হাওর বার্তা ডেস্কঃ শীত ও কুয়াশার দাপট থাকায় এবার কপাল পুড়তে শুরু করেছে রংপুর অঞ্চলের প্রান্তিক চাষিদের। একদিকে আলু বীজ, সার কীটনাশকের মূল্য বৃদ্ধি অন্যদিকে শীতে আলু গাছের গোড়া পঁচা রোগ, সব মিলিয়ে চিন্তায় ফেলেছে কৃষককে। দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানিয়ে কৃষকরা বলছেন, এখনই ব্যবস্থা না নিলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায়সহ এই রোগ মহামারি আকার ধারণ করতে পারে। এদিকে, আলু চাষে টার্গেট পূরণ করতে পারেনি কৃষি বিভাগ। এমনকি বিএডিসির আলু বীজের ৪০ শতাংশ বীজ অবিক্রীত আছে বলে জানিয়েছেন বিএডিসির কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম।
রংপুর আঞ্চলিক কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, এবার রংপুর অঞ্চলে আলু চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ হেক্টর জমি। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। আবাদ হয়েছে ৯৩ হাজার হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২০ লাখ ৬৯ হাজার ১০৬ মেট্রিক টন। এর মধ্যে রংপুরে ৫১ হাজার ২৭৫ হেক্টর, গাইবান্ধায় আট হাজার ৮৭ হেক্টর, কুড়িগ্রামে সাত হাজার ২৯১ হেক্টর, লালমনিরহাটে পাঁচ হাজার ৩৮৫ হেক্টর, নীলফামারীতে ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর। তাই পূরণ হবে কি না সেদিকেই অনিশ্চয়তা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হবার কারণ হিসেবে কৃষি বিভাগ বলছে, গেল বছর আলুর দাম কম হওয়ায়, কোল্ড স্টোরেজগুলোতে আলু অবিক্রীত থাকা, পুনরায় লোকসানের আশঙ্কা এবং অতি বন্যায় এবার টার্গেটও পূরণ হয়নি।
কৃষক এবং কৃষি বিভাগের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদনে খরচ হয় ৬৫ হাজার টাকার উপরে। এছাড়াও আছে কোল্ড স্টোরেজ ভাড়া। আর সম্ভাব্য আলু উৎপাদন হয় ২০ থেকে /২২ টন। সব মিলিয়ে উৎপাদন করতে যে খরচ হয় তা তুলতেই হিমশিম খেতে হয় কৃষককে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা গেছে, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে রংপুর অঞ্চলের আলু ক্ষেতে লেট ব্লাইট বা গোড়া পঁচারোগ ছড়িয়ে পড়েছে। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত রংপুর অঞ্চলে প্রায় ৫০ হেক্টর জমির আলু ক্ষেতে লেট ব্লাইট রোগ দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে রংপুর সদর, পীরগাছা, বদরগঞ্জ, কাউনিয়ায়, নীলফামারীর সদর, কিশোরগঞ্জ ও জলঢাকা ডোমার এলাকায় সবচেয়ে বেশি।
কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দুই একদিনের মধ্যে আবহাওয়ার উন্নতি না হলে তা মহামারি রূপে দেখা দিতে পারে। তারা এ রোগ দমনে কৃষকদের আলু ক্ষেতে ছত্রাক নাশক ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন।
রংপুর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কৃষক হাওর বার্তাকে বলেন, দশ দোন মাটিতে এবারও আলু চাষ করেছি। জমিতে লেট ব্রাইট রোগ দেখা দেওয়ায় ছত্রাক নাশক ওষুধ ছিটিয়েও কোনো ফল হচ্ছে না। তিনি বলেন, গতবারে যে আলু উৎপাদন করেছি সেগুলোই এখনো কোল্ড স্টোরেজে অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। সেখানে বড় ধরনের লোকসান। তার ওপর এবারও আবাদ করছি দশ দোন। দাম না পেলে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবো না।
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার টেপামধুপুর ইউনিয়নের চর রাজিবপুর এলাকার মহুবার রহমান জানান, পাঁচ বিঘা জমিতে আলু লাগিয়েছি যে খরচ হয়েছে আর শীতে যে পচন রোগ হয়েছে তাতে লোকসান হবে। তিনি বলেন, এই অবস্থায় কৃষি বিভাগের লোকজনকে ডেকেও পাচ্ছি না। তাই অনেকটা দিশেহারা।
চর আজম খাঁ এলাকার শিক্ষিক যুবক লোকমান হোসেন বলেন, পড়া-লেখা শেষ কওে চাকরির পেছনে ঘুরে বয়স শেষ। উপায় না পেয়ে জমি বখরা নিয়ে আলু চাষ শুরু করেছি। ১২ দোন জমিতে আলু লাগিয়েছি। কিন্তু জমিতে রোগ দেখা দেওয়ায় ছত্রাক নাশক ওষুধ ছিটিয়েও কোনো ফল হচ্ছে না। এতে করে ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলন ভালো না হলে পথে বসতে হবে বলে আশঙ্কা এই শিক্ষিত যুবকের।
কৃষি বিভাগের ধারণা, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে লেট ব্লাইট রোগটি সাধারণত আলু বীজ থেকেই আসে। এজন্য আলু চাষীদের উচিত মানসম্মত আলু বীজ লাগানো। মানসম্মত নয় এমন আলু বীজ লাগানো কারণে লেটব্লাইট রোগ আক্রমণ হচ্ছে।
রংপুর কৃষি বিভাগের উদ্যান বিশেষজ্ঞ খোন্দকার মেসবাহুল ইসলাম রংপুর অঞ্চলে আলু ক্ষেতে লেট ব্লাইট রোগের আক্রমণের কথা স্বীকার করে হাওর বার্তাকে বলেন, মেঘলা আকাশ, ঘন কুয়াশা ও হিমেল হাওয়ার কারণে বিরূপ আবহাওয়ায় এ রোগের উপত্তি।
তিনি বলেন, এবার বিএডিসির ৪০ ভাগ বীজ আলু অবিক্রীত ছিল। এর পরিবর্তে কিছুসংখ্যক চাষি বিএডিসি কিংবা মানসম্মত আলু বীজ জমিতে লাগাননি। নিজের ক্ষেতের সংরক্ষিত খাওয়ার আলুকে বীজ হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার কারণে এমন পরিস্থিতি হয়েছে। এতে করে এবার আলু লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম উৎপাদন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি লেট ব্লাইট দমনে এখনই আলু ক্ষেতে ছত্রাক নাশক ওষুধ ছিটানো পরামর্শ দেন।
রংপুর আঞ্চলিক কৃষি কর্মকর্তা মো. শাহ আলম হাওর বার্তাকে বলেন, এ বিষয় নিয়ে পেনিক সৃষ্টি না করাই ভালো। আলুর খুব একটা ক্ষতি হয়নি। আবহাওয়ার কারণেই একটু সমস্যা হয়েছে। এখন তাপমাত্রা বাড়ছে। আমাদের কৃষকরা অনেক সচেতন তারা বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত নয়। আর আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।