ঢাকা ০২:৫১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওরে নারীরা ঘোমটা মাথায় দিয়ে বীজতলা থেকে চারা তুলতে ব্যস্ত আছে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০১:১১:৫৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩ জানুয়ারী ২০১৮
  • ৩৪৯ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মাথার ওপরে প্রখর রোদ। ঘোমটা টেনে নিবিষ্ট মনে কাজ করছে নারীরা। অনেক মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। এই নারীদের মধ্যে কৃষক বধূদের পাশাপাশি দিনমজুর পরিবারের নারীরাও আছে। পুরুষরা যখন হাওরে ক্ষেত চষায় ব্যস্ত, নারীরা তখন বীজতলা তৈরি করছে। চারা তুলে হাওরে পৌঁছে দিচ্ছে। পুরুষরা সেগুলো বোরোক্ষেতে লাগিয়ে দিচ্ছে। হাওর উপজেলা শাল্লা ও দিরাই ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।

দিরাই উপজেলার অন্যতম বড় ভরাম হাওর। গেল এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সম্পূর্ণ তলিয়ে যায় এটি। হাজার হাজার কৃষক হাওর রক্ষা বাঁধে কাজ করেও তা রক্ষা করতে পারেনি।

ফসল তলিয়ে যাওয়ায় সব কৃষকের ভাঁড়ার শূন্য। তাই কৃষক বধূদেরও অন্যান্য বছরের মতো খলায় ধান নাড়া, শুকানো, গোলায় তোলার সুযোগ ছিল না। বরং ফসল হারিয়ে তারা এক অনিশ্চিত জীবন পাড়ি দিচ্ছে। সচ্ছল কৃষকরা লাইনে দাঁড়িয়ে কমদামে ওএমএসের চাল কিনছে। কৃষি ভর্তুকি পাওয়ার জন্য ধরনা দিচ্ছে জনপ্রতিনিধিদের কাছে। নানা সংকটের মধ্যে আগামী বোরো মৌসুমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে হাওর-ভাটির কয়েক লাখ কৃষক। কৃষকরা যখন ভোর থেকে ক্ষেতে লাঙল-জোয়াল বা হাল নিয়ে যাচ্ছে, তখন নারীরা সংসারের কাজ সেরে ছুটছে হাওরে। তারা বীজতলায় দিনভর চারা তুলছে।

দিরাই পৌর শহর থেকে একটি ডুবন্ত রাস্তা ভরাম হাওরকে দুই ভাগ করেছে। সোজা দক্ষিণে চলে গেছে ধল বাজার পর্যন্ত। রাস্তার দুই ধারে হাওরের বিস্তৃত ক্ষেত। সেখানে দেখা গেল কৃষকদের জমি চষতে। কেউ লাঙলে, কেউবা যন্ত্র দিয়ে চাষ দিচ্ছে। পুরো হাওরে ছিল এই চিত্র। তবে ধল এলাকায় দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। প্রায় এক কিলোমিটার জায়গাজুড়ে বীজতলায় ছোট ছোট দলে নারীরা চারা তুলছে। ধল বাজার থেকে খেয়ায় কালনী নদী পাড়ি দিয়ে দক্ষিণে টাঙনির হাওর। কালনী নদীর দক্ষিণ তীরের সরালিতোপা, আছানপুর, জাতপুর, সরষপুর, নারকিলাসহ বিভিন্ন গ্রামের বীজতলায় দেখা গেল, নারীরা কাজ করছে। পুরুষরা জমি চষছে।

ধল গ্রামের কৃষক আলী আহমদের বীজতলায় দেখা গেল, সাত-আটজন কিষানি চারা তুলছে। কৃষক পরিবারের নারীসহ এখানে রয়েছে মজুর হিসেবে চারা উত্তোলনকারী নারীও। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন সনম বিবি। স্বামীহীন এই নারী প্রতিবছর এভাবে মজুর দিয়ে সংসার নির্বাহ করেন। তাঁর দুই সন্তানকে বাড়িতে রেখে সকালে এসেছেন কাজে।

সনম বিবি বলেন, ‘আমরা ইকানো আরো বেটিনও আউরে খাজ করে। ইকানো ই কাজ হকলবালাই অয়। গিরস্তের বউ-ঝিও আমরার লগে তারার খেতো খাজ করে। ই কাজও আমরার মজুরি কম। সারা দিন খাটনি দিয়াও দুই শ টাকার বেশি পাওয়া যায় না। ’

পাশের ক্ষেতে কাজ করছিলেন গ্রামের মুলেফা বেগম। তিনি বলেন, ‘গেছেবার মাইর খাইছি। ঘরো ধানপান নাই। আমরাও কুনু কাজ করতাম পারছি না। কিলা যে বছর পার করছি আল্লায় জানে। ইবার জালাখেতো নামছি। সঙ্গে খামলাও আছে। ’

গ্রামের আছিয়া বেগম জানান, প্রতিবছর তাঁরা ধান লাগানো থেকে কেটে গোলায় তোলা পর্যন্ত মাঠে কাজ করেন। একই সঙ্গে সংসারের কাজও চলে। তবে গত বছর সম্পূর্ণ ফসল আগাম তলিয়ে যাওয়ায় সেই কাজের সুযোগ পাননি। এ কারণেও তাঁদের মন আরো বেশি খারাপ।

তাঁদের পাশে কাজ করছিলেন গ্রামের জোছনা বেগম, সুফিয়া বেগমসহ কয়েকজন কিষানি। তাঁদের অনেকের সঙ্গে মেয়েরাও কাজে ছিলেন।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে ২৬৫টি হাওরে এ বছর দুই লাখ ২২ হাজার ৫৫২ হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিআর ২৮, ২৯ এবং হাইব্রিড ধান বেশি চাষ হচ্ছে। সঙ্গে দেশি বোরোও রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, পানি বিলম্বে নামার কারণে এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ জমি চাষ করতে পারেনি কৃষক।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক স্বপন কুমার সাহা বলেন, ‘মাঠে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, বিভিন্ন হাওরে নারীরাও কাজ করছে। তারা বিভিন্ন ফসলে চাষ থেকে শুরু করে ঘরে তোলা পর্যন্ত নানাভাবে জড়িত। এবার ফসল হারানোর পরিপ্রেক্ষিতে তারা অনেকে ক্ষেতে আন্তরিকভাবে কাজ করছে। তবে বিলম্বে পানি নামার কারণে অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার রোপণ হচ্ছে কম।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

হাওরে নারীরা ঘোমটা মাথায় দিয়ে বীজতলা থেকে চারা তুলতে ব্যস্ত আছে

আপডেট টাইম : ০১:১১:৫৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩ জানুয়ারী ২০১৮

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মাথার ওপরে প্রখর রোদ। ঘোমটা টেনে নিবিষ্ট মনে কাজ করছে নারীরা। অনেক মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। এই নারীদের মধ্যে কৃষক বধূদের পাশাপাশি দিনমজুর পরিবারের নারীরাও আছে। পুরুষরা যখন হাওরে ক্ষেত চষায় ব্যস্ত, নারীরা তখন বীজতলা তৈরি করছে। চারা তুলে হাওরে পৌঁছে দিচ্ছে। পুরুষরা সেগুলো বোরোক্ষেতে লাগিয়ে দিচ্ছে। হাওর উপজেলা শাল্লা ও দিরাই ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।

দিরাই উপজেলার অন্যতম বড় ভরাম হাওর। গেল এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সম্পূর্ণ তলিয়ে যায় এটি। হাজার হাজার কৃষক হাওর রক্ষা বাঁধে কাজ করেও তা রক্ষা করতে পারেনি।

ফসল তলিয়ে যাওয়ায় সব কৃষকের ভাঁড়ার শূন্য। তাই কৃষক বধূদেরও অন্যান্য বছরের মতো খলায় ধান নাড়া, শুকানো, গোলায় তোলার সুযোগ ছিল না। বরং ফসল হারিয়ে তারা এক অনিশ্চিত জীবন পাড়ি দিচ্ছে। সচ্ছল কৃষকরা লাইনে দাঁড়িয়ে কমদামে ওএমএসের চাল কিনছে। কৃষি ভর্তুকি পাওয়ার জন্য ধরনা দিচ্ছে জনপ্রতিনিধিদের কাছে। নানা সংকটের মধ্যে আগামী বোরো মৌসুমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে হাওর-ভাটির কয়েক লাখ কৃষক। কৃষকরা যখন ভোর থেকে ক্ষেতে লাঙল-জোয়াল বা হাল নিয়ে যাচ্ছে, তখন নারীরা সংসারের কাজ সেরে ছুটছে হাওরে। তারা বীজতলায় দিনভর চারা তুলছে।

দিরাই পৌর শহর থেকে একটি ডুবন্ত রাস্তা ভরাম হাওরকে দুই ভাগ করেছে। সোজা দক্ষিণে চলে গেছে ধল বাজার পর্যন্ত। রাস্তার দুই ধারে হাওরের বিস্তৃত ক্ষেত। সেখানে দেখা গেল কৃষকদের জমি চষতে। কেউ লাঙলে, কেউবা যন্ত্র দিয়ে চাষ দিচ্ছে। পুরো হাওরে ছিল এই চিত্র। তবে ধল এলাকায় দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। প্রায় এক কিলোমিটার জায়গাজুড়ে বীজতলায় ছোট ছোট দলে নারীরা চারা তুলছে। ধল বাজার থেকে খেয়ায় কালনী নদী পাড়ি দিয়ে দক্ষিণে টাঙনির হাওর। কালনী নদীর দক্ষিণ তীরের সরালিতোপা, আছানপুর, জাতপুর, সরষপুর, নারকিলাসহ বিভিন্ন গ্রামের বীজতলায় দেখা গেল, নারীরা কাজ করছে। পুরুষরা জমি চষছে।

ধল গ্রামের কৃষক আলী আহমদের বীজতলায় দেখা গেল, সাত-আটজন কিষানি চারা তুলছে। কৃষক পরিবারের নারীসহ এখানে রয়েছে মজুর হিসেবে চারা উত্তোলনকারী নারীও। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন সনম বিবি। স্বামীহীন এই নারী প্রতিবছর এভাবে মজুর দিয়ে সংসার নির্বাহ করেন। তাঁর দুই সন্তানকে বাড়িতে রেখে সকালে এসেছেন কাজে।

সনম বিবি বলেন, ‘আমরা ইকানো আরো বেটিনও আউরে খাজ করে। ইকানো ই কাজ হকলবালাই অয়। গিরস্তের বউ-ঝিও আমরার লগে তারার খেতো খাজ করে। ই কাজও আমরার মজুরি কম। সারা দিন খাটনি দিয়াও দুই শ টাকার বেশি পাওয়া যায় না। ’

পাশের ক্ষেতে কাজ করছিলেন গ্রামের মুলেফা বেগম। তিনি বলেন, ‘গেছেবার মাইর খাইছি। ঘরো ধানপান নাই। আমরাও কুনু কাজ করতাম পারছি না। কিলা যে বছর পার করছি আল্লায় জানে। ইবার জালাখেতো নামছি। সঙ্গে খামলাও আছে। ’

গ্রামের আছিয়া বেগম জানান, প্রতিবছর তাঁরা ধান লাগানো থেকে কেটে গোলায় তোলা পর্যন্ত মাঠে কাজ করেন। একই সঙ্গে সংসারের কাজও চলে। তবে গত বছর সম্পূর্ণ ফসল আগাম তলিয়ে যাওয়ায় সেই কাজের সুযোগ পাননি। এ কারণেও তাঁদের মন আরো বেশি খারাপ।

তাঁদের পাশে কাজ করছিলেন গ্রামের জোছনা বেগম, সুফিয়া বেগমসহ কয়েকজন কিষানি। তাঁদের অনেকের সঙ্গে মেয়েরাও কাজে ছিলেন।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে ২৬৫টি হাওরে এ বছর দুই লাখ ২২ হাজার ৫৫২ হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিআর ২৮, ২৯ এবং হাইব্রিড ধান বেশি চাষ হচ্ছে। সঙ্গে দেশি বোরোও রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, পানি বিলম্বে নামার কারণে এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ জমি চাষ করতে পারেনি কৃষক।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক স্বপন কুমার সাহা বলেন, ‘মাঠে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, বিভিন্ন হাওরে নারীরাও কাজ করছে। তারা বিভিন্ন ফসলে চাষ থেকে শুরু করে ঘরে তোলা পর্যন্ত নানাভাবে জড়িত। এবার ফসল হারানোর পরিপ্রেক্ষিতে তারা অনেকে ক্ষেতে আন্তরিকভাবে কাজ করছে। তবে বিলম্বে পানি নামার কারণে অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার রোপণ হচ্ছে কম।