কোরবানির গরু নিয়ে ডাকাত আতঙ্কে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে মানিকগঞ্জের শিবালয়, হরিরামপুর ও দৌলতপুর উপজেলার পদ্মা-যমুনা বেষ্টিত চরাঞ্চলের মানুষ। এ তিনটি উপজেলার বেশ কয়েকটি চর রয়েছে। সেখানকার প্রায় পরিবারই প্রতি বছর কোরবানির ঈদে গরু বিক্রি করে অধিক মুনাফা অর্জন করে থাকে। চরের বাসিন্দাদের আয়ের একটি বড় উৎস হলো পশু পালন করা। চরের প্রতিটি বাড়িই যেন একেকটি খামার। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে কোরবানির গরু। চরের তাজা ঘাস ও খড়ের ওপর নির্ভর করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পশু পালন করেন চরাঞ্চলের বাসিন্দারা। বিশেষ করে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে তারা গরু লালন-পালন করে মোটাতাজ করে থাকেন। এবারও মানিকগঞ্জে বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে প্রায় ৩০ হাজার গরু কোরবানির পশুর হাটে যাচ্ছে।
চরবাসীর অভিযোগ, গত কয়েক বছরে এসব চর থেকে কয়েক শ গরু ডাকাতরা লুট করে নিয়েছে। কিন্তু পুলিশের কোন টহল নেই। ভয়ে এখন চরের লোকজনই রাত জেগে পাহাড়া দিচ্ছেন। কিন্তু ডাকাতের অস্ত্রের কাছে তারা অসহায়। এখানে বিগত দিনে ডাকাতদের হামলায় আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। এমনই একজন হাবু শেখ। তিনি জানান, বছরখানেক আগে তাদের গ্রামে ডাকাত হামলা করে। তার একটি ও ১২টি গরু লুটে নেয়। এক ডাকাতকে ধরেছিলেন তিনি। কিন্তু অন্য ডাকাতের হামলায় তিনি গুরুতর আহত হন। প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ করে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে এলেও ডান হাতটি এখন সোজা করতে পারেন না। কাজকর্ম করতে না পারায় তিনি এখন মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। চর শিবালয়ের আলী কাজী বলেন, প্রতি বছর কোরবানির ঈদের আগে ডাকাতদের উৎপাত বেড়ে যায়। রাতে ট্রলার নিয়ে তারা মানুষের বাড়ি বড়ি হানা দেয়। কিন্তু পুলিশ কোন ধরনের সাহায্য করে না। তাই রাত জেগে গরুগুলোকে পাহাড়া দিয়ে রাখতে হয়। কেবল আলী কাজীই নয় তার মতো ওই চরের গরু লালন-পালনকারী সবারই একই অভিযোগ। চর শিবালয়ের রোস্তম আলী শেখ জানালেন, প্রতি বছরই তিনি ৩-৪টি করে ষাঁড় গরু কোরবানির ঈদে বিক্রি করেন। এবারও ৪টি গরু পেলে বড় করছেন। গত কোরবানির ঈদের পর পরই গরু তিনটি কিনে এনেছেন প্রায় এক লাখ টাকা দিয়ে। এই এক বছরে তার খরচ হয়েছে আরও এক লাখ টাকা। আশা করছেন গরু ৩টি আড়াই থেকে তিন লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারবেন। তিনি জানান, লাভ যাই হোক ওই টাকা দিয়েই পুরো বছর তার ৬ সদস্যের সংসার খরচ চালাতে হবে। আবদুল করিম জানালেন, গত বছর দুটি গরু পেলে ৪০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। তবে আশা করছেন এ বছর হয়তো সেই ক্ষতি পুষিয়ে লাভ করা যাবে। তবে ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, আমরা এ চরের মানুষরা কষ্ট করে কোরবানির গরুর চাহিদা মেটাতে চেষ্টা করি। কিন্তু প্রাণিসম্পদ বিভাগ কোন সহযোগিতা করে না। চরের গৃহিণী আকলিমা আক্তার জনান, তার দুটি গাভী আর দুটি বাছুরসহ একটি ষাঁড় রয়েছে। দুধ বিক্রি করে তার সংসার চলে। পাশাপাশি কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য একটি ষাঁড় গরু লালন-পালন করে বড় করে তোলা হয়েছে। তিনি জানান, গরু থেকে চরে প্রচুর পরিমাণ দুধ উৎপাদন হয়। কিন্তু গরুর অসুখ-বিসুখে ডাক্তার পাওয়া যায় না। সংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা গেছে, মানিকগঞ্জে ৭টি উপজেলায় সরকারি হিসাব মতে বাজারজাত করার জন্য প্রস্তুত প্রায় এক লাখ পশু। এর মধ্যে গরু ৪৯ হাজার ২০৫, মহিষ ৪৯৭, ছাগল ৩৬ হাজার ২০৩ ও ভেড়া ১১ হাজার ৫২৭টি। আরিচা ও পাটুরিয়া ঘাট দিয়ে সীমান্তবর্তী জেলা থেকে প্রতিদিন গড়ে ৫০ ট্রাক পশু যাচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। কোরবানির পশু পালনকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে ভারতীয় গরুর প্রভাবে তাদের দেশীয় গরুর বাজার মার খেয়েছে। এবার ভারতীয় গরু না আসায় দেশীয় খামারিরা লাভবান হবেন বলে তাদের বিশ্বাস। আগের স্টেরোয়েড জাতীয় ওষুধ খাইয়ে গরু মোটাতাজা করা হতো। কিন্তু সময়মতো ওইসব গরু বিক্রি করতে না পারায় অনেক গরু মারা গেছে। অতীতের শিক্ষা নিয়ে মানিকগঞ্জে খামারি ও পরিবারভিত্তিক কোরবানির পশু পালনকারীরা বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে পশু পালন করছেন। এতে আগের মতো পশু মোটাতাজা দেখা না গেলেও সুস্থ-সবল রয়েছে। শিবালয় উপজেলার চরশিবালয় গ্রামের শেখ মনির হোসেন জানান, তাদের গ্রামে কোরবানির জন্য ৭ থেকে ৮০০ গরু রয়েছে। অধিকাংশ গরু তারা ৪-৫ মাস আগে কিনেছেন। চরে তাজা ঘাস তাদের গরু পালনের প্রধান উপকরণ। কিন্তু ১৫ দিন ধরে চরে নিচু জমি তলিয়ে যাওয়াতে ঘাস খাওয়াতে পারছেন না পশুকে। এখন গমের ভুসি, খইল আর খড় খাওয়াতে হচ্ছে। একই গ্রামের আমজাদ হোসেন জানান, কয়েক বছর ধরে গরু পালন করে তাদের ক্ষতি হচ্ছে। ভারতীয় গরুর কারণে দেশী গরুর দাম ছিল না। এবার ভারতীয় গরু আসা বন্ধ থাকায় তাদের কোরবানির পশুর চাহিদা রয়েছে বলে তিনি জানান। এবার তিনি আরও ১৫ দিন পর ৬টি গরু কোরবানির হাটে ওঠাবেন। দৌলতপুর উপজেলার আমতলী গ্রামের সিদ্দিক মিয়া জানান, গতবার তিনি চারটি গরু কোরবানির হাটে বিক্রি করেছেন। এতে খরচ বাদ দিয়ে তার ৩৫ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। এবার তিনি মাত্র দুটি গরু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করেছেন। তবে আশা করছেন ভারতীয় গরু না থাকায় এবার কোরবানির হাটে লাভেই বিক্রি করতে পারবেন তার গরু দুটি। এদিকে আরিচা ঘাটের ২২টি ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি রয়েছে। এসব ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি দেশের সীমান্তবর্তী স্থান থেকে আনা গরু, মহিষ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেয়। আরিচা ঘাটের ভাই ভাই ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির মালিক সেন্টু মিয়া জানান, কোরবানির জন্য সেভাবে এখনও পশু আরিচা ঘাটে আসছে না। আরও এক সপ্তাহ পরে সীমান্তবর্তী জেলা থেকে গরু, মহিষ আসবে কোরবানির জন্য। বর্তমানে আরিচা ঘাট ও পাটুরিয়া ফেরি ঘাট দিয়ে গড়ে ৫০ ট্রাক পশু পার হচ্ছে। কোরবানির ঈদের এক সপ্তাহ আগে এ দুই ঘাট দিয়ে গড়ে ৩ থেকে ৪০০ ট্রাক পশু পার হবে। মানিকগঞ্জ প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের অফিস সহকারী আফতাব আলী জানান, গতবারের চেয়ে এবার জেলায় ২০ ভাগ কোরবানির পশু পালন বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রতিটি খামার তাদের নজরদারিতে রয়েছে। এখন কেউ পশুকে স্টেরোয়েড জাতীয় ওষুধ খাওয়ান না। প্রতিটি পশুকে ভিটামিন ও রোগ প্রতিশোধক টিকা দেয়া হয়েছে। মানিকগঞ্জে মূলত দেশীয় ক্রস গরু পালন করেন খামারিরা। এসব গরু রোগবালাইমুক্ত বলে তিনি জানান।
শিবালয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রকিবুজ্জামান জানান, মানিকগঞ্জের সীমানায় ঘেঁষা রাজবাড়ী, পাবনা এবং সিরাজগঞ্জ জেলার সংঘবন্ধ ডাকাত দল আছে। এরাই নদীপথে মানিকগঞ্জের চরাঞ্চলে এসে গরু ডাকাতি করে। তবে তিনি দাবি করেন, শিবালয় পুলিশ নৌপথে নিয়মিত টহল দিচ্ছে। এ ছাড়া চরাঞ্চলে কমিউনিটি পুলিশের ব্যবস্থা রয়েছে।
সংবাদ শিরোনাম
চরাঞ্চল থেকে ৩০,০০০ গরু যাচ্ছে হাটে
- Reporter Name
- আপডেট টাইম : ১২:৫৪:১১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫
- ৩০৮ বার
Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ