ঢাকা ০১:৫৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫, ৩০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওরাঞ্চলের ধান এখন কৃষকের গলার কাঁটা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:৪৯:০১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৭ মে ২০১৮
  • ৪৬৮ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ যে ধান কৃষকের মুখে হাসি ফুটায়, দুঃখ ভুলায়, নতুন করে স্বপ্ন দেখায়, ভালভাবে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যোগায় সেই সোনার ধান এখন হাওরাঞ্চলের কৃষকের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধানের বীজ বপন থেকে শুরু করে পরিচর্যা, ধান কাটা ও মাড়াই করে শুকিয়ে গোলায় তোলা পর্যন্ত একজন কৃষকের প্রতি মণ ধানের পেছনে যে পরিমাণ অর্থকড়ি খরচ হয় তার হিসেবে কষতে গেলে কৃষকেরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। তবুও কেন ফসল ফলান কৃষক? এর ব্যাখ্যা একেক কৃষকের কাছে একেক রকম। ব্যাখ্যা যাই হোক, ছয় থেকে সাত মাস হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম আর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ফসল হারানোর ঝুঁকি নিয়ে কৃষক যে ফসল উৎপাদন করেন তা বাধ্য হয়েই বিক্রি করে দেন স্থানীয় ফড়িয়াদের কাছে। বৈশাখের শুরু থেকে ফড়িয়ারা হাওরাঞ্চলে তৎপর হয়েছে।

ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর বাজারে রয়েছে ত্রিশটিরও বেশি ধানের আড়ৎ। এসব আড়ৎদারদের নিয়োজিত ফড়িয়ারা হাওরে হাওরে গিয়ে কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান সংগ্রহ করছে ধান কাটা শুরু হওয়ার সময় থেকে। আর সেই ধান আড়তে নিয়ে আসার পর আড়ৎদারদের কাছে থেকে মুন্সিগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ, আশুগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মিল (চালকল) মালিকরা সংগ্রহ করে। বৈশাখের প্রথম সপ্তাহ থেকে মিল মালিকরা মধ্যনগর থেকে ধান সংগ্রহ করছে। গড়ে প্রতিদিন মধ্যনগরের আড়ৎদারেরা তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার মণ ধান সরবরাহ করছেন দেশের বিভিন্ন মিলে। ধর্মপাশায় বিভিন্ন হাওরে প্রতিমণ ধান ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে কৃষক যে পরিমাণ ধান কেটেছে সেই পরিমাণ ধান শুকাতে না পারায় বিপাকে পড়তে হয়েছে তাদের। ফলে ভেজা ধান সংগ্রহে রাখতে না পারা, শ্রমিকের টাকা ও ঋণ পরিশোধের তাগিদ থেকে কম দামে ধান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকেরা।

এবারের মৌসুমে হাওর থেকে দেরিতে পানি নামায় ধানের চারা রোপন করতে দেরি হয়েছিল। অন্যান্য বছর ধানের চারা রোপনের সময় উজান থেকে হাওরাঞ্চলে শ্রমিকেরা আসতো কিন্তু এ বছর উজান থেকে আসা শ্রমিকের সংখ্যা ছিল অনেক কম। ফলে শ্রমিক সংকট ছিল প্রকট। শ্রমিক সংকটের কারণে স্থানীয় শ্রমিকেরা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাড়তি উপার্জন করেছে। ধান কাটা শুরু হলেও দেখা দেয় শ্রমিক সংকট। উজান থেকে ধান কাটার যে সকল শ্রমিক এসেছে তারা প্রতি কেয়ার জমির ধান কাটতে মজুরি নিয়েছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। কোনো কোনো শ্রমিকদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও করতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট কৃষকদের। হাওরাঞ্চলে শ্রমিক সংকটের অন্যতম কারণ ছিল গেল বছরের অকাল বন্যায় ফসলডুবি। ফসলডুবির ফলে হাওরাঞ্চলের খেটে খাওয়া বা শ্রমিক শ্রেণির মানুষ কাজের সন্ধানে শহরে পাড়ি জমালে তাদের অনেকেই আর নিজ এলাকায় ফেরেনি। ফলে শ্রমিক সংকট লেগেই থাকে।

ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের কৃষক গোলাম মোস্তফা জানান, ধানকুনিয়া হাওরে তার এক কেয়ার জমি চাষ করতে সাড়ে তিন হাজার টাকার মতো খরচ পড়েছে। সেই সাথে জমির ধান কাটতে শ্রমিকের মজুরি দিতে হয়েছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। এক কেয়ার জমিতে গড়ে ১৫ মণ ধান উৎপাদন হয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রতি মণ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা করে হলে ৯ হাজার থেকে সাড়ে ১০ হাজার টাকা। গোলাম মোস্তফা আরো জানান, আট মাসের জন্য ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে যে শ্রমিক রাখা হয়েছে এবং তার পরিবারের লোকজন যে শ্রম দিচ্ছেন তার আর্থিক মূল্য যদি ধরা হয় তাহলে আর কোনো লাভ খোঁজে পাওয়া যাবে না। চামরদানি ইউনিয়নের সাড়ারকোনা গ্রামের কৃষক অজিত সরকার জানান, যে দামে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে তাতে কৃষক লাভের মুখ দেখবে না। ব্লাস্ট রোগ ব্রি-২৮ ধানের ক্ষতি করায় উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। ফড়িয়ারা ধান মজুদ করছে। যা পরবর্তীতে বেশি দামে বিক্রি করবে।

মধ্যনগর আড়ৎদার কল্যাণ সমিতির সভাপতি জ্যোতির্ময় রায় বলেন, ‘আড়তে ধান মজুদ করা হচ্ছে না। হাওর থেকে ধান সংগ্রহের পর মুন্সিগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ, আশুগঞ্জ থেকে আসা মিলাররা সেই ধান সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। মধ্যনগর থেকে গড়ে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মণ ধান যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। ‘হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’র ধর্মপাশা উপজেলা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আলাউদ্দিন বলেন, ‘হাওর থেকে কম দামে ধান সংগ্রহ করে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী লাভবান হচ্ছে। কৃষকেরা গোলা শূন্য হচ্ছে। যখন সরকারি মূল্যে ধান সংগ্রহ শুরু হবে তখন প্রকৃত কৃষকের ঘরে ধান থাকবে না। বিভিন্ন কারণে কৃষক হাওর থেকেই ধান বিক্রি করে দিচ্ছে।’

মধ্যনগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান প্রবীর বিজয় তালুকদার বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে সরকারি মূল্যে ধান সংগ্রহ শুরু হলে অকৃষকরাই ধান দেওয়ার সুযোগ পায়। প্রকৃত কৃষকেরা সরকারি মূল্যে খাদ্য গুদামে ধান দেওয়ার সুযোগ পায় না। এবার যাতে সে ব্যবস্থা করা হয় সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নজর দিতে হবে। দ্রুত সরকারি মূল্যে ধান সংগ্রহ করা উচিত। ধর্মপাশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পুলক কান্তি চক্রবর্তী বলেন, ‘২ মে থেকে সরকারি মূল্যে ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু হওয়ার কথা ছিল কিন্তু এখন পর্যন্ত তা শুরু হয়নি। কবে নাগাদ শুরু হতে পারে তা এখনো জানা যায়নি।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

হাওরাঞ্চলের ধান এখন কৃষকের গলার কাঁটা

আপডেট টাইম : ০৯:৪৯:০১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৭ মে ২০১৮

হাওর বার্তা ডেস্কঃ যে ধান কৃষকের মুখে হাসি ফুটায়, দুঃখ ভুলায়, নতুন করে স্বপ্ন দেখায়, ভালভাবে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যোগায় সেই সোনার ধান এখন হাওরাঞ্চলের কৃষকের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধানের বীজ বপন থেকে শুরু করে পরিচর্যা, ধান কাটা ও মাড়াই করে শুকিয়ে গোলায় তোলা পর্যন্ত একজন কৃষকের প্রতি মণ ধানের পেছনে যে পরিমাণ অর্থকড়ি খরচ হয় তার হিসেবে কষতে গেলে কৃষকেরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। তবুও কেন ফসল ফলান কৃষক? এর ব্যাখ্যা একেক কৃষকের কাছে একেক রকম। ব্যাখ্যা যাই হোক, ছয় থেকে সাত মাস হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম আর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ফসল হারানোর ঝুঁকি নিয়ে কৃষক যে ফসল উৎপাদন করেন তা বাধ্য হয়েই বিক্রি করে দেন স্থানীয় ফড়িয়াদের কাছে। বৈশাখের শুরু থেকে ফড়িয়ারা হাওরাঞ্চলে তৎপর হয়েছে।

ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর বাজারে রয়েছে ত্রিশটিরও বেশি ধানের আড়ৎ। এসব আড়ৎদারদের নিয়োজিত ফড়িয়ারা হাওরে হাওরে গিয়ে কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান সংগ্রহ করছে ধান কাটা শুরু হওয়ার সময় থেকে। আর সেই ধান আড়তে নিয়ে আসার পর আড়ৎদারদের কাছে থেকে মুন্সিগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ, আশুগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মিল (চালকল) মালিকরা সংগ্রহ করে। বৈশাখের প্রথম সপ্তাহ থেকে মিল মালিকরা মধ্যনগর থেকে ধান সংগ্রহ করছে। গড়ে প্রতিদিন মধ্যনগরের আড়ৎদারেরা তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার মণ ধান সরবরাহ করছেন দেশের বিভিন্ন মিলে। ধর্মপাশায় বিভিন্ন হাওরে প্রতিমণ ধান ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে কৃষক যে পরিমাণ ধান কেটেছে সেই পরিমাণ ধান শুকাতে না পারায় বিপাকে পড়তে হয়েছে তাদের। ফলে ভেজা ধান সংগ্রহে রাখতে না পারা, শ্রমিকের টাকা ও ঋণ পরিশোধের তাগিদ থেকে কম দামে ধান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকেরা।

এবারের মৌসুমে হাওর থেকে দেরিতে পানি নামায় ধানের চারা রোপন করতে দেরি হয়েছিল। অন্যান্য বছর ধানের চারা রোপনের সময় উজান থেকে হাওরাঞ্চলে শ্রমিকেরা আসতো কিন্তু এ বছর উজান থেকে আসা শ্রমিকের সংখ্যা ছিল অনেক কম। ফলে শ্রমিক সংকট ছিল প্রকট। শ্রমিক সংকটের কারণে স্থানীয় শ্রমিকেরা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাড়তি উপার্জন করেছে। ধান কাটা শুরু হলেও দেখা দেয় শ্রমিক সংকট। উজান থেকে ধান কাটার যে সকল শ্রমিক এসেছে তারা প্রতি কেয়ার জমির ধান কাটতে মজুরি নিয়েছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। কোনো কোনো শ্রমিকদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও করতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট কৃষকদের। হাওরাঞ্চলে শ্রমিক সংকটের অন্যতম কারণ ছিল গেল বছরের অকাল বন্যায় ফসলডুবি। ফসলডুবির ফলে হাওরাঞ্চলের খেটে খাওয়া বা শ্রমিক শ্রেণির মানুষ কাজের সন্ধানে শহরে পাড়ি জমালে তাদের অনেকেই আর নিজ এলাকায় ফেরেনি। ফলে শ্রমিক সংকট লেগেই থাকে।

ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের কৃষক গোলাম মোস্তফা জানান, ধানকুনিয়া হাওরে তার এক কেয়ার জমি চাষ করতে সাড়ে তিন হাজার টাকার মতো খরচ পড়েছে। সেই সাথে জমির ধান কাটতে শ্রমিকের মজুরি দিতে হয়েছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। এক কেয়ার জমিতে গড়ে ১৫ মণ ধান উৎপাদন হয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রতি মণ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা করে হলে ৯ হাজার থেকে সাড়ে ১০ হাজার টাকা। গোলাম মোস্তফা আরো জানান, আট মাসের জন্য ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে যে শ্রমিক রাখা হয়েছে এবং তার পরিবারের লোকজন যে শ্রম দিচ্ছেন তার আর্থিক মূল্য যদি ধরা হয় তাহলে আর কোনো লাভ খোঁজে পাওয়া যাবে না। চামরদানি ইউনিয়নের সাড়ারকোনা গ্রামের কৃষক অজিত সরকার জানান, যে দামে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে তাতে কৃষক লাভের মুখ দেখবে না। ব্লাস্ট রোগ ব্রি-২৮ ধানের ক্ষতি করায় উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। ফড়িয়ারা ধান মজুদ করছে। যা পরবর্তীতে বেশি দামে বিক্রি করবে।

মধ্যনগর আড়ৎদার কল্যাণ সমিতির সভাপতি জ্যোতির্ময় রায় বলেন, ‘আড়তে ধান মজুদ করা হচ্ছে না। হাওর থেকে ধান সংগ্রহের পর মুন্সিগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ, আশুগঞ্জ থেকে আসা মিলাররা সেই ধান সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। মধ্যনগর থেকে গড়ে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মণ ধান যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। ‘হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’র ধর্মপাশা উপজেলা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আলাউদ্দিন বলেন, ‘হাওর থেকে কম দামে ধান সংগ্রহ করে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী লাভবান হচ্ছে। কৃষকেরা গোলা শূন্য হচ্ছে। যখন সরকারি মূল্যে ধান সংগ্রহ শুরু হবে তখন প্রকৃত কৃষকের ঘরে ধান থাকবে না। বিভিন্ন কারণে কৃষক হাওর থেকেই ধান বিক্রি করে দিচ্ছে।’

মধ্যনগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান প্রবীর বিজয় তালুকদার বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে সরকারি মূল্যে ধান সংগ্রহ শুরু হলে অকৃষকরাই ধান দেওয়ার সুযোগ পায়। প্রকৃত কৃষকেরা সরকারি মূল্যে খাদ্য গুদামে ধান দেওয়ার সুযোগ পায় না। এবার যাতে সে ব্যবস্থা করা হয় সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নজর দিতে হবে। দ্রুত সরকারি মূল্যে ধান সংগ্রহ করা উচিত। ধর্মপাশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পুলক কান্তি চক্রবর্তী বলেন, ‘২ মে থেকে সরকারি মূল্যে ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু হওয়ার কথা ছিল কিন্তু এখন পর্যন্ত তা শুরু হয়নি। কবে নাগাদ শুরু হতে পারে তা এখনো জানা যায়নি।