হাওর বার্তা ডেস্কঃ আগাম বন্যায় ফসলহানি ঠেকাতে কিশোরগঞ্জের হাওরে প্রথম বারের মত বাঁধ নির্মান কাজ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। জেলার ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রামসহ মোট ৮টি উপজেলায় নির্মান করা হবে ২০০ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধ । ছয়শ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের অর্থায়ন করছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। পানি সড়তে দেরি হওয়ায় সময়মত কাজ শুরু করতে পারেনি কতৃপক্ষ। ঝুকিহীন আগামী বোরো ফসল ঘরে তোলা নিয়ে এবারো শংকায় কৃষকরা।
চলছে বোরো মৌসুম। গতবার অকাল বন্যায় জেলার প্রায় সব হাওরে কৃষকের ধান পানিতে তলিয়ে যায়। বিগত দিনে কৃষকরা নিজ নিজ উদ্যোগে ফসল রক্ষায় মাটি কেটে প্রতিবছর কিছু কিছু বাঁধ নির্মান করলেও সরকারী ভাবে বাঁধ নির্মানে তেমন কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। হাওরের একমাত্র বোরো ফসল রক্ষায় কিশোরগঞ্জে এবারই প্রথম বাঁধ নির্মানের কাজ হাতে নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আগাম বন্যা প্রতিরোধে খাল খনন, স্লুইস গেইট নির্মানসহ বিভিন্ন উন্নয়নমুলক কাজ শুরু করা হয়েছে বলে জানিয়েছে তারা। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)র অর্থায়নে হাওর এলাকার বন্যা ব্যবস্থাপনা ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন প্রকল্পর অধীনে এ জেলার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। জেলার ৮টি উপজেলায় মোট ৯টি হাওরে দুইশত কিশোমিটার কাচা বাঁধ নির্মাণ করা হবে। চার ফুট উচ্ছতা ও ২৫ থেকে ৩০ ফুট প্রস্ত হবে বাঁধগুলো। তাছাড়া ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মান করা হবে ২০টি স্লুইসগেইট।
মিঠাইন উপজেলার দক্ষিণের হাওরে যে ৩৩ কিলোমিটার বাঁধ তৈরী হচ্ছে তার সবটাই কৃষকদের জমির উপর দিয়ে।
জমি অধিগ্রণের কোন টাকা এখনো তাদেরকে পরিশোধ করা হয়নি। কোন কোন কৃষকের জমির সব অংশ ও কারও কারও অর্ধেক চলে যাচ্ছে বাঁধে । কাজ শেষ হওয়ার আগে জমির ক্ষতিপুরণ পাওয়ার নিশ্চয়তা চাইছেন কৃষকরা। তবে কতৃপক্ষ বলছে অধিগ্রহণের জন্য ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসকের সংশ্লষ্টি শাখায় ৪৫ কোটি টাকা জমা দেয়া হয়েছে। জরিপের মাধ্যেমে সময়মত ক্ষতিগ্রস্থদের টাকা পরিশোধ করা হবে।
মিঠামইন উপজেলার চারীগ্রামের কৃষক মোঃ নাজমুল হুদা জানান-গতবছর আগাম বর্ন্যায় আমরার সব জমি ভাসায়া লইয়া গেছে। এইবার হাওরে হাজার হাজার একর জমি পতিত পইড়া আছে। অহন একটা বান্দের (বাঁধ) কাম ধরছে। কেউ কয় তিন ফুট উচা অইবো কেউ কয় চাইর ফুট উচা অইবো। এমুন কম উচা বান্দে কোন কাম অইতো না। যদি আমলেই বান টিকাইতে চায় তাইলে ওয়াল দিয়া বান দিতে অইবো নইলে পানির স্রোতে সব আবার ভাইঙ্গা যাইবো।
একই গ্রামের খোকন মিয়া বলেন-আমরার সবার জমির উপরে দিয়া এই বেইরী বাধ হইতাসে। যে জমির উপরে দিয়া অইতাসি এইহানে গড়িবের জমিই বেশী অংশ। গতবছর আমরার যে মাইর গেছে এইবারও আমরা জমি ঠিক মত লাগাইতে পারছি না,অনেক জমি গেছেগা বান্দের ভিতরে। অনেকের পুরা জমিই বান্দের মধ্যে পইরা গেছে। জমি অধিগ্রহনের টেহা অহন পর্যন্ত আমরা পাইসি না। কবে পাইয়াম এইডাও কেউ কয় না।
কাচা বাঁধ তৈরী করে হাওরের বন্যা নিয়ন্ত্রন নিয়ে সংশয় রয়েছে স্থানীয়দের মাঝে। তারা জানিয়েছেন সিসি ব্লক দিয়ে বাঁধ তৈরী না করলে বাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে আবারো একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তাই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে প্রতিরক্ষা দেয়াল বা সিসি ব্লক দিয়ে আট থেকে দশ ফুট উচ্চতায় বাঁধ নির্মানের দাবী জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
ইটনা উপজেলার শিমুলবাগ গ্রামের কৃষক মোঃ রাসেল মিয়া জানান-গত বছর চৈত্র মাসের তের তারিখ আতকা পানি ঢুইক্কা আমরার ফসল সব নষ্ট কইরা দিসে। অনেক কষ্টের ফসল চোখোরে সামনে শেষ হইয়া গেছে। আমরার এলাকাত আগে কোনদিনই সরকার বান দিসে না। এইবার পয়লা বার বান্দ দিতাসে। কিন্তু যে উছা কইরা মাইট্টা বান দিতাসে এই বান থাকতো না। অন্তত আট ফুট উচা না করলে এই মাইট্টা বান্দ বানির নিচে থাকবো ,ভাইঙ্গা যাইবো। সিসি ব্লক ছাড়া এই বান্দ টিকতো না। অযথা খালি পয়সা খরচ কইরা লোক দেহানো বান্দ কইরা কি লাব অইবো ।
জাইকার প্রকল্প ছাড়াও ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে কাবিটা প্রকল্পের মাধ্যেমে বাজিতপুর উপজেলার হুমাইপুর ,অষ্টগ্রামের খয়েরপুর ও আবদুল্লাপুর হাওর এবং ইটনার বেড়া মোহনায় গত ১৫ ডিসেম্বর কাজ শুরু করে এ বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারীর মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও তা সময়মত শুরু হয়নি। পানি দেরীতে নামার কারন দেখিয়ে জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে কাজ শুরু করা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ বাস্তবায়ন নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, কিশোরগঞ্জ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম জানান-বিগত বন্যায় আগাম বন্যায় কিশোরগঞ্জে ব্যাপক ফসলহানি হয়েছে।
এর কারন হলো এ এলাকায় কখনোই কোন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ছিল না। বিগত বন্যার পর সরকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যেমে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। ইতি মধ্যে আমরা এ এলাকায় প্রায় দুইশত কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কাজ হাতে নিয়েছি যা চলমান আছে। এসব বাঁধের উচ্চতা বিশেষজ্ঞগণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নির্নয় করেছেন। আর বাঁধের স্থায়িত্বের ব্যাপরে জনগণের যে দাবী যে সিসি ব্লক দিয়ে করতে হবে । আমরা যথাযথ ভাবে মজবুত করেই এ বাঁধ বানাচ্ছি। সব জায়গায় সিসি ব্লক দিয়ে নির্মানের প্রয়োজন নেই ।
যে যে স্থানে ঢেউয়ের আঘাত বেশী সেই সব ঝুকিপুর্ণ ম্থানে আমরা সিসি ব্লকের প্রয়োজন হবে। ইতিমধ্যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে তারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। জমি অধিগ্রহনের জন্য ৪৫ কোটি টাকা আমরা সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা করে দিয়েছি। সময়মত ক্ষতিগ্রস্থরা তাদের জমির দাম পেয়ে যাবে। চলমান কাজগুলো বাস্তবায়নর হলে আগামীতে বড় কোন ঝুকিতে পড়বে না কৃষক।