ঢাকা ০২:৫০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ভুলে গেলে চলবে না

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৪১:৫৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৫ জানুয়ারী ২০১৮
  • ৫৮৬ বার

জাকির হোসাইনঃ কয়েক বছর আগেও ভৈরবের মেঘনা বৃহৎ নদী সহ ছোট-বড় সব নদীর সুবিশাল বুক জুড়ে ছিলো নৌকার অবাধ বিচরণ। স্থানে স্থানে নদীর থৈ থৈ রূপালি পানির ধারে ছিলো খেয়া পারাপারের মুখরতা। ঘাটে ঘাটে সারাক্ষণ ছিল বৈঠা-জলের শব্দ। কিন্তু সেই দৃশ্য এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। যান্ত্রিক সভ্যতার দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী সেই নৌকাগুলো, ফুরিয়ে যাচ্ছে মাঝিদের সোনালি দিন।

এক সময় গ্রামাঞ্চলে নিম্নআয়ের মানুষের সাথে নৌকার সম্পর্ক ছিলো ঘনিষ্ঠ। গ্রাম বাংলার চারপাশ হাওর এবং ছোট-বড় নদী বেষ্টিত থাকায় প্রতিটি জীবনের জন্য ছিলো নৌকার নিবিড় প্রয়োজন। বাজার-হাটে যাতায়াত থেকে শুরু করে বিয়ের অনুষ্ঠানেরও একমাত্র বাহন ছিলো পাল তোলা নৌকা। উন্নত সড়কপথ না থাকায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতেও নৌকা ছিলো একমাত্র ভরসা।

কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় এসে ইঞ্জিন চালিত ট্রলারগুলোর দখলে চলে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার নদী আর হাওর। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে এক সময়ের ঐতিহ্য নানা নামের বাহারি নৌকা। নদী থেকে নৌকা ফুরিয়ে যাওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন এসব নৌকার সাথে জড়িত মাঝি পরিবারের সদস্যরা। বেশ কয়েক বছর আগেও কাটখালের নদীর বুক জুড়ে ছিলো অসংখ্য বৈঠা নৌকার বিচরণ।

ছিলো মাঝিদের কোলাহল। সেই সোনালি দিন এখন আর নেই বললেই চলে। কয়েক যুগ আগেও দেখা যেতো নৌকায় চড়ে বরযাত্রীদের যাতায়াত। নতুন বৌ নিয়ে আবার বাড়ি ফেরা। জমিদাররা পাল তোলা পানসী নিয়ে নৌ-বিলাসে বের হতেন। তারা পাল তোলা পাঁনসি নৌকায় বাণিজ্য করতে বিভিন্ন দেশে যেতেন। সেই পাঁনসি নৌকাও কয়েক যুগ আগে হারিয়ে গেছে নদী থেকে, আমাদের আবহমান বাংলার ঐতিহ্য থেকে।

একসময় গ্রাম বাংলার সব খেয়া ঘাটে সারিবদ্ধভাবে নৌকার মাঝিরা ভীড় জমাতেন। ভোর হলেই তারা যাত্রীর অপেক্ষায় থাকতেন সেইসব ঘাটে। অথচ এখন সেই ঘাটগুলো চলে গেছে ইঞ্জিনচালিত নৌকার দখলে। এখন সেইসব ঘাটে সারাক্ষণ যান্ত্রিক শব্দের খেলা।

হস্তচালিত নৌকাগুলো নদী থেকে কমে আসায় চরম দুর্দিন নেমে এসেছে মাঝি পরিবারে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা। সরেজমিন কয়েকটি খেয়াঘাটের কয়েকজন মাঝির সাথে আলাপ করে জানা গেছেশুধু গ্রামাঞ্চলে নয়, এক সময় হাওরের মানুষেরও প্রধান বাহন ছিলো নৌকা।

যেসব এলাকায় খেয়াঘাট ছিলো সেইসব ঘাটে দল বেধে সবাই অপেক্ষা করতেন নৌকার জন্য। যাত্রী টানাটানি করে মাঝিরাও ক্লান্ত সময় পার করতেন। দিনশেষে যা আয় হতো, তা দিয়ে সংসার ভালোই চলে যতো। পরিবার পরিজন নিয়ে কাটতো সুখ-দুখের দিন। কিন্তু সেই সোনালি দিন এখন আর নেই। খেয়ার ঘাটের মাঝি বলেন, চল্লিশ বছর ধরে নদী আর জলের সাথে আছি। এখানো মানুষ পারাপার করছি।

কিন্তু এখন ঘাটগুলোতে সারাদিন বসেও যাত্রী মিলেনা। অপেক্ষায় অপেক্ষায় দিন চলে যায়। ষাটোর্ধ্ব এক মুরব্বী বলেন, আগে শ-পঞ্চাশ টাকা রোজগার করে সংসার ভালোই চলে যতো। আর এখন আড়াইশ’ টাকা রোজী করেও সংসার চলো না। একইভাবে কষ্টের কথা জানালেন খেয়া নৌকার মাঝি । তিনি বলেন, এক সময় খুব একটা ইঞ্জিন নৌকা বা ইঞ্জিন চালিত ট্রলার চোখে পড়তো না।

পালতোলা নৌকা, টাপুরে নৌকা, পানসি নৌকা, কাঠালী নৌকাসহ আরো অনেক নৌকাই ছিলো নদীর প্রাণ। তখন নদীর পানিও সুন্দর থাকতো। আর এখন সবকিছু বদলে গেছে। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় সচেতন নাগরিক কমিটির সাবেক সভাপতি ফারুক মাহমুদের সাথে।

তিনি বলেন, নৌকাই ছিলো আদি বাহন। যুগের চাহিদা অনুযায়ী ইঞ্জিন নৌকা বা ট্রলারেরও আবেদন রয়েছে। তাই বলে গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ভুলে গেলে চলবে না। সেই নৌকাগুলোর কদরও যাতে সব সময় থাকে তারও একটা ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ভুলে গেলে চলবে না

আপডেট টাইম : ১১:৪১:৫৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৫ জানুয়ারী ২০১৮

জাকির হোসাইনঃ কয়েক বছর আগেও ভৈরবের মেঘনা বৃহৎ নদী সহ ছোট-বড় সব নদীর সুবিশাল বুক জুড়ে ছিলো নৌকার অবাধ বিচরণ। স্থানে স্থানে নদীর থৈ থৈ রূপালি পানির ধারে ছিলো খেয়া পারাপারের মুখরতা। ঘাটে ঘাটে সারাক্ষণ ছিল বৈঠা-জলের শব্দ। কিন্তু সেই দৃশ্য এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। যান্ত্রিক সভ্যতার দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী সেই নৌকাগুলো, ফুরিয়ে যাচ্ছে মাঝিদের সোনালি দিন।

এক সময় গ্রামাঞ্চলে নিম্নআয়ের মানুষের সাথে নৌকার সম্পর্ক ছিলো ঘনিষ্ঠ। গ্রাম বাংলার চারপাশ হাওর এবং ছোট-বড় নদী বেষ্টিত থাকায় প্রতিটি জীবনের জন্য ছিলো নৌকার নিবিড় প্রয়োজন। বাজার-হাটে যাতায়াত থেকে শুরু করে বিয়ের অনুষ্ঠানেরও একমাত্র বাহন ছিলো পাল তোলা নৌকা। উন্নত সড়কপথ না থাকায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতেও নৌকা ছিলো একমাত্র ভরসা।

কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় এসে ইঞ্জিন চালিত ট্রলারগুলোর দখলে চলে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার নদী আর হাওর। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে এক সময়ের ঐতিহ্য নানা নামের বাহারি নৌকা। নদী থেকে নৌকা ফুরিয়ে যাওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন এসব নৌকার সাথে জড়িত মাঝি পরিবারের সদস্যরা। বেশ কয়েক বছর আগেও কাটখালের নদীর বুক জুড়ে ছিলো অসংখ্য বৈঠা নৌকার বিচরণ।

ছিলো মাঝিদের কোলাহল। সেই সোনালি দিন এখন আর নেই বললেই চলে। কয়েক যুগ আগেও দেখা যেতো নৌকায় চড়ে বরযাত্রীদের যাতায়াত। নতুন বৌ নিয়ে আবার বাড়ি ফেরা। জমিদাররা পাল তোলা পানসী নিয়ে নৌ-বিলাসে বের হতেন। তারা পাল তোলা পাঁনসি নৌকায় বাণিজ্য করতে বিভিন্ন দেশে যেতেন। সেই পাঁনসি নৌকাও কয়েক যুগ আগে হারিয়ে গেছে নদী থেকে, আমাদের আবহমান বাংলার ঐতিহ্য থেকে।

একসময় গ্রাম বাংলার সব খেয়া ঘাটে সারিবদ্ধভাবে নৌকার মাঝিরা ভীড় জমাতেন। ভোর হলেই তারা যাত্রীর অপেক্ষায় থাকতেন সেইসব ঘাটে। অথচ এখন সেই ঘাটগুলো চলে গেছে ইঞ্জিনচালিত নৌকার দখলে। এখন সেইসব ঘাটে সারাক্ষণ যান্ত্রিক শব্দের খেলা।

হস্তচালিত নৌকাগুলো নদী থেকে কমে আসায় চরম দুর্দিন নেমে এসেছে মাঝি পরিবারে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা। সরেজমিন কয়েকটি খেয়াঘাটের কয়েকজন মাঝির সাথে আলাপ করে জানা গেছেশুধু গ্রামাঞ্চলে নয়, এক সময় হাওরের মানুষেরও প্রধান বাহন ছিলো নৌকা।

যেসব এলাকায় খেয়াঘাট ছিলো সেইসব ঘাটে দল বেধে সবাই অপেক্ষা করতেন নৌকার জন্য। যাত্রী টানাটানি করে মাঝিরাও ক্লান্ত সময় পার করতেন। দিনশেষে যা আয় হতো, তা দিয়ে সংসার ভালোই চলে যতো। পরিবার পরিজন নিয়ে কাটতো সুখ-দুখের দিন। কিন্তু সেই সোনালি দিন এখন আর নেই। খেয়ার ঘাটের মাঝি বলেন, চল্লিশ বছর ধরে নদী আর জলের সাথে আছি। এখানো মানুষ পারাপার করছি।

কিন্তু এখন ঘাটগুলোতে সারাদিন বসেও যাত্রী মিলেনা। অপেক্ষায় অপেক্ষায় দিন চলে যায়। ষাটোর্ধ্ব এক মুরব্বী বলেন, আগে শ-পঞ্চাশ টাকা রোজগার করে সংসার ভালোই চলে যতো। আর এখন আড়াইশ’ টাকা রোজী করেও সংসার চলো না। একইভাবে কষ্টের কথা জানালেন খেয়া নৌকার মাঝি । তিনি বলেন, এক সময় খুব একটা ইঞ্জিন নৌকা বা ইঞ্জিন চালিত ট্রলার চোখে পড়তো না।

পালতোলা নৌকা, টাপুরে নৌকা, পানসি নৌকা, কাঠালী নৌকাসহ আরো অনেক নৌকাই ছিলো নদীর প্রাণ। তখন নদীর পানিও সুন্দর থাকতো। আর এখন সবকিছু বদলে গেছে। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় সচেতন নাগরিক কমিটির সাবেক সভাপতি ফারুক মাহমুদের সাথে।

তিনি বলেন, নৌকাই ছিলো আদি বাহন। যুগের চাহিদা অনুযায়ী ইঞ্জিন নৌকা বা ট্রলারেরও আবেদন রয়েছে। তাই বলে গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ভুলে গেলে চলবে না। সেই নৌকাগুলোর কদরও যাতে সব সময় থাকে তারও একটা ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে।