিত ও পবিত্র করে দিয়েছেন যেমনভাবে পবিত্র এ শহরে জিলহজ মাসের কোরবানির এ দিনটিকে পবিত্র করেছেন। সাবধান, আপনারা এমন কাফের অবস্থায় ফিরে যাবেন না, যেখানে পরস্পর একজন আরেকজনের প্রাণ কেড়ে নেয়। হে হজ আদায়কারীরা, এটাই আপনাদের রবের শরিয়ত, আপনাদের নবীর উপদেশ, তাই তা আঁকড়ে ধরুন। আপনাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে তা আপনাদের জন্য কল্যাণকর।

ইবাদত কবুলের আলামত হচ্ছে ইবাদতের ওপর অবিচল থাকা, অটল থাকা, স্থায়ী থাকা। ইবাদতে অবহেলা ও ত্রুটি হলে মনকে জবাবদিহি করা। সততা, বিশ্বস্ততা ও অবিচলতাই দ্বীনের ওপর টিকে থাকার ও আত্মসমর্পণের প্রকৃত তাৎপর্য। সুফিয়ান ইবনে আবদুল্লাহ ছাকাফি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম হে আল্লাহর রাসুল, আমাকে ইসলামের এমন একটি কথা বলুন যার সম্পর্কে আমি আপনার পরে আর কাউকে জিজ্ঞেস করব না। তিনি বললেন, ‘বল, আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি তারপর অবিচল থাক।’

১৩ জিলহজ ১৪৩৯ হিজরি মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর করেছেন মাহমুদুল হাসান জুনাইদ

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর