হাওর বার্তা ডেস্কঃ প্রতিটি মুসলমান তার মাকে যেমন ভালোবাসেন, তেমনি প্রতিটি মুমিন বান্দা মদিনাকেও ভালোবাসেন। মা আর মদিনা এ যেন এক বৃন্তে দুটি ফুল। মক্কা থেকে মদিনায় যাওয়ার পথের যে দৃশ্য তা লিখে বুঝানো সম্ভব নয়। আধুনিকতার মিশেলে তৈরি প্রশস্ত সড়কে গাড়ি যখন চলে, তখন এমনিতেই অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে মনে।
গাড়ি যতই এগিয়ে যায় ততই যেন সৌন্দর্যের ঘোরে ডুবে যাই। সারি সারি পাহাড়মালা, দৃষ্টিনন্দন সব ইমারত, আইল্যান্ডের মাঝে সারিবদ্ধ খেজুর গাছ দেখতে দেখতে একসময় চোখে ধরা দেবে জনমানবহীন ধুধু মরুভূমি আর বিরাট আকৃতির নানা রঙের পাহাড়।
তপ্ত মরুভূমির বুকে মাথা উঁচু করে থাকা বাবলা গাছগুলো দেখে মনে হবে, এ যেন বিশাল শূন্যতার মাঝে একখণ্ড সবুজ। কোথাও কোনো মানুষের দেখা না পেলেও মরুভূমির জাহাজ নামে খ্যাত শতশত উট আর দুম্বার বিচরণ দেখা যাবে। সেসব দৃশ্যও ভ্রমণপিপাসুদের কাছে অন্যরকম ভালোলাগার স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে থাকবে।
মক্কা থেকে মদিনায় বাসে যাত্রার সময় প্রায় ৬ ঘণ্টা। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়টা যেন খুব দ্রুতই ফুরিয়ে যাবে। আমাদেরও ফুরাল। বাস এসে থামল মদিনা শহরের বাঙালি পট্টির বাংলাদেশ হজ মিশনের পাশে।
এখানকারই এক আবাসিক হেটেলে আমাদের থাকার জায়গা ঠিক রাখা ছিল। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়েই সোজা আমি ও রুমমেট মন্টু কাকা এবং সৌদি অবস্থানকালীন আমাকে আপন চাচির মতো স্নেহ করা বেগম সামসুন্নাহারসহ চলে যাই দূরে মসজিদে নববীতে। নববীর প্রথম দর্শনেই চোখ জুড়িয়ে যায়।
এখানে পুরুষ-মহিলাদের জন্য নামাজের স্থান পৃথক রাখা হয়েছে। চাচিকে মহিলাদের জায়গায় রেখে আমরা দু’জন চলে যাই বাবে জিব্রিল গেটের দিকে। এ গেট দিয়েই রাসূল (সা.)-এর কাছে জিব্রিল (আ.) ওহি নিয়ে প্রবেশ করতেন। ভাবতেই অন্যরকম লাগে। আমি এখন সেখানেই দাঁড়িয়ে। আজান পড়ে। মাগরিবের নামাজ আদায় করি।
দুনিয়ার বুকে যতগুলো মসজিদ রয়েছে গুরুত্বের দিক থেকে মসজিদে নববীর স্থান তৃতীয়। আর বরকতের দিক থেকে মসজিদুল হারামের পরই মসজিদে নববীর স্থান। এ রকম একটা মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারাটা ভ্রমণ জিন্দেগিতে এক অবিস্মরণীয় ব্যাপার। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) মসজিদে নববীকে ‘আমার মসজিদ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হুজুর (সা.) বলেছেন, নববীর পরিধি যদি সাফা পর্যন্তও হয় তবুও তা আমার মসজিদ হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহু আকবার, মসজিদটি যে কতটা বরকতময় তা রাসূল (সা.)-এর কথা থেকে স্পষ্ট। এর নির্মাণের সময় তিনি নিজে সাহাবিদের সঙ্গে কাজ করেছেন। মদিনা হিজরতের পর হজুর (সা.) সর্বপ্রথম ইসলামের কর্মকেন্দ্র হিসেবে একটি মসজিদ নির্মাণের প্রয়োজন বোধ করেন। তখন তিনি হজরত আবু আনসারির বাড়ির সামনের এ খালি জায়গাটি পছন্দ করেন।
জায়গার মালিক ছিল অল্প বয়সের এতিম দুই ভাই। তাদের কাছে জমিটি হুজুর (সা.) কেনার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন কিন্তু তারা বিনা মূল্যেই দিতে চাইলেন। হুজুর (সা.) দুই ভায়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে বিনা মূল্যে না নিয়ে তৎকালীন বাজারমূল্য দশ দিনার দিয়ে কিনে নিলেন। মসজিদে নববীর প্রথম ভিত্তিও স্থাপন করেন আখেরি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)।
নির্মাণকালীন এর দরজা ছিল মোট তিনটি। যা এ সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে প্রধান ফটক ৪১টিসহ মোট ৮৩টি। আজকের আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম দৃষ্টিনন্দন মসজিদে নববী-মদিনার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত।
১ম হিজরি ৬২২ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণকাল। বর্তমানে ৬ লাখ মুসল্লি ধারণ ক্ষমতা, তবে হজ মৌসুমে ১০ লাখ পর্যন্ত নামাজ আদায় করতে পারে- মসজিদে নববীর বর্তমান মিনার রয়েছে ১০টি। নজরকাড়া প্রতিটি মিনারের উচ্চতা ৩৪৪ ফুট। এর ভেতরের দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য ও আলোকসজ্জা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।
১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র আরব উপদ্বীপে সর্বপ্রথম বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো হয় এই মসজিদে। নববীর পুরনো অভিজ্ঞ বাঙালি খাদেম খলিলুর রহমানের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল প্রতিদিন ফজরের পর বিশাল আকৃতির ২৭টি গম্বুজ বৈদ্যুতিক সাহায্যে সরে যাওয়ার পর সরাসরি বাইরের আলো মসজিদের মেঝে পর্যন্ত পড়ে।
আমি নিজেও একদিন প্রত্যক্ষ করে অবাক হয়েছি। নববীর ভেতরেই রয়েছে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) রওজা শরিফ। তাঁর পাশেই হজরত আবুবকর (রা.) ও হজরত ওমর (রা.)-এর কবর। মসজিদে নববীর মিম্বার থেকে রওজা পর্যন্ত স্থানটিকে বলা হয় রিয়াদুল জান্নাত বা জান্নাতের বাগান। এখানে ইবাদতের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। মসজিদের দক্ষিণ পূর্ব দিকে রয়েছে জান্নাতুল বাকী নামক কবরস্থান।
হজরত ওসমান (রা.) ও ফাতিমা (রা.)সহ দশ হাজার সাহাবির কবর রয়েছে এখানে। জান্নাতুল বাকীতে সর্বপ্রথম হজরত আসাদ বিন জারারা (রা.) কে দাফন করা হয়। মসজিদে নববীর ৫ নং ও ৮ নং গেটের সামনে রয়েছে কোরআন এক্সিভিশন সেন্টার ও রাসূল (সা.)-এর জীবনীর এক্সিভিশন সেন্টার।
সেখানে রক্ষিত রয়েছে হাতে লেখা এ যাবৎ পাওয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোরআন শরিফসহ হাজার বছর আগের বিভিন্ন সাইজের হস্ত লেখা কোরআন শরিফ। আরও রয়েছে কাবাঘরের পূর্ব অবস্থা, মসজিদে নববীর প্রথম আকৃতির প্রতিকৃতি। দেয়ালে লাগানো রাসূল (সা.)-এর শিশুকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনীসহ নানা নিদর্শন।
ইংরেজি ও আরবিতে লেখা রাসূল (সা.)-এর জীবনী ধৈর্যসহকারে পড়লে হাজী ও ভ্রমণপিপাসুদের জন্য বেশ শিক্ষণীয় হয়ে রবে। মসজিদে নববীর ২১ ও ২২ নাম্বার গেটের কিছুটা সামনে রয়েছে সুদৃশ্য একটি ঘড়ি, যা আগন্তুকদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। তার পাশেই রয়েছে ঝাঁকবাঁধা শতশত জালালি কবুতরের অবাধ বিচরণ।
যা আপনাকে তপ্ত গরমেও জালালির ওড়াউড়ি চোখে-মুখে প্রশান্তি এনে দেবে। এবার বিদায় নিতে হচ্ছে ইসলামের দ্বিতীয় পবিত্রতম মসজিদে নববী থেকে, যেখান থেকে সারা দুনিয়ার অর্ধেকেরও বেশি এলাকা শাসন করা হতো এক সময়। হে আল্লাহ আমাদের মদিনা সফর কবুল করে নিন।
লেখক : শৌখিন ভ্রমণকারী