হাওর বার্তা ডেস্কঃ বিএনপির ভারতের সঙ্গে ‘নতুন সম্পর্কের’ বার্তাকে ভালো চোখে দেখছে না জোটের শরিক দলের নেতারা। একাধিক নেতা বলেছেন, এই সফরে জোটের প্রধান দলটির নেতারা যেসব কথা বলে এসেছেন, সেটি তাদের জন্য বিব্রতকর। আর শরিকদের মধ্যে যারা বিএনপির অবস্থানের পক্ষে, তারা বলছেন, অতীতে ভারতবিরোধী যেসব বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্ব পেয়েছে এবং ভোটারদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, সেগুলো এখন অচল। কাজেই বাস্তবতার আলোকেই রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে।
বিএনপির মতোই ভারতবিরোধী জোটের শরিকরা
বিএনপির মতো তাদের জোটের শরিকরাও রাজনীতিতে কট্টর ভারতবিরোধী হিসেবে পরিচিত। এসব দলের নেতারা প্রকাশ্যেই এক ধরনের ভারত জুজু তৈরির জন্য কথা বলে আসছেন বছরের পর বছর ধরে।
বিএনপির জোটের শরিকদের মধ্যে বেশ কিছু দলই মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। আবার কিছু দলের উদ্ভব পরে হলেও এসব দলগুলো পাকিস্তানপন্থী বিভিন্ন দল থেকে বেরিয়ে এসে নেতারা করেছেন নতুন দল।
এই নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, বিএনপির তার নীতি পরিবর্তন করে ভারতের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করলে রাজনীতিতে খেসারত দিতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিককে জোটের একটি শরিক দলের মহাসচিব বলেন, ‘অতীতের ভারতকে নিয়ে বিএনপির পররাষ্ট্র নীতি ভুল ছিল সফরে যাওয়া একজন নেতা বলেছেন।এর অর্থ তাহলে কী দাঁড়ালো? নি:শর্ত আত্মসমর্পণ নাকি?’
‘তাহলে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়া শুধু ভুল করে গেছেন? তারা না থাকলে বিএনপি থাকে কী করে? ভারতীয় আগ্রাসন বিরোধী দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের আবেগ তাহলে মিথ্যা?’
বিএনপির আরেকটি শরিক দলের নেতা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে সাংবাদিককে বলেন, ‘জানতে ইচ্ছে করে পুরনো-পরীক্ষিত বন্ধুকে বাদ দিয়ে ভারত নতুন বন্ধুকে সব দিয়ে দিবে এই কথায় যারা বিশ্বাস করেন তাদের ভবিষ্যত পরিণতি কী হবে বা হতে পারে ?
এ বিষয়ে ২০ দলের শরিক বাংলাদেশ ন্যাপ এর মহাসচিব এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া সাংবাদিককে বলেন, ‘বাংলাদেশের একটি বৃহত্তম দল হিসেবে বিএনপি তার আভ্যন্তরীণ নিজস্ব রাজনৈতিক কৌশল থাকতেই পারে। তারা কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে কীভাবে করবে সেটা একান্তই তাদের নিজস্ব। তবে একটি বিষয় তাদের ভেবে দেখতে হবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক করতে গিয়ে নিজের রাজনীতি বিসর্জন দিলে এর মাসুল তাদের গুণতে হবে।’
‘কারণ ইতিমধ্যে ভারত সফলে যাওয়া নেতাদের একজন যে সকল কথা বলেছেন, তাতে জিয়াউর রহমান ও বেগম জিয়ার রাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। তাদের রাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ হলে বিএনপির ভবিষ্যত কী দাঁড়াবে?’
বাংলাদেশে বিএনপি বরাবর মাঠের রাজনীতিতে ভারতবিরোধী বক্তব্য দিয়ে এসেছে। তবে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত সমস্যার সমাধানে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
বরং বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর ঘাঁটি থাকা নিয়ে বারবার ভারত অভিযোগ করে এসেছে। এমনকি ভারতে তখন একাধিক আক্রমণ চালানো জঙ্গিরাও বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিল বলে দাবি করে আসছিল প্রতিবেশী দেশটি।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ঘটনাচক্রে আটক হওয়া ১০ ট্রাক অস্ত্র ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর বলেই তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর আগেও এই ধরনের চালান গেছে বলেও অভিযোগ আছে ভারতের।
এর মধ্যে গত সপ্তাহে ভারত সফরে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস-চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ও তারেক রহমানের উপদেষ্টা ও বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির।
চারদিনের ভারত সফরে বিএনপির প্রতিনিধি দল সে দেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর, জাতীয় কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী এবং শাসক বিজেপি সমর্থক ‘শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ফাউন্ডেশনের’ অধিকর্তা অনির্বাণ গাঙ্গুলির সঙ্গে বৈঠক করেন। এছাড়াও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দপ্তর, ন্যাশনাল কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর সচিবালয় এবং ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর পক্ষ থেকে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে অনির্বাণ গাঙ্গুলি বৈঠক করেন।
এ সময় বিজেপি এবং কংগ্রেস বিএনপিকে জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগের পরামর্শ দিয়েছে বলেও খবর প্রকাশ হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। বিএনপির জোটের শরিকরাও জামায়াতের বিষয়ে বিএনপিকে বাস্তবতা উপলদ্ধি করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের পরামর্শের বিষয়ে জোট নেতা গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘২০১৪ সাল থেকেই ভারত জামায়াতসহ আরো দুই একটি বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে। সেখানে কংগ্রেস কিংবা বিজেপি অবস্থাগত কোন ফাঁরাক নেই। তাহলে কিসের আশায় বিএনপি এই দৌঁড়ঝাপ করছে তা বুঝে আসছে না।’
বিএনপির ভারত নীতি পরিবর্তনে এলডিপির সমর্থন
বিএনপির এই অবস্থানকে যারা সমর্থন করছেন, তাদের একজন এলডিপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাৎ হোসেন সেলিম। সাংবাদিককে তিনি বলেন, ‘এলডিপির চেয়ারম্যান অলি আহমেদ মন্ত্রী থাকা অবস্থায় (তখন অলি বিএনপি করতেন) ভারতের সঙ্গে বেশ কিছু বিষয় সমাধান করেছিলেন। বিএনপির সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক তৈরিতেও কাজ করেছিলেন। তারপরও যেসব বিষয় নিয়ে ভারতের আপত্তির জায়গায় সেক্ষেত্রে বিএনপির অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে দক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে।’
‘তবে সবকিছু অবশ্যই আত্মমর্যাদা রক্ষা করে সুসম্পর্ক রাখতে হবে।দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে আলোচনার ভিত্তিতে।’
সেলিম বলেন, ‘বিএনপি ভারতকে আশ্বাস দিয়েছে যে বাংলাদেশের মাটি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যবহার করতে দেবে না। আমরা এর সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে একমত।’
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে ভারতের সহযোগিতা চাওয়ার বিষয়ে এই নেতা বলেন, ‘এখানে দোষের কিছু নেই। আর গত নির্বাচনের সময় কংগ্রেসের অবস্থান যেমন ছিল সেটা এখন অতীত। আর বিজেপি আগের মত হস্তক্ষেপ করবে তেমনটা আর সুযোগ নেই। বারবার এক কাজ হয় না।’
জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে এলডিপি নেতারা ইদানীং জামায়াত নিয়ে নতুন করে ভাবতে বিএনপিকে পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
বিএনপি নেতাদের ভারত সফরে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার পরামর্শেও সমর্থন দিচ্ছেন এলডিপি নেতা সেলিম। সাংবাদিককে তিনি বলেন, ‘জামায়াতের ব্যাপারে বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া উচিত। জামায়াত সবসময় ভুল রাজনীতি করছে। এ কারণে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যে কারণে বিএনপিরও জামায়াতের বাস্তবতাভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।’
‘আর জামায়াতের তো এখন নিবন্ধন নেই। সেক্ষেত্রে আপনাকে বড় কিছু অর্জন করতে হলে কিছু বিষয় বিসর্জন দিতে হয়। সেটা আপনাকে দিতেই হবে।’
ভারত নিয়ে ৯০ দশকের তুলনায় নমনীয় বিএনপি
বিএনপির ভারতবিরোধী অবস্থান আর বক্তব্য অবশ্য ৯০ দশকের তুলনায় এখন অনেক নমনীয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ঢাকা-কলকাতা রুটে বাস চালুর প্রতিবাদে ৭২ ঘণ্টা টানা হরতাল করেছিল বিএনপি। তাদের সে সময় দাবি ছিল, এই বাস চালু হলে সার্বভৌমত্ব হারাবে বাংলাদেশ। সে সময় পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ফেরাতে চুক্তি সইয়ের পরও চট্টগ্রাম থেকে ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাওয়ার দাবি করে চুক্তিবিরোধী লংমার্চ করেছিল বিএনপি। এই ধরনের অবস্থান অবশ্য ইদানীং আর নিচ্ছে না দলটি।
এর মধ্যে বিএনপি প্রতিনিধি দলের ভারত সফর নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে আসা বক্তব্য জোটের শরিকদেরকে নানাভাবে ভাবাচ্ছে।
ভারতের দ্য হিন্দুর খবরে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের উদ্বৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, বিএনপির ৮০ ও ৯০ দশকের রাজনীতি এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পেছনে ফিরে তাকানোর পরিবর্তে আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।
এছাড়া বিএনপি সরকারের বিগত আমলগুলোতে ভারত ও বাংলাদেশের খারাপ সম্পর্কের নীতিকে ‘ভুল ও বোকামি’ বলেও মন্তব্য করেছেন এই বিএনপি নেতা।
এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি নেতারা মাঠ বক্তব্য রাখেন যে, আওয়ামী লীগ জিতলে দেশ ভারত হয়ে যাবে। কিন্তু এসব কথা ইদানীং তারা আর বলছেন না। এমনকি ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, আওয়ামী লীগ জিতলে মসজিতে উলুধ্বনী বাজবে। এসব কথা এখন বললে বেকায়দায় পড়া ছাড়া আর কিছুই হবে না, সেটি এখন নিশ্চিত।
সূত্রঃ ঢাকাটাইমস