হাওর বার্তা ডেস্কঃ সৌর বিদ্যুৎচালিত সেচ পাম্প কোনো উপকারে না এলেও পঞ্চগড় জেলার ১৪টি সমবায় সমিতির সঙ্গে জড়িত কৃষক সাড়ে ৭ কোটি টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছে। ব্যাংক ও সোলার প্যানেল কর্তৃপক্ষ দুর্নীতির আশ্রয় নেয়ার কারণে কৃষক এ অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে। বিদ্যুৎ সুবিধা না থাকার পাশাপাশি লোডশেডিংয়ের কারণে কৃষিকাজে ব্যাঘাত ঘটার জন্য নিরবচ্ছিন্ন সেচ পাম্প চালাতে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে সেচ পাম্প চালাতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে একটি বেসরকারি ব্যাংক।
ওই ব্যাংকের মাধ্যমে কৃষক সমবায় সমিতি গঠন করে ঋণের টাকায় বসানো হয় সৌরচালিত সেচ পাম্প। ১০ বছরের জন্য এই সেচ পাম্প বসানো হলেও নিম্নমানের প্যানেল ও যন্ত্রাংশ দেয়ায় স্থাপনের ২-৩ বছরের মধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে পাম্প। কৃষক বাধ্য হয়ে সেচকাজ চালাতে প্যানেলের পাশেই গভীর নলকূপ স্থাপন করে তাদের জমিতে চাষাবাদ করছে। সেচ পাম্প থেকে কোনো আয় না থাকলেও মূল ঋণের সঙ্গে আরো ২ কোটি ২০ লাখ টাকার সুদের বোঝা কৃষকদের ঘাড়ে চেপেছে।
লিখিত অভিযোগে জানা যায়, কৃষকদের কৃষিকাজে সহায়তা করার জন্য মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের দু’জন কর্মকর্তা ইকবাল ও কিবরিয়া পঞ্চগড়ে এসে পরিবেশ বান্ধব ও নিরবিচ্ছিন্নভাবে সৌর বিদ্যুৎ চালিত সেচ পাম্প ব্যবহারের পরামর্শ দেন। এজন্য তারা ব্যাংক থেকে ঋণ প্রদানের বিষয়টিও কৃষকদের নিশ্চিত করেন। তাদের কথামতো পঞ্চগড় জেলায় ১৪টি কৃষক সমবায় সমিতি গঠন করা হয়।
এসব সমিতিতে ১৭টি সৌর বিদ্যুৎ চালিত সেচ পাম্প বসানোর জন্য ব্যাংকের ঠাকুরগাঁও শাখার মাধ্যমে গ্রীন এনার্জি (এগ্রিকালচার বেসড ঋণ) প্রকল্পের আওতায় কৃষক সমবায় সমিতিগুলোর সদস্যদের জমি বন্ধক রেখে পাঁচ কোটি ৩০ লাখ টাকা ঋণ বরাদ্দ করা হয়। সেই ঋণের টাকা দিয়ে গ্রীন টেক নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ১৭টি সৌর বিদ্যুৎচালিত পাম্পের জন্য প্রয়োজনীয় প্যানেল ও যন্ত্রাংশ স্থাপন করা হয়।
নির্মাণ করা হয় প্রয়োজনীয় ড্রেন। প্রতিটি পাম্প দিয়ে ১০ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে ৮০-১০০ বিঘা জমিতে সেচ কার্যক্রম চালানোর কথা বলা হয়। শুরুতেই প্যানেল, পাম্প ও যন্ত্রাংশের মান নিয়ে কৃষক সন্দেহ প্রকাশ করলেও তারা তাদের সন্দেহ ঠিক নয় বলে নিশ্চিত করে। প্যানেল স্থাপনের প্রথম বছর ভাল সার্ভিস দিলেও পরবর্র্তী বছর থেকেই সমস্যা শুরু হয়। সারাদিন সূর্যের আলো থাকলেও পাম্পে পানি ওঠা কমতে থাকে। ওই পানি দিয়ে ৮-১০ বিঘা জমিতে সেচ কার্য চালানো যায়। এভাবে দুই বছর চলার পর পাম্প অচল হয়ে পড়ে। বর্তমানে অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
এ নিয়ে মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ও প্যানেল স্থাপনকারী প্রতিষ্ঠান গ্রীন টেক লিমিটেডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বার বার যোগাযোগ করেও তারা কোন ফল পায়নি। বাধ্য হয়ে তারা তাদের সৌর বিদ্যুৎচালিত সেচপাম্প ফিরিয়ে নিয়ে ঋণ থেকে মুক্তি পেতে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে লিখিতভাবে আবেদন করেছে।
পঞ্চগড় সদর উপজেলার চাকলাহাট ইউনিয়নের সিংরোড রতনীবাড়ী কৃষক সমবায় সমিতির সভাপতি মো. রাশেদুজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের কর্মকর্তা ইকবাল ও কিবরিয়া সাহেবের কথামতো আমরা সমবায় সমিতি গঠন করি। এরপর ২০১৪ সালের ৩০শে জুনের মধ্যে আমরা ১১৩ বিঘা জমির কাগজপত্র ব্যাংকের ঠাকুরগাঁও শাখায় প্রদান করলে পরের বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে নির্বাচিত ঠিকাদার প্যানেল স্থাপন করে সৌর বিদ্যুৎচালিত সেচপাম্প স্থাপনসহ ড্রেন নির্মাণ করে দেয়।
এজন্য আমাদের নামে ২৪ লাখ টাকা ঋণ দেখানো হয়। আমরা সেই ঋণের টাকা চোখেও দেখিনি। তারা আমাদের জানায়, এই পাম্প দিয়ে ১০ বছর পর্যন্ত ৮০-১০০ বিঘা জমিতে সেচ দিয়ে চাষাবাদ করা যাবে। আর সেচের আয় দিয়ে সুদসহ ঋণের কিস্তি প্রদান করতে হবে। কিন্তু প্রথম বছর ভালোভাবে সেচকার্য চালানো হলেও পরের বছর থেকেই সমস্যা শুরু হয়। ধীরে ধীরে পাম্প দিয়ে পানি ওঠা কমতে থাকে।
গত বোরো মৌসুমে এই পাম্প দিয়ে মাত্র ৮-৯ বিঘা জমি চাষ করতে পেরেছিলাম। আর চলতি বোরো মৌসুমে পাম্প চালু করতে গিয়ে দেখি তা অকেজো হয়ে আছে। পাম্প চালুই হচ্ছে না। আমরা এখন কিভাবে ঋণ শোধ করব। ঋণের সুদ তো বাড়তেই আছে। তাই আমরা সৌর বিদ্যুৎচালিত সেচ পাম্প তুলে নিয়ে ঋণ থেকে মুক্তি দিতে মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবরে লিখিত আবেদন করেছি।
বোদা উপজেলার উপজেলার বেংহারী বনগ্রাম ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য আমিরুল ইসলাম জানান, আমরা একশ’ একজন কৃষক মিলে বেংহারী ইসলামপুর আদর্শ কৃষক সমবায় সমিতি গঠন করি। মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের কর্মকর্তা ইকবাল সাহেব ঠাকুরগাঁও শাখার মাধ্যমে ২০১২ সালে ৭০ লাখ টাকার ঋণে আমাদের দুইটি সৌর বিদ্যুৎচালিত সেচ পাম্প স্থাপন করে দেন। কিন্তু এক বছর চলার পর থেকেই দুইটি পাম্পই অকেজো হয়ে আছে। আমরা ট্রাস্ট ব্যাংক ও সোলার স্থাপনকারী প্রতিষ্ঠান সেরপা কোম্পানির সঙ্গে বহুবার যোগাযোগ করেও তারা আমাদের কোনো কথাই শুনছে না।
মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ঠাকুরগাঁও শাখার ব্যবস্থাপক এনামুল হক বলেন, এই ঋণটি দেয়া শুরু হয়েছিল ২০১২-১৩ সাল থেকে। ইতিমধ্যে ৫-৬ বছর চলে গেছে। সমস্যা হলে শুরু থেকেই হওয়ার কথা ছিল। তারা তো আমাদের জানায়নি। আর ব্যাংক ঋণ দিয়ে যদি কোন গুডস কিনে দেয় তা ৫ বছর পর ফেরত নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারা যে চিঠি দিয়েছে তা আমি হেড অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি তাদের গাইডেন্স জানার জন্য। হেড অফিস আমাকে যেভাবে নির্দেশনা দেবে আমি সেভাবে ব্যবস্থা নেবো।