বেড়ার টিনশেড ঘর। দুটি কক্ষ। দরজা জানালা খোলা। ভেতরে কয়েকটি চেয়ার টেবিল ছড়ানো-ছিটানো। বেড়ার অংশ বিশেষ উধাও হয়ে গেছে। বেড়ার সঙ্গে টাঙ্গানো ব্ল্যাকবোর্ড। তাও ক্ষতবিক্ষত। ঘরটির পাশেই পাকা টয়লেট। কিন্তু দরজা নেই। ভেতরে টয়লেটের কোন চিহ্নও নেই। কমোডের জায়গায় সবুজ ঘাস।
ভাবছেন কোন পরিত্যক্ত ঘরের বর্ণনা দিয়েছি। না এটি একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। নাম কংলাকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর অবস্থান রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন সাজেকে। সবোর্চ্চ পর্বত চূড়ায় হওয়ায় এ ইউনিয়নকে রাঙ্গামাটি জেলার ছাদও বলা হয়। সমতল থেকে প্রায় ১৮’শ ফুট উপরে বিদ্যালয়টির অবস্থান।
সাজেক ইউনিয়নের রুইলুই পাড়া, কংলাক পাংখোয়া পাড়া, কংলাক ত্রিপুরা পাড়া, হাইস্কুল পাড়া মিলে এখানে রয়েছে একটি মাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। রুইলুই পাড়ায় একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। তবে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতে হলে ৩৪ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে শিক্ষার্থীদের যেতে হয় বাঘাইহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা। কংলাকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি শূন্য। আশপাশেও শিক্ষার্থীদের কোন আনাগোনা নেই। বিদ্যালয় বলতে বেড়ায় মোড়ানো দুইটি টিনশেড কক্ষ। কক্ষের চারপাশের কয়েকটি অংশের বেড়াও উধাও হয়ে গেছে। কক্ষের ভেতরে কয়েকটি টেবিল চেয়ার ছড়ানো-ছিটানো। এটি যে বিদ্যালয় তা কেউ না বললে বুঝার জো নেই। তবে বিদ্যালয়ের সাক্ষ্য বহন করছে একটি কক্ষে বেড়ার সঙ্গে টাঙানো ক্ষত বিক্ষত একমাত্র ব্ল্যাকবোর্ডটি।
বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষককে খুঁজতে গিয়ে স্থানীয় লোকজন দেখিয়ে দিলেন সাংপুই রোজমেরী লুসাইয়ের ডেরাটি। সাংপুই বিদ্যালয়টির একমাত্র সহকারি শিক্ষক। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বও তিনি পালন করছেন।
সাংপুই রোজমেরী লুসাই বাংলানিউজকে বলেন,‘বিদ্যালয়টি ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত। বৃষ্টিতে স্কুলে ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয় না। সড়ক নির্মাণ হওয়ার পর থেকে কর্মকর্তারা মাঝে মাঝে পরিদর্শনে আসেন। তারা আশ্বাস দেন। কিন্তু বিদ্যালয় আর পাকা হয় না।’
জানা গেছে, বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪৭ জন। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণীতে ১২ জন, ২য় শ্রেণীতে ৯ জন, ৩য় শ্রেণীতে ১৩ জন, ৪র্থ শ্রেণীতে ৯ জন ও ৫ম শ্রেণীতে ৪ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।
২০১৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনি পরীক্ষায় একজন মাত্র শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাশ করেছেন। প্রতিদিন শিক্ষার্থী উপস্থিত হন ১০-১৫জন। জুম চাষের সময় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি থাকে না বললেই চলে। মা-বাবার সঙ্গে জুম আবাদে চলে যান শিশুরাও।
শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট করতে নেই কোন সরকারি উদ্যোগ। ৪৭ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে উপবৃত্তি পান শুধুমাত্র ১৭ জন শিক্ষার্থী।
অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি প্রণীত দারিদ্র ম্যাপ অনুযায়ী যে সকল উপজেলায় দারিদ্র্যের হার ৬০ শতাংশের বেশি এমন উপজেলায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পাওয়ার কথা।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ ও পুষ্টিমান বৃদ্ধির জন্য প্রতি স্কুল দিবসে ৭৫ গ্রাম হারে পুষ্টিমানসম্পন্ন বিস্কুট সরবরাহের কার্যক্রম চালু রয়েছে। কিন্তু দারিদ্রপীড়িত ও দুর্গম এ এলাকায় এ ধরণের কোন কর্মসূচি নেই সংশ্লিষ্ট বিভাগের।
সাংপুই রোজমেরী লুসাই বাংলানিউজকে বলেন,‘স্কুলে যত সংখ্যক শিক্ষার্থী আসে তার চেয়ে বিদ্যালয় গমনোপযোগী শিশুর সংখ্যা এ এলাকায় আরও বেশি আছে। কিন্তু অভিভাবকরা শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে চান না। দারিদ্রতার কারণে তারা শিশুদের দিয়ে কাজ করাতেই বেশি ভালোবাসেন।’
তিনি বলেন,‘এমনিতে অভিভাবকরা অসচেতন এবং অশিক্ষিত। দুই থেকে তিনজন অভিভাবক হয়তো স্বাক্ষর করতে পারবেন। সুতরাং শিশুদের জন্য স্কুলই ভরসা। কিন্তু শিক্ষার্থীদের স্কুলের প্রতি আকৃষ্ট করতে তেমন কোন কর্মসূচি আমাদের নেই।’
সাংপুই বলেন,‘এখানে একমাত্র শিক্ষক হিসেবে আমি দায়িত্বপালন করছি। কোন কাজে গ্রামের বাইরে গেলে স্কুল বন্ধ থাকে। অনেকবার বলেছি আরও শিক্ষক নিয়োগ দিতে। কিন্তু এখানে কেউ আসতে চান না।’
বাঘাইছড়ি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা(ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন,‘কংলাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির আসলেই দূরাবস্থা। বিদ্যালয়টি নির্মাণের জন্য টেন্ডার হয়েছে। আশা করছি শিগগির নির্মাণ কাজ শুরু হবে।’
তিনি বলেন,‘৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পাওয়ার কথা। কেন পাচ্ছে না তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মিড ডে মিল স্থানীয় পরিবারগুলোর সহায়তায় চালু করা হয়। কিন্তু সেখানকার পরিবারগুলো যথেষ্ট স্বাবলম্বী নয়। এছাড়া শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগ চেয়ে একাধিকবার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছে। কিন্তু এখনো কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ’