হাওর বার্তা ডেস্কঃ রক্তে হেপাটাইটিসের ভাইরাস বহন করছে দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ। পেশা বিবেচনায় এ ভাইরাস বহনকারীর হার সবচেয়ে বেশি কৃষকদের মধ্যে। ৮ দশমিক ৯ শতাংশ কৃষকই রক্তে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস বহন করছেন। ব্যবসায়ীদের মধ্যেও এ হার একেবারে কম নয়, ৭ দশমিক ৬ শতাংশ।
বাংলাদেশে হেপাটাইটিস-বি ও সি ভাইরাসের ব্যাপকতা এবং এর ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে দুই বছর ধরে একটি গবেষণা চালিয়েছেন বিএসএমএমইউ, আইসিডিডিআর, বি, বারডেম ও ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার কলেজ অব মেডিসিনের সাত গবেষক। গবেষণার প্রয়োজনে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকাসহ চারটি জেলা শহর ও চারটি উপজেলার ২ হাজার ৭১৩ জনের তথ্য সংগ্রহ করেন তারা। এসব তথ্য তারা সংগ্রহ করেন বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের কাছ থেকে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও স্ক্রিনিং টেস্টের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীদের হেপাটাইটিস-বি ও সি নির্ণয় করেন গবেষকরা। ফলাফলে দেখা যায়, দেশের ৫ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত। হেপাটাইটিস-সিতে আক্রান্তের হার অনেক কম, দশমিক ২ শতাংশ। শহর-গ্রাম, বয়স-লিঙ্গ এমনকি পেশাভেদেও আক্রান্তের হারে তফাত রয়েছে। পেশার বিবেচনায় হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত কৃষকরা।
স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার অভাবকে এর বড় কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, টিকা গ্রহণের বিষয়ে কৃষক পরিবারগুলোর মধ্যে অনীহা রয়েছে। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেও অনেক সময় তারা আশ্রয় নেন হাতুড়ে চিকিৎসকের।
বিএসএমএমইউর লিভার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস সংক্রমণের অন্যতম কারণ জন্মের সময় মায়ের কাছ থেকে শিশুর মধ্যে তা ছড়ানো। ধারণা করা হচ্ছে, কৃষকরা কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা স্ক্রিনিংয়ের আওতায় না আসার কারণে তাদের মধ্যে এ হার বেশি। আরো গবেষণা করা হলে এর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
হেপাটাইটিস-বি অথবা সি ভাইরাস নীরব ঘাতক। শরীরে এ ধরনের ভাইরাস থাকলেও অনেক সময় এর লক্ষণ প্রকাশ পায় না। এ কারণে অনেকেই এ ধরনের ভাইরাস সম্পর্কে জ্ঞাত নয়। ধীরে ধীরে এটি কাজ করে। একপর্যায়ে তা লিভার ক্যান্সার ও লিভার সিরোসিসে রূপ নেয়। সাধারণত ব্লাড ট্রান্সফিউশন, ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ ও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এ ভাইরাস ছড়াতে পারে। তবে বাংলাদেশে প্রায় ৯০ শতাংশ হেপাটাইটিস মায়ের কাছ থেকে ছড়ায়।
হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের কারণে লিভার ক্যান্সারে ভুগছে দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ।
চিকিৎসকরা বলছেন, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় শিশুর জন্মের এক মাসের মধ্যে হেপাটাইটিসের টিকা দেয়ায় আগের তুলনায় বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্তের হার কমেছে। তবে আক্রান্ত মায়ের সন্তানরা এখনো ঝুঁকিতে আছে। কারণ হেপাটাইটিসে আক্রান্ত মায়ের সন্তান জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টিকা না পেলে বি ভাইরাসে আক্রান্তের ঝুঁকি থেকে যায়।
বিএসএমএমইউর লিভার বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুদ্দীন আহমেদ বলেন, লিভার ক্যান্সার ও লিভার সিরোসিসের মতো ক্রনিক লিভার রোগের জন্য দায়ী হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস। মায়ের কাছ থেকেই মূলত সন্তান এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। গর্ভবতী মায়েদের বি ভাইরাস চিহ্নিত করে তাদের চিকিৎসা করালে সন্তানের আক্রান্তের ঝুঁকি কমে। এছাড়া বি ভাইরাসে আক্রান্ত মায়ের শিশুদের জন্মের ১২ ঘণ্টার মধ্যে ইমিউনোগ্লোবিন টিকা দিতে হবে; যাতে ওই নবজাতক পরবর্তী সময়ে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত না হয়।
গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্তের হার নারীদের তুলনায় পুরুষের মধ্যে বেশি। দেশের ৫৭ লাখ পুরুষ হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও নারীর সংখ্যা ২৮ লাখ। নারীদের মধ্যে ১৮ লাখ সন্তানদানে সক্ষম (১৫ থেকে ৪৫ বছর)। এছাড়া দেশের প্রতি ৫০০ জনের একজন সি ভাইরাসে আক্রান্ত।
হেপাটাইটিস-বি ও সি ভাইরাস প্রতিরোধে সব সরকারি হাসপাতালে সবার জন্য বিনামূল্যে এর পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া হেপাটাইটিস-সিতে আক্রান্তদের চিকিৎসায় ব্যবহূত ওষুধকে জীবনরক্ষাকারী ঘোষণা দিয়ে এর কাঁচামালের ওপর শুল্ক ও ভ্যাট কমানোর কথা বলছেন।
হেপাটাইটিস নির্মূলে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক সানিয়া তাহমিনা। তিনি বলেন, সরকারের এসডিজির একটি লক্ষ্য হলো হেপাটাইটিস নির্মূল করা। সে লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। ২০১৭ সালে হেপাটাইটিস নিয়ে নতুন একটা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে চিকিৎসক, নার্স থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িতরা স্ক্রিনিং করেন। কারো হেপাটাইটিস পজিটিভ হলে তাদের টিকা বা ওষুধ দেয়ার কাজ করেন তারা। সরকারি পর্যায়ে বিনামূল্যে কোনো স্ক্রিনিংয়ের সুযোগ না থাকলে অত্যন্ত স্বল্পমূল্যে স্ক্রিনিং করা হচ্ছে। ব্যয়বহুল হলেও হেপাটাইটিস-সি ভাইরাসের চিকিৎসাও বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে।