এ কাজগুলোতে যেন দুর্নীতির সুযোগ না থাকে, সেজন্য সর্বোচ্চ স্বচ্ছতাও নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, তার সমাধান কী?
গত দু বছর ধরেই সুনামগঞ্জের হাওরপাড়ের কৃষকদের সামনে নতুন নতুন সংকট আসছে। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসেই পুরোদমে চারা রোপণের কাজ শুরু হলেও এবছর তা হচ্ছে না। হাওরের পানি না কমার চিত্র দেখে বোরো ধান রোপণ নিয়ে কৃষকরা উদ্বেগ আর উত্কণ্ঠায় আছে। তাদের চোখ শুকনো। সারাবছর খেয়ে না খেয়ে গেছে। সেইসব উত্কণ্ঠিত লাখো চোখে এখন ভর করেছে ভয় আর অসহায়ত্ব।
আমরা জানি, গত দুই বছর পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে অকাল বন্যায় বাঁধ ভেঙে ফসল হারিয়ে কৃষকরা বর্তমানে একবারে সর্বস্বান্ত। আর এবছরও পানি যে-হারে কমছে, তাতে করে বীজতলা তৈরি করতে পারলেও তা রোপণ করতে পারবে কিনা এই চিন্তায় রয়েছে হাওরপাড়ের লাখ লাখ কৃষক। তাছাড়া পিআইসি গঠনে বিলম্ব হওয়ার বিষয়টি নিয়ে এবছরও প্রশ্নবিদ্ধ করছেন হাওরপাড়ের কৃষক ও হাওর আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। আর দ্রুত পিআইসি গঠনের কাজ শেষ করতে না পারলে এবারও বোরো ফসল ঝুঁকিতে পড়বে।
সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, হাওরে বীজ বপনের সময় পার হয়ে গেলেও কোনো কোনো হাওরের পানি নিষ্কাশনের নদী-খাল বা স্লুইসগেট, ভার্টিকেল গেট বা পাইপ স্লুইসগেট ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। তাছাড়া সুনামগঞ্জ জেলার ছোট বড় ১৫৪টি হাওরের বেশিরভাগ হাওরই চাষাবাদের উপযোগী হয়নি এখনো। এবার সময়মত বীজতলা না শুকানোয় উঁচু জমিতে বীজ ফেলেছেন হাওরপাড়ের কৃষকরা। কিন্তু বোরো ধান রোপণে বাদ সেধেছে সেই পানি।
যে পানির মাঝে হাওরপাড়ের মানুষ বসবাস আর বর্ষায় ছয়মাস মাছ ধরে জীবন-জীবিকা পরিচালনা করে, সেই পানিই হাওরে কষ্টের ফলানো বোরো ধান ডুবিয়ে হাওরবাসীর স্বপ্নকে ডুবিয়ে দেয় চোখের পলকে। এবার সেই পানি এখন লাখ লাখ হাওরবাসীর চিন্তা আর মহা সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য বছর এই সময় ছয়-সাত হাজারের বেশি হেক্টর বোরো জমি চাষাবাদ হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত এ বছর চাষ হয়েছে তিন হাজার হেক্টরের কম। এই অবস্থায় বেশির ভাগ হাওরপাড়ের কৃষক বেকায়দায় পড়েছেন।
সুনামগঞ্জে হাওরের এ নতুন সংকট নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন এখন প্রায় সাড়ে তিন লাখ কৃষক পরিবার। নিকট অতীতে তারা এমন সংকটের মুখোমুখি হননি। সরকার পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রথমবারের মতো প্রায় ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিলেও প্রাকৃতিক কারণে বিলম্বিত পানি নিষ্কাশনের কাজ করার সুযোগ নেই। তাই কৃত্রিম কারণে যেসব হাওরের পানি নামছে না, সেসব হাওরে বিচ্ছিন্নভাবে পানি নিষ্কাশনের কাজ চলছে। জেলার এবার দুই লাখ ২২ হাজার ৫৫২ হেক্টর বোরো জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মূল্য প্রায় ১৫শ’ কোটি টাকা। কিন্তু জেলার বড় বড় হাওরগুলোর পানি এখনো কমছে না। হাওরে মাইলের পর মাইল চাষযোগ্য জমিতে পানি একবারেই যেন স্থির হয়ে আছে।
ফলে ঐসব হাওরের বীজতলাও পানিতেই ডুবে আছে। পহেলা পৌষ থেকে ১৫ মাঘ পর্যন্ত বোরো আবাদের সময়। এই সময় ৪০-৪৫দিন বয়সী চারা লাগানোয় ব্যস্ত সময় পার করে কৃষকরা আর জলাশয় শে্রিণর জমিতে দুই মাস বয়সী চারা লাগায়। আর তাই এভাবে কচ্ছপের গতিতে পানি কমলে চরম ক্ষতির শিকার হবে কৃষকরা। সেইসাথে এবার লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হবে না। আর এর প্রভাব পড়বে হাওরের প্রতিটি মানুষের জীবন-জীবিকা, স্বপ্ন আর দেশের অর্থনীতির ওপর।