ঢাকা ০৫:১৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫, ১ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম

নারীদের ধানের মাঠে কাজের ব্যস্ততা ওঁরাওদের দিনবদলের স্বপ্ন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৪:৫৫:৪৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৮
  • ৪৮৬ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ এখন বুরো ধান চাষের মৌসুম চলছে। কৃষকের মাঠের ব্যস্ততা বেড়ে দ্বি-গুণ হয়েছে। ধান রোপনের পর মাঠের আগাছা দমনে ব্যস্ত সকল কৃষক। সড়ক ধরে চলার মাঝে চোখের দৃষ্টিতে আটকে যাবে দলবেঁধে নারীদের ধানের মাঠে কাজের ব্যস্ততার চিত্র। এরা অদিবাসী ওঁরাও সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। কঠোর পরিশ্রমী। পুরুষের সাথে সমানতালে তারা মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। কাজের ব্যস্ততার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে তাদের দিনবদলের স্বপ্ন।

ওঁরাও সম্প্রদায়ের শতাধিক পরিবারের বাস গাজীপুরের শ্রীপুরে। একটা সময় ছিল সময়ের সাথে টিকে থাকতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে তাদের। তবে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতায় তাদের ভাগ্য সহায় ছিল না। বিভিন্ন কারণে দিনদিন তাদের সংখ্যা কমে যাওয়ার পরও  এখনও যারা টিকে আছে-তারা দিনবদলের স্বপ্নে বিভোর। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বেড়েছে।

ওঁরাও দক্ষিণ এশিয়ার একটি বড় উপজাতি। ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্য, ছত্রিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশ্যা ও পশ্চিমবঙ্গে এদের বাস। ভারতের বাইরে বাংলাদেশেও রয়েছে এদের বাস। তারা কুরুখ ভাষায় কথা বলেন, অনেক জায়গায় এদের কুরুখ জাতি বলা হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে উত্তরবঙ্গে ওঁরাওদের বসবাস। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুয়ায়ী বাংলাদেশে ওঁরাওদের বসবাস ছিল প্রায় ছয় হাজার।

গাজীপুরের শ্রীপুরে ব্রিটিশ শাসনামল থেকে চলছে ওঁরাওদের বসবাস। উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের টেংরা গ্রামে ১২টি পরিবারে ৬৮ জন, রাজাবাড়ি ইউনিয়নের বিন্দুবাড়ি গ্রামে ২৫ পরিবারে ১১৮ জন বসবাস করছেন। সনাতন ধর্ম পালনকারী ওঁরাওরা দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে শ্রীপুরে তাদের জনসংখ্যা হাজারের কাছাকাছি থাকলেও অভাব-অনটনের সাথে টিকতে না পেরে অনেকেই ভারত চলে গেছেন। আবার অনেকেই ধর্মান্তরিত হয়ে অন্য ধর্মগ্রহণ করেছেন। এভাবে শুধু তাদের সংখ্যা দিনদিন কমে গেছে।

অতীতে বিশেষভাবে ওঁরাও নারীরা নিগৃহিত থাকলেও এখন সব কাজে ওঁরাও নারীদের এগিয়ে যাওয়া লক্ষ্যণীয়। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছেন।

বিন্দুবাড়ি গ্রামের শতবর্ষী লালমোহন দেওয়ানি জানান, তাদের পূর্বপুরুষের বসতি ভারতের নাগপুরে। ব্রিটিশরা বাংলাদেশে রেলপথ তৈরি করার উদ্দ্যেশে তাদের কাজ করাতেন। সিই সূত্র ধরেই তারা বাংলাদেশে এসে বসতি স্থাপন করেন। তাদের পূর্বপুরুষরা মূলত রেলপথের মাটি কাটার কাজ করতেন। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এখন তারা কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

একই গ্রামের বকুল ওরাং জানান, একটা সময় ছিল তারা নানাভাবে কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন আর তাদের সেসব কষ্ট নেই। এখন তাদের পাশাপাশি নারীরাও মাঠে কাজ করেন। বর্তমানে তারা ভালই আছেন।

টেংরা গ্রামের কুসুমতারা জানান, নারী বলে আগে তাদের কেউ কাজে নিত না। এখন সকলের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে। ওঁরাও নারীরা কাজে ফাঁকি না দেয়ার কারণে এখন তাদের কদরও বেড়েছে। পুরুষদের পাশাপাশি তারা মাঠে কৃষিকাজ করেন। এখন স্বামী সন্তান নিয়ে আগের চেয়ে ভালোই আছেন।

নিরালা একট্টা জানান, ওঁরাওরা খুবই পরিশ্রমী। এখানে অলসতার কোন স্থান নেই। সংসারের সবাই কাজ করেন। তাদের ছেলেমেয়েরা এখন বিদ্যালয়ে যায়। তারাও পড়ালেখার ফাঁকে বাবা ও মায়েদের সাহায্য করেন।তার তিন সন্তান এখন বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছেন।

ঢাকার নটরডেম কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ালেখা করছেন মিঠুন একট্রা- তিনি জানান, ওঁরাওরা এখন লেখাপড়া করে বিভিন্ন কুসংস্কার ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই ভবিষ্যতে পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরি করার ইচ্ছা তার।

বিন্দুবাড়ি গ্রামের সবুজমনি জানান, তাদের এলাকায় সবাই হতদরিদ্র। তার নিজেরসহ আরো আটজন মহিলা বিধবা হলেও এখন পর্যন্ত বিধবা ভাতার ব্যবস্থা হয়নি। তার আশা- সরকার তাদের উন্নয়নে দৃষ্টি আরো বৃদ্ধি করবে।

রাজাবাড়ি ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড সদস্য মিজানুর রহমান নিহার জানান, এক সময় পুরো বিন্দুবাড়ি এলাকাটি ওঁরাওদের বসবাস ছিল। তবে নানা কারণে তাদের সংখ্যা কমছে। এখন যারা টিকে আছে, তারা মাঠে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করছে। ওঁরাওরা এখন দিনবদলের স্বপ্ন দেখছেন।

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মঞ্জুরুল হক জানান, ইতোমধ্যেই অনেককে সরকারের সামাজিক উপকারভোগীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সমাজে তাদের প্রতিষ্ঠিত করতে নানা ধরনের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে আশার কথা- ওঁরাও নারীরা এখন দিনদিন সাবলম্বী হচ্ছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেহেনা আকতার জানান, সরকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এরই ধারাবহিতায় শ্রীপুরে ওঁরাও সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে সরকারি সকল সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। অতীতের তুলনায় তারা এখন ভাল আছেন। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ওঁরাও নারীদের এগিয়ে যাওয়া সত্যিই প্রশংসনীয়।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

ক্যাটরিনার হাতে ২০ বার থাপ্পড় খেয়েছিলেন ইমরান খান

নারীদের ধানের মাঠে কাজের ব্যস্ততা ওঁরাওদের দিনবদলের স্বপ্ন

আপডেট টাইম : ০৪:৫৫:৪৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৮

হাওর বার্তা ডেস্কঃ এখন বুরো ধান চাষের মৌসুম চলছে। কৃষকের মাঠের ব্যস্ততা বেড়ে দ্বি-গুণ হয়েছে। ধান রোপনের পর মাঠের আগাছা দমনে ব্যস্ত সকল কৃষক। সড়ক ধরে চলার মাঝে চোখের দৃষ্টিতে আটকে যাবে দলবেঁধে নারীদের ধানের মাঠে কাজের ব্যস্ততার চিত্র। এরা অদিবাসী ওঁরাও সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। কঠোর পরিশ্রমী। পুরুষের সাথে সমানতালে তারা মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। কাজের ব্যস্ততার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে তাদের দিনবদলের স্বপ্ন।

ওঁরাও সম্প্রদায়ের শতাধিক পরিবারের বাস গাজীপুরের শ্রীপুরে। একটা সময় ছিল সময়ের সাথে টিকে থাকতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে তাদের। তবে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতায় তাদের ভাগ্য সহায় ছিল না। বিভিন্ন কারণে দিনদিন তাদের সংখ্যা কমে যাওয়ার পরও  এখনও যারা টিকে আছে-তারা দিনবদলের স্বপ্নে বিভোর। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বেড়েছে।

ওঁরাও দক্ষিণ এশিয়ার একটি বড় উপজাতি। ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্য, ছত্রিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশ্যা ও পশ্চিমবঙ্গে এদের বাস। ভারতের বাইরে বাংলাদেশেও রয়েছে এদের বাস। তারা কুরুখ ভাষায় কথা বলেন, অনেক জায়গায় এদের কুরুখ জাতি বলা হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে উত্তরবঙ্গে ওঁরাওদের বসবাস। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুয়ায়ী বাংলাদেশে ওঁরাওদের বসবাস ছিল প্রায় ছয় হাজার।

গাজীপুরের শ্রীপুরে ব্রিটিশ শাসনামল থেকে চলছে ওঁরাওদের বসবাস। উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের টেংরা গ্রামে ১২টি পরিবারে ৬৮ জন, রাজাবাড়ি ইউনিয়নের বিন্দুবাড়ি গ্রামে ২৫ পরিবারে ১১৮ জন বসবাস করছেন। সনাতন ধর্ম পালনকারী ওঁরাওরা দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে শ্রীপুরে তাদের জনসংখ্যা হাজারের কাছাকাছি থাকলেও অভাব-অনটনের সাথে টিকতে না পেরে অনেকেই ভারত চলে গেছেন। আবার অনেকেই ধর্মান্তরিত হয়ে অন্য ধর্মগ্রহণ করেছেন। এভাবে শুধু তাদের সংখ্যা দিনদিন কমে গেছে।

অতীতে বিশেষভাবে ওঁরাও নারীরা নিগৃহিত থাকলেও এখন সব কাজে ওঁরাও নারীদের এগিয়ে যাওয়া লক্ষ্যণীয়। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছেন।

বিন্দুবাড়ি গ্রামের শতবর্ষী লালমোহন দেওয়ানি জানান, তাদের পূর্বপুরুষের বসতি ভারতের নাগপুরে। ব্রিটিশরা বাংলাদেশে রেলপথ তৈরি করার উদ্দ্যেশে তাদের কাজ করাতেন। সিই সূত্র ধরেই তারা বাংলাদেশে এসে বসতি স্থাপন করেন। তাদের পূর্বপুরুষরা মূলত রেলপথের মাটি কাটার কাজ করতেন। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এখন তারা কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

একই গ্রামের বকুল ওরাং জানান, একটা সময় ছিল তারা নানাভাবে কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন আর তাদের সেসব কষ্ট নেই। এখন তাদের পাশাপাশি নারীরাও মাঠে কাজ করেন। বর্তমানে তারা ভালই আছেন।

টেংরা গ্রামের কুসুমতারা জানান, নারী বলে আগে তাদের কেউ কাজে নিত না। এখন সকলের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে। ওঁরাও নারীরা কাজে ফাঁকি না দেয়ার কারণে এখন তাদের কদরও বেড়েছে। পুরুষদের পাশাপাশি তারা মাঠে কৃষিকাজ করেন। এখন স্বামী সন্তান নিয়ে আগের চেয়ে ভালোই আছেন।

নিরালা একট্টা জানান, ওঁরাওরা খুবই পরিশ্রমী। এখানে অলসতার কোন স্থান নেই। সংসারের সবাই কাজ করেন। তাদের ছেলেমেয়েরা এখন বিদ্যালয়ে যায়। তারাও পড়ালেখার ফাঁকে বাবা ও মায়েদের সাহায্য করেন।তার তিন সন্তান এখন বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছেন।

ঢাকার নটরডেম কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ালেখা করছেন মিঠুন একট্রা- তিনি জানান, ওঁরাওরা এখন লেখাপড়া করে বিভিন্ন কুসংস্কার ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই ভবিষ্যতে পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরি করার ইচ্ছা তার।

বিন্দুবাড়ি গ্রামের সবুজমনি জানান, তাদের এলাকায় সবাই হতদরিদ্র। তার নিজেরসহ আরো আটজন মহিলা বিধবা হলেও এখন পর্যন্ত বিধবা ভাতার ব্যবস্থা হয়নি। তার আশা- সরকার তাদের উন্নয়নে দৃষ্টি আরো বৃদ্ধি করবে।

রাজাবাড়ি ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড সদস্য মিজানুর রহমান নিহার জানান, এক সময় পুরো বিন্দুবাড়ি এলাকাটি ওঁরাওদের বসবাস ছিল। তবে নানা কারণে তাদের সংখ্যা কমছে। এখন যারা টিকে আছে, তারা মাঠে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করছে। ওঁরাওরা এখন দিনবদলের স্বপ্ন দেখছেন।

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মঞ্জুরুল হক জানান, ইতোমধ্যেই অনেককে সরকারের সামাজিক উপকারভোগীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সমাজে তাদের প্রতিষ্ঠিত করতে নানা ধরনের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে আশার কথা- ওঁরাও নারীরা এখন দিনদিন সাবলম্বী হচ্ছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেহেনা আকতার জানান, সরকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এরই ধারাবহিতায় শ্রীপুরে ওঁরাও সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে সরকারি সকল সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। অতীতের তুলনায় তারা এখন ভাল আছেন। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ওঁরাও নারীদের এগিয়ে যাওয়া সত্যিই প্রশংসনীয়।