ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীতে প্রস্তুত হয়েছে ১৭টি কোরবানির হাট। এর মধ্যে অন্যতম দেশের সর্ববৃহৎ কোরবানির হাট গাবতলী হাট। জাল নোট শনাক্তকরণ, অজ্ঞান পার্টি ও চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য রোধ করাসহ ক্রেতা-বিক্রেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে হাট কর্তৃপক্ষ।
এখন অপেক্ষা কেবল হাটে কেনা-বেচা জমে ওঠার। তবে হাটে এখনও কেনা-বেচা তেমন শুরু না হলেও রবি-সোমবার নাগাদ হাট জমজমাট হয়ে উঠবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বৃহস্পতিবার গাবতলী হাট ঘুরে দেখা যায়, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কিছু বেশি গরু-মহিষ হাটে বিক্রির জন্য আনা হয়েছে। তবে পুরো দিনই হাট ছিল ক্রেতাশূন্য। ক্রেতা-বিক্রেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে হাটের সামনে র্যাব-৪ এর একটি অস্থায়ী ক্যাম্প বসানো হয়েছে। সেখানে র্যা্ব সদস্যরা দায়িত্ব পালনও শুরু করেছেন। অন্যদিকে পুলিশের একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। তবে এখনও পুলিশ সদস্যরা সেখানে অবস্থান নেননি।
এ বিষয়ে গাবতলী গবাদি পশুর হাটের পরিচালক রাকিব ইমরান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘কোরবানির বাজার এখনও শুরু হয়নি। এখানে ঈদের চারদিন আগে থেকে বাজার জমে ওঠে। কারণ পশু রাখা, খাবারের ব্যবস্থা, বিশ্রাম সব মিলিয়ে ঝামেলার কারণে অনেকে বাজার জমার একদিন আগে আসেন। ফলে ব্যবসায়ীরা এখনও তেমন পশু নিয়ে আসা শুরু করেননি। আশা করছি, রবি-সোমবার বাজার জমে ওঠবে।’
হাটের নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আসলে এ হাটে বছরের ৩৬৫ দিনই ২৪ ঘণ্টা পশু কেনা-বেচা চলে। তবে ঈদের কারণে আমরা এক মাস আগে থেকেই নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজ শুরু করেছি। একটু আগেই র্যাবের সাথে কথা বলেছি, পুলিশের সাথেও কথা বলবো। তাদের অস্থায়ী ক্যাম্প থাকবে হাটের সামনে।’
হাটের পরিচালক আরও বলেন, ‘চাঁদাবাজি, অজ্ঞান পার্টি ও জাল নোট প্রতিরোধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জাল টাকা শনাক্তকরণের জন্য ১০টি কাউন্টারে দুটি করে ২০টি মেশিন বসানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোও জাল টাকা শনাক্তকরণ মেশিন বসাবে। হাটের উপরে ২০টি ওয়াচ টাওয়ার থাকবে। পুলিশ-র্যাবের পাশাপাশি আমাদের ৪৫০ জন কর্মী ডিএমপির টি-শার্ট পরে ডিউটি করবেন।’
‘এ ছাড়া সরকারি রেট অনুযায়ী শতকরা ৫ শতাংশ হারে হাসিল আদায় করা হবে’, বলেন তিনি।
অব্যবস্থাপনায় হাটে জনভোগান্তি
দেশের সর্ববৃহৎ গবাদি পশুর এ হাটে কোরবানির ঈদে ক্রেতা-বিক্রেতার ঢল নামে। তবে যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে দেশের নানাপ্রান্ত থেকে আসা সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়েন।
হাটের প্রবেশ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, হাট সংলগ্ন গাবতলীর প্রধান সড়কের ঢালুতে গো-বর্জ্য ফেলা হয়। দিনের পর দিন পরে থাকা এসব বর্জ্য অপসারণ না করায় ছোট পাহাড় আকৃতি হয়ে উঠেছে গো-বর্জ্যের স্তূপ।
গো-বর্জ্যের পাশাপাশি পঁচে যাওয়া খড়ও ফেলা হয় প্রধান সড়ক সংলগ্ন খালি জায়গায়। এসব বর্জ্যের দুর্গন্ধে ভোগান্তির শিকার হন যাতায়াতকারীরা। অন্যদিকে এসব গো-বর্জ্য ও পঁচে যাওয়া খড় চুইয়ে আসা পানিতে সবসময়ই স্যাঁতসেঁতে কর্দমাক্ত থাকে হাট সংলগ্ন কাঁচা রাস্তাটি। বড় বড় গর্ত ছাড়া উন্মুক্ত ড্রেনেজের কারণে ব্যস্ত রাস্তাটিতে চলাচল করাও ঝুঁকিপূর্ণ।
হাটের অভ্যন্তরে ঘুরে দেখা যায়, তুলনামূলক কম পশু থাকলেও যত্রতত্র গো-বর্জ্য ও গো-মূত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ফলে নোংরা, কর্দমাক্ত পথে হেঁটেই পশু দেখতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
বৃহস্পতিবার দুপুরে হাটের ভিতরে বড় গর্ত বালু দিয়ে ভরাট করছিলেন দুই শ্রমিক। জিজ্ঞেস করতেই তারা জানালেন, তারা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বা হাট কর্তৃপক্ষের কেউ নন। হাটের ব্যবসায়ীদের ডাকে কাজে এসেছেন।
পাশে থাকা নোয়াখালীর ব্যবসায়ী আফসার আলী বলেন, কিছু কিছু জায়গায় হাটের অবস্থা করুণ। কর্তৃপক্ষ তো আর এসব ঠিক করেনি। তাই আমরা নিজেরা টাকা দিয়ে কাজ করাচ্ছি।
সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি বৃহৎ এ হাটের গো-বর্জ্য পরিষ্কারের দায়িত্ব পেয়েছে একটি সার কোম্পানি। এর অধীনে ১৪ জন শ্রমিক গো-বর্জ্য অপসারণ করেন। হাটে গো-বর্জ্য অপসারণ করতে আসা এক শ্রমিক ফাতেমা বেগম বলেন, এতবড় হাটে ১৪ জন শ্রমিক কিছুই না। কিন্তু যা করার আমাদেরই করতে হয়। সিটি করপোরেশনের কেউ কাজ করে না।
এসব বিষয়ে কথা বলতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হকের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলে তিনি রিসিভ করেননি।
বর্জ্য অপসারণের বিষয়ে গাবতলী গবাদি পশুর হাটের পরিচালক রাকিব ইমরান দ্য রিপোর্টকে বলেন, এখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। কারণ ছোট জায়গায় একই সাথে টার্মিনাল ও হাট রয়েছে। ঈদের পরদিন সকাল থেকেই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বর্জ্য অপসারণ কাজ শুরু করে।
ঘোষণা আছে, বাস্তবায়ন নেই
ঢাকা মহানগর পুলিশ মঙ্গলবার ঈদ উপলক্ষে আয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক এক সভায় ১৯ সেপ্টেম্বরের আগে ঢাকায় কোরবানির পশু প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু গাবতলী হাট ঘুরে দেখা যায়, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে কোরবানির পশু এসেছে।
ক্রেতা নেই, সেলফি ক্লিকার আছে
বৃহস্পতিবার পুরো গাবতলী হাটই ছিল ক্রেতাশূন্য। ফলে হাটে আসা বিক্রেতাদের দিনটি কেটেছে অলসই। কোনো বিক্রেতাকে দেখা গেছে হাটেই মাচাং বানিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। কেউ চায়ের দোকানে পায়চারি করছেন। কয়েকজন আবার গরুর পিঠে রং দিয়ে নাম্বার লিখে দিচ্ছেন, কেউ নিচ্ছেন পশুর অতিরিক্ত যত্ন।
তবে বিক্রেতাদের ব্যস্ততা না থাকলেও হাটে ব্যস্ততা ছিল সেলফি ক্লিকারদের। পুরো হাটেই বড় গরুর পাশে দাঁড়িয়ে অনেকের সেলফি তোলার দৃশ্য চোখে পড়েছে।
হাটে সেলফি তোলায় ব্যস্ত এক স্কুলশিক্ষার্থী আসলাম সানী বলেন, ঈদ না হলে বড় গরু চোখে পড়ে না। আর কয়দিন পর হাট জমলে বাবা আসতে দিবে না। তাই ছবি তুলে রাখছি।
ভারতীয় গরু নিয়ে কৃষক-ক্রেতা-ব্যবসায়ী ভিন্নমত
গবাদি পশু কম থাকার কারণে দাম বেশি হওয়ায় হাটের এখন প্রধান আলোচনার বিষয় ‘ভারতীয় গরু’। এ বিতর্কে ক্রেতা ও ব্যবসায়ীর সুর অভিন্ন হলেও কৃষকের সুর তার বিপরীত।
হাটে গরু দেখতে আসা শ্যামলীর ক্রেতা বাদল মিয়া বলেন, বাজারে তেমন বড় কোনো গরু চোখে পড়েনি। আর যে গরুর দাম হবে ৫০ হাজার, তা এখন ৭০ হাজার টাকায় কিনতে হবে। ভারত থেকে গরু আসলে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত লোকজন কম টাকায় ভাল কোরবানি দিতে পারবেন।
একই সুরে রাজবাড়ীর পাংশার গরু ব্যবসায়ী হোসেন মিয়া বলেন, বাজারে গরু বেশি থাকলে চারটা দেখে ভাল দেখে একটি কিনতে পারবেন ক্রেতারা। কোরবানি বেশি হবে। আমাদেরও কিছু লাভ হবে। কিন্তু ভারত থেকে গরু না আসলে কৃষকের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে গরু কিনতে হবে। পরে দেখা যাবে তা বিক্রি করতে পারছি না।
তবে ভিন্নমত পোষণ করে ফরিদপুরের কৃষক রমজান আলী বলেন, সারাবছর কষ্ট করে গরু পালি কোরবানির আশায়। কিন্তু ভারত থেকে গরু আসলে দাম কমে যায়। আমাদের খরচই ওঠে না। ভারত থেকে গরু না আসলে কৃষক গরু পালতে উৎসাহিত হবেন। তা না হলে একসময় কৃষক গরু পালবেন না। তখন কোরবানির জন্য ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে তথ্যমতে এবার কোরবানির জন্য দেশে ১০ লাখ পশু কম রয়েছে। কারণ, দেশে কোরবানিযোগ্য প্রায় ৪০ লাখ গরু ও মহিষের বিপরীতে চাহিদা রয়েছে প্রায় ৫০ লাখের।
এক গরু নিয়ে কুষ্টিয়া থেকে ঢাকা
কুষ্টিয়া সদর থেকে মাত্র একটি গরু নিয়ে গাবতলী হাটে এসেছেন রমিজ মিয়া। কুষ্টিয়ায় বাজার থাকার পরও ঢাকায় আসার ব্যাপারে পঞ্চাশোর্ধ্ব এ কৃষক বলেন, লাভ-লোকসানের জন্য এতদূর আসিনি। গরু নিয়ে হাটে যাওয়া আনন্দের। গতবছর তিন গরু নিয়ে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম।
এদিকে, যানবাহন খরচের কারণে কোরবানির পশুর দাম বাড়ে বলে জানালেন বিক্রেতা ও ট্রাক চালকরা।
কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় একটি ট্রাকে ১২টি গরু আনতে ২২ হাজার টাকা গুণতে হয় বলে জানান রমিজ মিয়া। এসব খরচ যোগ করেই কৃষকরা দাম চান বলেও জানান তিনি।
নোয়াখালীর ট্রাক চালক কবির বলেন, গাবতলী হাট থেকে গরু নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন হাটসহ নোয়াখালী, ফেনীতে যেতে হয়। দেখা যায়, নোয়াখালী গেলাম ১০টি গরু নিয়ে। আমাকে ২৫ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। ফলে গরুর দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।
লাভের আনন্দ আছে, লোকসানের ভয় নেই
গাবতলী হাটে গবাদিপশু নিয়ে আসা কৃষক ও ব্যবসায়ীরা লাভ-লোকসানের দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন। কিন্তু কোরবানির হাটে বাড়তি লাভের আনন্দে আছেন খড়, রশি, মালা, ঘাস বিক্রেতা ও হোটেল মালিকরা। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় চাহিদা বাড়ায় লোকসানের কোনো ভয় নেই তাদের।
হাটের চারপাশ ঘুরে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, স্বাভাবিক সময়ে যে খড়ের আটি সাড়ে তিন টাকা বিক্রি হতো তা এখন চার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া ৮০ টাকা আটির খড় এখন বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। ভিড় বেড়েছে খাবার হোটেল ও মালা-রশির দোকানেও।