যেসব সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ জাকাত ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রুকন। নামাজের পরেই জাকাতের স্থান। কোরআনের ৩০ জায়গায় জাকাতের বিধান এসেছে। রাসুল (সা.) জাকাত প্রদানের ওপর সাহাবাদের থেকে বাইয়াত গ্রহণ করেন (বোখারি : ১৪০১; মুসলিম : ৫৬)। এবং রাসুল (সা.) এর ইন্তেকালের পর জাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে হজরত আবু বকর (রা.) সুস্পষ্ট যুদ্ধ ঘোষণা করেন। (বোখারি : ৭২৮৪; মুসলিম : ২০)।

জাকাত আদায়কারী বান্দাদের জন্য অশেষ রহমত ও সওয়াবের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা নামাজ আদায় করো এবং জাকাত প্রদান করো। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে তা আল্লাহর কাছে পাবে। (সূরা বাকারা : ১১০)। সূরা নিসার ১৬২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ‘আজরুন আযিম (মহাপুরস্কার)’ এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

অপরদিকে ফরজ হওয়া সত্ত্বেও যারা জাকাত আদায় করে না, কোরআনে তাদের মর্মন্তুদ শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার কথা বলে দেওয়া হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, ‘যারা স্বর্ণ-রৌপ্য (ধনসম্পদ) জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের কঠোর আজাবের সংবাদ দিন। সেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং সেগুলোর দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে। (সূরা তওবা : ৩৪-৩৫)।

রাসুল (সা.) বলেন, ‘যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন কিন্তু সে তার জাকাত দেয়নি, কেয়ামতের দিন তা বিষধর স্বর্পরূপে উপস্থিত হবে এবং তার গলায় পেঁচিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার উভয় অধরপ্রান্তে দংশন করবে এবং বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার পুঞ্জীভূত ধন। (বোখারি : ১৪০৩)।

যাদের ওপর জাকাত ফরজ : সুস্থ মস্তিষ্ক, আজাদ, বালেগ মুসলমান নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার পর চন্দ্র মাস হিসেবে এক বছর অতিবাহিত হলে জাকাত আদায় করা তার ওপর ফরজ। (আদ্দুররুল মুখতার : ২/২৫৯; বাদায়েউস সানায়ে : ২/৭৯, ৮২)।

কাফির, অসুস্থ মস্তিষ্ক মুসলিম এবং নাবালেগ শিশু-কিশোরের ওপর জাকাত ফরজ নয়। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৬/৪৬১-৪৬২; রদ্দুল মুহতার : ২/২৫৮, ২৫৯)।

নিসাবের বিবরণ : ১. সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ কিংবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মালিক হলে (ব্যবহৃত হোক বা না হোক) সর্বাবস্থায়ই তার জাকাত দিতে হবে। (আবু দাউদ : ১৫৭৩; মুসান্নাফে আবদুর রায্যাক : ৭০৫৪-৭০৬১, ৭০৬৩-৭০৬৫; আদদুরুল মুখতার : ২/২৯৫)।

২. আর যদি সোনা-রুপা নিসাব পরিমাণ না হয়, কিন্তু সঙ্গে নগদ টাকা সারা বছর হাতে থাকে; যদি ওই সোনা বা রুপার সঙ্গে টাকা একত্র করলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার দামের সমান হয়, তাহলে জাকাতের নিসাব পূর্ণ হয়েছে ধরা হবে এবং এর জাকাত দিতে হবে। (রদ্দুল মুহতার : ২/৩০৩; ফাতাওয়া দারুল উলুম : ৬/৫০)।

৩. প্রয়োজনের উদ্বৃত্ত টাকাপয়সা বা বাণিজ্যদ্রব্যের মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমপরিমাণ হলে জাকাতের নিসাব পূর্ণ হয়েছে ধরা হবে এবং এর জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রায্যাক : ৬৭৯৭, ৬৮৫১; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৯৯৩৭)।

যেসব জিনিসের ওপর জাকাত ফরজ :
১. সব ধরনের সম্পদে জাকাত ফরজ হয় না। শুধু সোনা-রুপা, টাকাপয়সা, পালিত পশু (নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী) এবং ব্যবসার পণ্যে জাকাত ফরজ হয়।

২. সোনা-রুপা ছাড়া অন্য কোনো ধাতুর অলংকার যেমন হিরা, মণিমুক্তা ইত্যাদি মূল্যবান পাথর ব্যবসাপণ্য না হলে সেগুলোয় জাকাত ফরজ নয়। (মুসান্নাফে আবদুর রায্যাক : ৭০৬১-৭০৬৪; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ১০০৭৫)।

৩. মৌলিক প্রয়োজন থেকে উদ্ধৃত্ত টাকাপয়সা (ব্যবসায় না খাটিয়ে এমনি রেখে দিলেও) নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত ফরজ হয়ে যায়। বছর পূর্ণ হলে তার জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রায্যাক : ৭০৯১-৭০৯২; আদ্দুররুল মুখতার : ২/২৬৭; রদ্দুল মুহতার : ২/২৬২, ৩০০)।

৪. ব্যাংক অ্যাকাউন্ট : ব্যাংকের ব্যক্তিমালিকানাধীন সব ধরনের অ্যাকাউন্ট, বন্ড, সার্টিফিকেট ইত্যাদি নগদ টাকাপয়সার মতো জাকাতযোগ্য। অ্যাকাউন্ট থেকে ট্যাক্স বা সার্ভিস চার্জ কাটা গেলে জাকাতের হিসাবে এ টাকা অন্তর্ভুক্ত হবে না। (আলমগিরি : ১/৭২; ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া : ৩/৫৭)। তবে ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত সুদ (মুনাফা নামের সুদ) জমা হলে তা জাকাতযোগ্য নয়; বরং সুদ ও হারাম মাল হস্তগত হলে পুরোটাই সাওয়াবের নিয়ত ছাড়া সদকা করে দিতে হবে।

৫. ব্যাংক গ্যারান্টি মানি : বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিকিউরিটি হিসেবে ব্যাংক গ্যারান্টি প্রদান ও গ্রহণের রেওয়াজ চালু আছে। এ টাকা সন্দেহাতীতভাবে জাকাতযোগ্য। যতদিন এ টাকার ওপর অ্যাকাউন্টহোল্ডারের মালিকানা থাকবে, ততদিন অন্যান্য টাকার মতোই এ টাকার জাকাত প্রদান করতে হবে।

৬. ঋণ বা ব্যাংক লোন : কারও ঋণ যদি এত হয়, যা বাদ দিলে তার কাছে নিসাব পরিমাণ জাকাতযোগ্য সম্পদ থাকে না, তাহলে তার ওপর জাকাত ফরজ নয়। (মুয়াত্তা মালেক : ১০৭; মুসান্নাফে আবদুর রায্যাক : ৭০০৩, ৭০৮৬, ৭০৮৯, ৭০৯০; আদ্দুররুল মুখতার : ২/২৬৩; বাদায়েউস সানায়ে : ২/৮৩)। তবে যেসব ঋণ উন্নয়নের জন্য নেওয়া হয়, যেমন বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিশাল বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করা অথবা ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য লোন নেওয়া; পরিভাষায় এগুলোকে ডেভেলপমেন্ট বা উন্নয়নমূলক লোন বলে। জাকাতের হিসাবের সময় ডেভেলপমেন্ট লোন বিয়োগ হবে না। (মুসান্নাফে আবদুর রায্যাক : ৭০৮৭)।

৭. ঋণ দেওয়া টাকার ওপর জাকাত দিতে হবে। এক্ষেত্রে এ টাকার জাকাত প্রতি বছর আদায় করতে পারে অথবা হস্তগত হওয়ার পর পেছনের বছরগুলোর জাকাত একত্রেও পরিশোধ করতে পারে। (আদ্দুররুল মুখতার : ২/২২৬; দারুল উলুম : ৬/৪৫, ৭৭)। অবশ্য যে ঋণ দেওয়া টাকা পাওয়ার কোনো আশা নেই, সে টাকার জাকাত দিতে হবে না। পরবর্তীতে ওই টাকা হস্তগত হলে তখন থেকে জাকাতের নিসাবভুক্ত হবে। অতীতের জাকাত দিতে হবে না। (কিতাবুল ফিকহ : ১/৫৪৮; দুররে মুখতার ও রদ্দুল মুহতার : ২/২২৬)। বিক্রীত পণ্যের বকেয়া টাকার জাকাতের বিধানও ঋণের মতো।

৮. ব্যবসার নিয়তে কোনো কিছু ক্রয় করলে তা স্থাবর সম্পত্তি হোক, যেমন জমিজমা, ফ্ল্যাট কিংবা অস্থাবর, যেমন মুদি সামগ্রী, কাপড়চোপড় ইত্যাদি, তা বাণিজ্যদ্রব্য বলে গণ্য হবে এবং মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত দেওয়া ফরজ হবে। (সুনানে আবু দাউদ : ১/২১৮; সুনানে কুকরা বায়হাকি : ৪/১৫৭; মুয়াত্তা ইমাম মালেক : ১০৮; মুসান্নাফে আবদুর রায্যাক : ৭১০৩, ৭১০৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা : ১০৫৫৭, ১০৫৬০, ১০৫৬৩)।

৯. শেয়ার : বর্তমানে দুই ধরনের শেয়ারহোল্ডার লক্ষ করা যায় ক. যারা আপিওতে অংশগ্রহণ করে শেয়ার খরিদ করে থাকে কোম্পানির বার্ষিক ডিভিডেন্ট (লভ্যাংশ) পাওয়ার উদ্দেশ্যে, তারা ওই কোম্পানির ব্যালেন্সশিট দেখে জাকাত পরিশোধ করবে। এক্ষেত্রে ব্যালেন্সশিট দেখে কোম্পানির ফিক্সড অ্যাসেটসে (স্থায়ী সম্পদ) শেয়ার অনুযায়ী তার যতটুকু অংশ রয়েছে, তত টাকা জাকাতের হিসাব থেকে বাদ দিতে পারবে। অবশিষ্ট মূল টাকা ও কোম্পানি ঘোষিত লভ্যাংশের (নগদ, বোনাস শেয়ার ইত্যাদি) জাকাত প্রদান করতে হবে। খ. যারা ক্যাপিটাল গেইন করে অর্থাৎ শেয়ার বেচাকেনাই এদের মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে; কোম্পানির ঘোষিত লভ্যাংশ নেওয়া এদের মূল উদ্দেশ্য থাকে না, তারা জাকাত আদায় করবে শেয়ারের মার্কেট ভ্যালু হিসেবে। তাদের জাকাতের বছর যেদিন পূর্ণ হবে, সেদিন শেয়ারবাজারে ওই শেয়ারের যে মূল্য থাকে, সে মূল্য হিসাব করেই জাকাত আদায় করবে।

১০. অ্যাডভান্স টাকায় জাকাত : যদি কোন সাহিবে নিসাব ব্যক্তি দোকান কিংবা বাড়িভাড়া নেয় আর মালিকের কাছে সিকিউরিটি হিসেবে কোনো টাকা জমা রাখে, যা পরবর্তীতে ফেরতযোগ্য, তাহলে ওই টাকার জাকাত দেওয়া ফরজ। কারণ ওই টাকা তার মালিকানায়ই রয়েছে। (আদদুররুল মুখতার : ২/৩০৫; দারুল উলুম : ৬/৭৭; আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/২৫১)। তবে ওই টাকা যদি ‘অ্যাডভান্স ভাড়া’ হয়, যা থেকে মাসে মাসে কিছু কিছু কাটা হয়, তাহলে ওই টাকার জাকাত দিতে হবে না।

১১. বায়নানামার টাকা : জমি, ফ্ল্যাট বা অন্যকিছু কিনে প্রাথমিকভাবে যে আংশিক টাকা প্রদান করে বায়নানামায় চুক্তি হয়, সে টাকার মালিক বিক্রেতা। সুতরাং এর জাকাত বিক্রেতা প্রদান করবে। জাকাত ট্যাক্স নয় : এ কথা স্মরণ রাখা জরুরি, জাকাত কোনো ট্যাক্স নয়, বরং ইসলামের অন্যতম রুকন; ধনীর ওপর গরিবের হক। তাই সরকার কোনো মালের ট্যাক্স নিয়ে নিলেও অবশিষ্ট মাল নিসাব পরিমাণ হলে তার জাকাত দিতে হবে। আল্লাহ সবাইকে সঠিকভাবে জাকাত আদায় করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া আম্বরশাহ আল ইসলামিয়া, কারওয়ানবাজার, তেজগাঁও, ঢাকা

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর