হাওর বার্তা ডেস্কঃ সুনামগঞ্জে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থা চলছে। কাজের নির্ধারিত সময়ের ১৫ দিন পেরিয়ে গেছে। কাজ শুরু দূরে থাক, এখনো হাজারো প্রকল্পের একটিরও চূড়ান্ত অনুমোদন হয়নি। শেষ হয়নি প্রকল্প নির্ধারণ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনও।
নীতিমালা অনুযায়ী, হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের নির্মাণ কাজ ১৫ ডিসেম্বর শুরু এবং ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ করার কথা। তার আগে অবশ্যই ৩০ নভেম্বরের মধ্যে পিআইসি গঠন এবং ৩০ অক্টোবরের মধ্যে প্রকল্প নির্ধারণের কাজ চূড়ান্ত করতে হবে।
জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক ভূঁইয়া বলেন, ‘সবাই মিলেই চেষ্টা করছি দ্রুত কাজ শুরু এবং সময়মতো শেষ করতে। দু-এক দিনের মধ্যে সবকিছু চূড়ান্ত হয়ে যাবে। আমার হাতে কয়েকটি পিআইসি এসেছে। কিন্তু প্রকল্প চূড়ান্ত না হওয়ায় পিআইসির সদস্যরা কাজ শুরু করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।’
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র বলছে, এবার জেলার প্রায় ৫০টি হাওরের ফসল রক্ষায় ৫৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের কাজ হবে। এ জন্য বরাদ্দ পাওয়া গেছে ৬০ কোটি ৪০ লাখ টাকা। তবে স্থানীয়ভাবে প্রাক্কলন তৈরির পর দেখা গেছে, আরও ৬৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রকল্পের সংখ্যাও বাড়বে।
প্রকল্প অনুমোদনে জটিলতা
সুনামগঞ্জে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ আগে ঠিকাদার এবং পিআইসি দিয়ে করানো হতো। গত বছরের এপ্রিলে ব্যাপক ফসলহানির পর বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এরপর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বাঁধের কাজের নতুন নীতিমালা করে। বাদ দেওয়া হয় ঠিকাদারি প্রথা। এবার সব কাজ করবে সুবিধাভোগী ও কৃষকদের নিয়ে গঠিত পিআইসি।
এবারই বাঁধের কাজে সরাসরি যুক্ত হয়েছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। গঠন করা হয়েছে জেলা ও উপজেলা কমিটি। জেলা প্রশাসক জেলা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উপজেলা কমিটির প্রধান। পিআইসি গঠন করবে উপজেলা কমিটি। তারা জেলা কমিটিতে পাঠিয়ে পিআইসি অনুমোদন করে নেবে। একটি পিআইসি একটি প্রকল্পের কাজ করবে।
নীতিমালা অনুযায়ী, প্রকল্প চূড়ান্ত অনুমোদনের ক্ষমতা ছিল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু বিষয়টি সময়সাপেক্ষ হওয়ায় সেই ক্ষমতা জেলা প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছে যদিও অনেক দেরিতে। মন্ত্রণালয় থেকে গত সপ্তাহে এক চিঠিতে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
তার আগেই ২৬ নভেম্বর জেলা কমিটির সভায় এক হাজার ৮৮টি প্রকল্প অনুমোদন দিয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেগুলো এখন মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন হয়ে ফিরবে, নাকি অনুমোদনের জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে আসবে, গতকাল পর্যন্ত তা অস্পষ্ট ছিল।
জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন প্রকল্প অনুমোদনের জন্য জেলা কমিটিকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রকল্পগুলোর কী হবে, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা আসেনি। আমরা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি। এরপরই কাজ শুরু হবে।’
সমন্বয়হীনতার ফল?
সুনামগঞ্জে গত এপ্রিল মাসে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ১৫৪টি হাওরের বোরো ধান তলিয়ে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জেলার ৩ লাখ ২৫ হাজার ৯৯০টি কৃষক পরিবার। গত বছরও বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়েছিল বিলম্বে। এবারও বাঁধের কাজে বিলম্ব হওয়ার জন্য পাউবো ও জেলা প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন কেউ কেউ।
‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনের আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরী বলেন, দিন যতই যাচ্ছে, উদ্বেগ ততই বাড়ছে। অসময়ে বাঁধ হলে সেই বাঁধ দুর্বল হয়। দুর্বল মাটির বাঁধ ঢলের প্রথম ধাক্কাই সামলাতে পারে না। সংগঠনের আরেক সদস্য বলেন, ‘এবার ফসল রক্ষা বাঁধের কাজে পাউবোর সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন সরাসরি যুক্ত। আমরা এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব লক্ষ করছি।’
পিছিয়েছে বোরো আবাদ
অন্য বছর ডিসেম্বরের শুরু থেকেই হাওরে বোরো আবাদ শুরু হয়ে যায়। এবার হাওর থেকে পানি নামছে ধীরে। এখনো অনেক হাওরে পানি থাকায় কৃষকেরা নামতে পারছেন না। বাঁধের কাজ সময়মতো শুরু না হওয়ার বিষয়টিও তাঁদের ভাবিয়ে তুলেছে। কষ্ট করে ধান রোপণের পর আবার গত এপ্রিলের মতো সেই ধান হারাতে না হয়, এই শঙ্কা রয়েছে মনে।
গত শনিবার দুপুরে জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার পাকনার হাওরের গজারিয়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অকেজো একটি জলকপাটের (স্লুইসগেট) সামনে জমে থাকা মাটি কাটছেন ২০-২৫ জন শ্রমিক। স্থানীয় ফেনারবাক ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) উদ্যোগে এই কাজ হচ্ছে।
গজারিয়া গ্রামের কৃষক আবরু মিয়া (৬৫) বলেন, হাওরের পানি নিষ্কাশনের জন্য ২০ বছর আগে এই জলকপাট নির্মিত হয়েছিল। তিন বছর পরই এটির সামনে পলি পড়ে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আর কেউ কোনো খোঁজ নেয়নি। আমানীগাঁওয়ের কৃষক আবারক আলী (৫২) বলেন, ‘আমার জীবনে হাওরে এই সময় এত পানি দেখি নাই। যেখানে ধান লাগাইতাম, সেখানে এখন কোমরপানি।’
হাওরের ডালিয়া এলাকায় কৃষকেরা নিজেদের উদ্যোগে পানি নিষ্কাশনের জন্য বেড়িবাঁধের মাটি কেটে নালা করে দিয়েছেন। পাশে থাকা জলকপাটটিও খুলে দেওয়া হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত জেলার চারটি উপজেলার সাতটি হাওর ঘুরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে ঢাকার ‘হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্ম’ নামের একটি সংগঠনের পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল। সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক শরিফুজ্জামান বলেন, ‘আমরা হাওরে ফসলহানির পর প্রতি মাসেই একবার করে আসছি। পরিস্থিতি ভালো নয়। জলাবদ্ধতার বিষয়টি গত এক মাস আগেই বোঝা গিয়েছে। তখন থেকে উদ্যোগ নিলে এখন সমস্যা অনেকখানি মিটে যেত।’
জেলা প্রশাসনের হিসেবেই এবার হাওর থেকে পানি ধীরে নামার কারণে বোরো আবাদ ২০-২৫ দিন পিছিয়ে গেছে। হাওরের কৃষকেরা সাধারণত নভেম্বরের শেষে বোরো চাষ শুরু করেন।
‘হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্ম’-এর প্রতিনিধিদলে থাকা প্রকৌশলী সরদার আমীন বলেন, ‘হাওরে ফসলডুবির পর দেশজুড়ে এত চিৎকার, এত কথার পরও কেন সময়মতো এবার বাঁধের কাজ শুরু করা গেল না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। জলাবদ্ধতার বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আগেই ভাবা উচিত ছিল। আমরা কোথাও কোথাও নদী ও হাওরের পানির উচ্চতা সমান দেখেছি। হাওরের ভেতরে ছোট নালা ও নদীর পাশাপাশি বড় নদীগুলোও ভরাট হয়েছে। সেগুলো খনন করতে হবে। তা না হলে সমস্যা থেকেই যাবে।
সূত্র: প্রথম আলো