মুশফিক ও শেষ ওভারের দুঃখ গাঁথা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ‘অপরাধী’-শিরোনামে একটা গান সম্প্রতি বেশ চলেছিল। কোন এক ম্যাচের শেষে ড্রেসিংরুমে সাকিবরাও তাতে সুর মিলিয়েছিলেন। মনে হচ্ছিল ক্রিকেটারদেরও বেশ পছন্দই হয়েছে প্রেম-অভিযোগ এবং অভিমানের বৃত্তে তৈরি সুর, ছন্দ ও পরিচিত সব শব্দমালা নিয়ে তৈরি এই গানের গাঁথুনি!

বড় কোন জয়ের পর ড্রেসিংরুমে আমাদের ক্রিকেট দল আরেকটা বেশ পরিচিত গান গায়-আমরা করবো জয়… একদিন!’ জয় আনন্দের উপলক্ষে অনেকদিন ধরে গাইছে এই গান বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।

তবে গায়ানায় সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে হারের পর ক্রিকেট গীতিকাররা নতুন গানের একটা প্লট এখন পেয়ে গেছেন। শিরোনামও ঠিকঠাক প্রায়-‘শেষ ওভারের দুঃখগাঁথা, কষ্টের কথা!’ হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, ক্রিকেটীয় এই গানের লিড ভোকালিস্টও একেবারে দুস্তরমতো ঠিক-মুশফিকুর রহিম!

সাম্প্রতিক সময়ে শেষ ওভারে এসে বাংলাদেশ এমনসব কায়দায় ম্যাচ হেরেছে যে সেই ম্যাচগুলো নিয়ে এখন লম্বা দুঃখের সারি গান তৈরি করে ফেলা যায়। নিশ্চিত জয়ের কাছে দাড়ানো ম্যাচ হেরে আসছে বাংলাদেশ! একবার নয় দু’বার নয়। বারবার! একই ভুলের বৃত্তে আটকে যাচ্ছে দল। আর কি আশ্বর্য, প্রতিবারই শেষ ওভারের হারের এই দুঃখগাঁথার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে মুশফিকুর রহিমের নাম!

দু’বছরের ব্যবধানে ব্যাঙ্গালোর থেকে দেরাদুন ঘুরে একই কাহিনী ফের দেখল ক্রিকেট বিশ্ব এবার গায়ানায়।

শুনি সেই ক্রিকেট দুঃখের সারি গান!

২৩ মার্চ, ২০১৬ সাল। ভেন্যু: ব্যাঙ্গালোরের চিন্মাস্বামী স্টেডিয়াম: টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ লড়ছে ভারতের বিপক্ষে। ভারতের গড়া ১৪৬ রানের স্কোর প্রায় ছুঁয়ে ফেলার অপেক্ষায় বাংলাদেশ। শেষ ওভারে বাংলাদেশের জিততে চাই ১১ রান। ৬ বলে ১১ রান। হাতে ৪ উইকেট জমা। ব্যাটিংয়ে মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। হার্দিক পান্ডিয়ার প্রথম বল থেকে মাহমুদউল্লাহ ১ রান নিলেন। দ্বিতীয় বলেই মুশফিকের বাউন্ডারি! পরের বলেই আরেকটি বাউন্ডারি হাঁকালেন ফাইন লেগের মাথার ওপর দিয়ে! বল বাউন্ডারিতে যেতেই মুশফিক শূন্যে ঘুসি হাঁকিয়ে যেন আগাম ঘোষণা দিলেন-ম্যাচ তো আমরা জিতেই গেছি! শেষ তিন বলে জিততে হলে চাই মাত্র ২ রান।

হাতে তখনো অক্ষত ৪ উইকেট। জয় উৎসবের জন্য প্রস্তত বাংলাদেশের ডাগআউট। অথচ এমন ম্যাচও হেরে এল বাংলাদেশ! পরের তিন বলের দুটোতে প্রথমে মুশফিক পরে মাহমুদউল্লাহ ক্যাচ দিয়ে এলেন। মিডউইকেটে প্রায় একই জায়গায়। তাও আবার ফুলটস বলে! শেষ বলটা ব্যাটেই লাগাতে পারলেন না শুভাগত হোম। রানের জন্য মুস্তাফিজ ছুটলেন এবং রান আউট। বাংলাদেশ ম্যাচটা হেরে গেল ১ রানে!

ডাগআউটে হতাশায় দু’হাতে মুখ ঢাকা মুশফিকের ছবিটা তখন মাঠের বিগস্ক্রিনে!

শেষ ওভারে এমন ক্লোজ ম্যাচ হারের পরের ঘটনা আরো সাম্প্রতিক সময়ের।

৭ জুন, ২০১৮ সাল। ভেন্যু দেরাদুনের রাজীব গান্ধী স্টেডিয়াম: আফগানিস্তানের বিপক্ষে টি-টুয়েন্টি সিরিজের শেষ ম্যাচের শেষ ওভার। জিততে হলে বাংলাদেশের চাই ৮ রান। বোলার রশিদ খান। এখানেও মাহমুদউল্লাহ-মুশফিক ব্যাট হাতে উইকেটে । স্ট্রাইকে মুশফিকুর রহিম। ৩৬ বলে ৪৬ রান করা মুশফিক ম্যাচটা শেষ করে দিয়ে আসছেন এই অপেক্ষায় পুরো দল। কিন্তু শেষ ওভারের প্রথম বলেই প্রিয় স্লগ সুইপ খেলেন। বল ব্যাটের কানায় লেগে ডিপ স্কয়ার লেগে ক্যাচ। পরের বলে মাহমুদউল্লাহ ১ রান নিলেন। তৃতীয় বলে আরিফুর হকের ব্যাটে এল আরও ২ রান।

জয়ের আরো কাছে বাংলাদেশ। চতুর্থ বলে আরিফুল ১ রানের বেশি পেলেন না। পঞ্চম বলে মাহমুদউল্লাহও মাত্র ১ রান নিতে পারলেন। শেষ বলে জিততে হলে বাংলাদেশের প্রয়োজন তখন ৪ রান। অন্তত ৩ রান হলেও ম্যাচ টাই হবে। স্ট্রাইকে আরিফুল হাঁকালেন। রশিদ খানের বলটা উড়ে যাচ্ছিল লং অন বাউন্ডারির দিকে। ছক্কাই বুঝি হয়ে গেল! কিন্তু শফিকুল্লাহ বাউন্ডারি সীমানায় পুরো শরীর শূন্যে মেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার ভঙ্গিতে হাত লাগিয়ে বল মাঠের মধ্যেই রাখলেন। বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাড়িয়ে সেই বল কুড়িয়ে ফেরত পাঠালেন উইকেটকিপারের কাছে। তৃতীয় রান নিতে গিয়ে মাহমুদউল্লাহ তখন রান আউট!

বাংলাদেশ ম্যাচটা হেরে গেল ১ রানে! এত কাছে এসেও জেতা হল না, আরেকবার।

মুশফিকের হতাশায় নুয়ে পড়া চেহারাটা এখানেও মিলল।

২৬ জুলাই, ২০১৮ সাল। ভেন্যু: গায়ানার প্রভিন্স স্টেডিয়াম:

ম্যাচের শেষ ওভার। ৬ বলে জিততে চাই ৮ রান। জ্যাসন হোল্ডারের প্রথম বল লো ফুল টস মুশফিকের ব্যাট বরাবর। মুশফিক তুলে মারলেন এবং মিড উইকেটে সহজ ক্যাচ। বিপদের যেন সেই শুরু! নতুন ব্যাটসম্যান মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত পরের দুই বলে কোন রানই নিতে পারলেন না। চতুর্থ বলে কোনমতে ২ রান পেলেন। অপরপ্রান্ত থেকে মাশরাফি এসে সাহস দিলেন মোসাদ্দেককে। কিন্তু পঞ্চম বল মোসাদ্দেক যেভাবে খেললেন তাতে এবার মিলল মাত্র ১ রান। হিসেব পরিস্কার, শেষ বলে জিততে চাই ৫ রান। বাউন্ডারি হলে ম্যাচ টাই হবে। মাশরাফি চেষ্টা করলেন। কিন্তু এল মাত্র ১ রান। বাংলাদেশ এই ম্যাচ হারল ৩ রানে! ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে সমতা আনল।

ডাগআউটে মুশফিক তখনো প্যাড পরেই বসে আসেন। কপাল গড়িয়ে আসা পরিশ্রমী ঘাম মুছছেন আঙ্গুলের ডগায়। নাকি বন্ধ চোখের পাতায় কষ্টের কান্না লুকাচ্ছেন? হতাশ! স্তম্ভিত!! পাথুরে মুর্তি যেন!!! টিভি ক্যামেরায় লেন্সে তার তীব্র কষ্ট-দহনের মুখচ্ছবি।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডে বাংলাদেশের জন্য শেষ ওভারের দুঃখ-কষ্ট, হতাশা ও যন্ত্রণা চিত্রের আরেকটি এফিটাফ যেন!

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর