মাঠের রাজনীতিতে বিএনপির কর্মকাণ্ড অপরাপর দুর্বল হয়ে পড়ায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মধ্যেও অস্বস্তি বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগের কেউ কেউ মনে করছেন, বিএনপি মূলধারার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়লে সেখানে তৃতীয় কোনো শক্তি জায়গা করে নিতে পারে, যা জাতিকে অনিশ্চয়তায় ফেলতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, ‘সংসদ এবং সংসদের বাইরে কার্যকর বিরোধীদল থাকলে গণতান্ত্রিক রাজনীতি আরো শক্তিশালী হয়, যা বিএনপির দুর্বলতায় কিছুটা হলেও শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। এই শূন্যতা রাজনীতিতে অশনিসংকেত।’
সরকারের কৌশলী অবস্থান আর নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে বিএনপির রাজনীতি ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ছে। বিশেষত সিদ্ধান্তহীনতার রাজনীতি, দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড (তারেক রহমান) দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকা, সর্বোচ্চ নেতাসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের মামলার জালে আটকে পড়া, কয়েক দফা আন্দোলন করে ফলাফল না পাওয়া, সরকার পতন আন্দোলনে ভারতের সমর্থন না পাওয়া, দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের ধারাবাহিক কারাবরণ আর তৃণমূল নেতাদের মাঝে হতাশা কাজ করায় বিএনপির রাজনীতি এখন সবচেয়ে নাজুক মনে করা হচ্ছে।
রাজনীতির এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে বিএনপির সামনে আপাতত কোনো পথও খোলা নেই বলে ধারণা করা হচ্ছে। নেতাকর্মীরা বিভিন্ন সময়ে সরকার পতনের আন্দোলনের হুমকি দিয়ে আসলেও রাজপথে দাঁড়াতেই পারছে না দলটি।
রাজনীতির মাঠে বিএনপির দুর্বলতার আরেকটি অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির শক্তির ওপর নির্ভরতা। এতে সুবিধা বেশি ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছে জামায়াতই।
যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে টানাপোড়ান সৃষ্টি হওয়ার পর আন্দোলনের নামে বিএনপিকে আর সুবিধা দিতে চাইছে না জামায়াত-শিবির। বিএনপির দুর্বলতা নিজেদের বিশেষ সুবিধা বলেও মনে করছে জামায়াতের নীতি-নির্ধারকরা।
জামায়াতের একটি সূত্রের দাবি, বিগত আন্দোলনে জামায়াত যে শক্তি দেখিয়েছে, তা জনমনে সাড়া পড়েছে, যার প্রভাব উপজেলা নির্বাচনেও পড়ে। সরকারের মারমুখি অবস্থানের পরেও ওই নির্বাচনে জামায়াতের ইতিবাচক ফলাফল সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এ কারণেই হিসেব কষে রাজনীতির মাঠে পা ফেলতে হচ্ছে জামায়াতকে।
রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৭৮ সালে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠনের পর বর্তমান সময়ে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। ১৯৮১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হলে দলটি রাজনীতিতে বড় ধরনের হোঁচট খায়। দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসক এরশাদকে হঠিয়ে ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এলে মূলধারার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে বিএনপি।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তিনবার ক্ষমতায় এলেও ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেয়ার পরই দলের মধ্যে বিপর্যয় নেমে আসে। ভাঙনের পাশাপাশি ওই সময় দুর্নীতির অভিযোগে দলের চেয়ারম্যান, কো-চেয়ারম্যানসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই গ্রেফতার হন। বিশেষ মুচলেকা দিয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যান দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা তারেক রহমান, যিনি এখন পর্যন্ত দেশে ফিরতে পারেননি।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে টানা আন্দোলন করলেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকে ক্ষমতায় আসা ঠেকাতে পারেনি বিএনপি। চলতি বছরের শুরু থেকে সরকার পতনের জন্য টানা ৯২ দিন আন্দোলন করেও কোনো ফল পায়নি দলটি।
বিএনপির এমন দুর্বলতায় রাজনীতিতে চাপা অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। বিএনপি মূলধারার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়লে জামায়াতে ইসলামি বা ডানপন্থি কোনো উগ্রবাদী সংগঠন বিশেষ সুবিধা নিতে পারে বলে আওয়ামী লীগের কেউ কেউ মনে করছেন।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘বিএনপি তার নিজের ভুলের কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে। একটি সংগঠন দুর্বল হলে সেই জায়গায় আরেকটি সংগঠন শক্তিশালী হবে এটাই স্বাভাবিক। ভাবনার বিষয় হচ্ছে, কোন শক্তি সেখানে গুরুত্ব পায়?’
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই (আওয়ামী লীগ) বিএনপি তাদের নিজেদের ভুল সংশোধন করে রাজনীতিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করুক। বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করেই তারা মূলধারার রাজনীতিতে ফিরে আসুক।’
তবে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘কোনো উগ্রবাদী শক্তির ঠাঁই বাংলাদেশে হবে না। সময় পাল্টে গেছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেই রাজনীতি করতে হবে।’