হাওর বার্তা ডেস্কঃ দুই বা তিন ফসলি জমিতে ইটভাটা কোনোভাবেই গড়ে উঠতে দেওয়া যাবে না। এমন নির্দেশ রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এই নির্দেশের থোড়াই কেয়ার করছে গাইবান্ধার ইটভাটার মালিকরা। যত্রতত্র ইটভাটা ভয়াবহ আকারে গ্রাস করছে কৃষিজমিতে। ইটভাটার মাটির স্তুপে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক সেতু-কালভার্ট। কৃষকদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ভাটার আশপাশের জমিতে বিঘাপ্রতি শুধু পাঁচ-ছয় মণ ধান কম উৎপাদন হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন দাবি করছে, তারা অভিযান চালিয়ে ইটভাটার জরিমানা করলেও সেগুলো আবার আগের মতোই চলছে।
জেলা সদরের লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের বেড়াডাঙ্গা ডিএসএম ভাটাসংলগ্ন সাড়ে পাঁচ বিঘা জমি আছে মোশারফ হোসেনের। তার অভিযোগ, এই ইটভাটার জন্য তার প্রতি বিঘা জমিতে ছয় মণ ধান ঘাটতি হচ্ছে। এভাবে প্রতি বছর তার ফসলে ঘাটতি দাঁড়ায় ৩০ থেকে ৪০ মণ।
কৃষকদের বাঁচাতে জরুরি ভিত্তিতে ইটভাটাটি সরাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবি জানিয়ে মোশাররফ বলেন, ‘নইলে একসময় এসব জমিতে কৃষক আর ফসল ফলাতে পারবেন না।’
একই ইউনিয়নের বেড়াডাঙ্গা এলাকায় ডিএসএম ভাটার কারণে সেখানকার হাইব্রিড ধান কালো হয়ে গেছে। কৃষক সাত্তার ও তার ছেলে হাবিজার বলেন, ‘আমরা গরিব কৃষক জমি আদি নিয়ে ফসল ফলাই। কিন্তু ভাটার কালো ধোঁয়ার জন্য গত বছরের মতো এবারও আমাদের জমির হাইব্রিড ধান নষ্ট হয়ে গেছে।’
ইটভাটার কারণে এমন ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হলেও দুই-তিন ফসলি জমিতে অবৈধ ইটভাটাগুলো কীভাবে চলছে এমন প্রশ্ন তুলছেন কৃষক ও সচেতন মহল।
ইটভাটার প্রভাবে জমিতে ধান উদপাদন কম হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে জেলা সদরের উপ-সহকারী কৃষি অফিসার (ব্লক খোর্দ্দমালিবাড়ী) এ টি এম মশিউর রহমানের কাছ থেকেও। সাংবাদিককে তিনি জানান, ‘ইটভাটার কারণে প্রতি বিঘা জমিতে চার-পাঁচ মণ ধান উৎপাদন কম হচ্ছে। কৃষক সাত্তার ও তার ছেলে হাবিজারের রোপণ করা একটি জমিতে (হাইব্রিড ধান) ফসল নষ্ট হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেন তিনি।
ট্রেড লাইসেন্স, বিএসটিআই সনদ, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসক প্রদত্ত লাইসেন্সসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ইটভাটা স্থাপন করার আইন থাকলেও এগুলো লঙ্ঘন করা হচ্ছে। ইটভাটাগুলোর মধ্যে কয়েকটিতে সামান্য কয়লা ব্যবহৃত হলেও সনাতন বা ফিক্সড পদ্ধতির ইটভাটাগুলোর সব কটিতেই কয়লার পরিবর্তে কাঁচা কাঠ ও গাছের গুঁড়ি পোড়ানো হচ্ছে।
জানা গেছে, জেলার ইটভাটাগুলোতে প্রতি মৌসুমে ৩৫-৪০ লাখ মণ কাঠ পোঁড়ানো হচ্ছে। আর এসব কাঠের জোগান দিতে উজাড় করা হচ্ছে জেলার গাছপালা।
আর একটি সমস্যা নিদারুণভাবে ভাবিয়ে তুলছে কৃষকদের। ইটভাটার মাটির স্তুপে বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন রাস্তার কালভার্টের নিচে পানি চলাচলের পথ। ফলে বৃষ্টির পানি সরতে না পেরে কৃষিজমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করছে। ক্ষতি হচ্ছে ফসলের।
সাদুল্লাপুর থানা থেকে তুলসীঘাট রাস্তাটির বদলাগাড়ী এলাকায় কোনো রকম অনুমোদন ছাড়াই টিনের চিমনি (ব্যারেল চিমনি) দিয়ে এসবিএল নামের ইটভাটা চলছে। সেখানে পাশাপাশি দুটি ভাটার মাটির স্তুপে কালভার্টটি বন্ধ হয়ে আছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাদুল্লাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রহিমা খাতুন সাংবাদিককে বলেন, ‘কিছুদিন আগেও আমি সহকারী ভূমি অফিসারকে দিয়ে বেশ কিছু ভাটার জরিমানা করিয়েছি। তবে আইন মেনে ইটভাটা কেউ করছে না।’ কালভার্ট বন্ধের ব্যাপারটি তিনি দ্রুত দেখবেন বলে জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের জারি করা পরিপত্র অনুযায়ী ইটভাটায় ১২০ ফুট উঁচু চিমনি স্থাপন বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন (৪ ধারার ৫ উপধারা) অনুযায়ী আবাসিক এলাকা, উপজেলা সদর ও ফলবাগানের আশপাশের ৩ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ইটভাটা স্থাপন সম্পূর্ণ অবৈধ। কিন্তু এখানে ঘনবসতি ও তিনফসলি জমিতে ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে। এতে ইটভাটার নির্গত ধোঁয়া অতি সহজেই লোকালয় ও ক্ষেত-খামারে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ। দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জনজীবন।
জেলায় উদ্বেগজনক হারে ইটভাটা বাড়ার কারণে দিন দিন কমে যাচ্ছে আবাদি জমি। ফলে খাদ্য উদ্বৃত্ত গাইবান্ধা জেলায় ভবিষ্যতে খাদ্য উৎপাদনের ঘাটতি দেখা দেওয়ার অশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
যত্রতত্র ইটভাটা গড়ে ওঠার কারণ সম্পর্কে কিছু জানেনা বলে জানান গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আ কা ম রুহুল আমিন। তবে তিনি সাংবাদিককে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নির্দেশনাটি আমার জানা আছে। গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক মহোদয়কে আমি এই বিষয়গুলো বিস্তারিত জানাব।’
অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটায় বিভিন্ন অভিযোগে অভিযান চালানো হচ্ছে দাবি করে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পাল সাংবাদিককে বলেন, আগামী বছরে নতুন করে যাতে অবৈধভাবে ইটভাটা গড়ে উঠতে না পারে সে ব্যাপারে প্রশাসন ভূমিকা রাখবে। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলোর খোঁজ-খবর নিয়ে সেখানে দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন। একই সঙ্গে কালভার্ট বন্ধের বিষয়টি দেখবেন বলেও জানান জেলা প্রশাসক।