ঢাকা ০৪:৫৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঐতিহ্যবাহী গ্রামবাংলার লাঙল, জোয়াল ও বাঁশের মই গরুর হালচাষিরা হারিয়ে যাচ্ছে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:০৩:৪৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭
  • ৪৮৭ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশে প্রায় আশি ভাগ লোক কৃষক। আর কৃষিকাজে তারা কামারের তৈরি এক টুকরো লোহার ফাল দিয়ে কাঠমিস্ত্রির হাতে তৈরি কাঠের লাঙল, জোয়াল আর বাঁশের তৈরি মই ব্যবহার করে জমির চাষাবাদ করতেন।

কৃষিকাজে ব্যবহৃত এসব স্বল্প মূল্যের কৃষি উপকরণ এবং গরু দিয়ে হালচাষ করে তারা যুগের পর যুগ ধরে ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। এতে করে একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা হয়, অন্যদিকে কৃষকের অর্থ ব্যয় হয় কম।

লাঙল, জোয়াল ও বাঁশের মই ছাড়াও হালচাষিরা অতিগুরুত্বপূর্ণ যে দুটি জিনিস ব্যবহার করেন তা হলো গোমাই আর পান্টি। ফসলের পাশের কিংবা ঘাসপূর্ণ জমিতে চাষের সময় গরু যাতে কোনো খাদ্য খেতে না পারে, সেদিক লক্ষ্য রেখে পাট, বেত, বাঁশের কঞ্চি অথবা লতাজাতীয় এক ধরনের গাছ দিয়ে তৈরি গোমাই গরুর মুখে বেঁধে দেওয়া হয়। আর জোরে জোরে হাল চালানোর জন্য ব্যবহার করেন বাঁশের পান্টি।

এটি খুব বেশি দিনের কথা নয়, প্রায় পঁচিশ বছর আগে এসব গরুর হালে লাঙল-জোয়াল আর মই ফুলবাড়ীর গ্রামগঞ্জের জমিতে হরহামেশাই দেখা যেত। চাষিদের অনেকে নিজের জমিতে হালচাষ করার পাশাপাশি অন্যের জমি চাষিয়ে পারিশ্রমিক হিসেবে কিছু অর্থও উপার্জন করতেন।

তারা হাজারো কর্মব্যস্ততার মধ্যেও কখনো কখনো ফুরফুরে আনন্দের মনের সুখে রংপুর অঞ্চলের ভাওয়াইয়া গান গেয়ে গেয়ে জমি চাষ দিতেন। ভোররাত থেকে শুরু করে প্রায় দুপুর পযন্ত জমিতে হালচাষ করতেন তারা। চাষিরা জমিতে হাল নিয়ে আসার আগে চিড়া-গুড় অথবা মুড়ি-মুড়কি দিয়ে হালকা জল খাবার খেয়ে নিতেন। পরে একটানা হট হট, ডাইনে যা, বাঁয়ে যা, বস বস আর উঠ উঠ করে যখন ক্লান্তি আসত, তখন সূর্য প্রায় মাথার উপর খাড়া হয়ে উঠতো।

এ সময় চাষিরা সকালের নাশতার জন্য হালচাষে বিরতি রেখে জমির আইলের ওপর বসতেন। তাদের নাশতার ধরনটাও ছিল ঐতিহ্যবাহী। এক থাল পান্তা ভাতের সঙ্গে কাঁচা অথবা শুকনো মরিচ, সর্ষের খাঁটি তেল আর আলু ভর্তা।

সব চেয়ে মজার ব্যাপার হলো জমিতে হালচাষ দিতে দিতে এক চাষি আরেক চাষিকে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে গানে গানে বলতেন, ‘হালুয়া দাদারে হাল ছাড়িয়া দে, নদীর পাড়ত কইনা কান্দে মোকো বিয়াও দে।’

এসব তো গেল শুকনা মৌসুমে হালচাষের কথা। বর্ষাকালে কারো জমির চাষাবাদ পিছিয়ে গেছে সবার শেষে হাল চাষিরা নিজে থেকে হাল গরু নিয়ে এসে পিছিয়ে পড়া চাষিদের জমি চাষ দিতেন। হাল চাষিদের সঙ্গে আরো যোগ দিতেন রোপার চারা লাগার লোকজন। সকলে অংশগ্রহণে উৎসবমুখর এই কাজটিকে বলা হতো- ‘কিষ্যাণ’। কিষ্যাণে অংশ নেওয়া কিষাণদের জন্য জমিওয়ালা গেরস্থরা বড় বড় মোরগ, হাঁস কিংবা খাসি জবাই করে ভোজ করাতেন।

কিন্তু আজকাল সময়ের আবর্তে ফুলবাড়ীতে এসব গরুর হাল, কৃষি উপকরণ কাঠের লাঙল, জোয়াল, বাঁশের মই হারিয়ে যেতে বসেছে এবং হাল-কিষ্যাণ প্রায় বিলুপ্তির পথে। কেনইবা হবে না।

এ যুগে মানুষের অসীম চাহিদা আর অভাবময় জীবনে উন্নয়নের ছোঁয়া দিতে আবির্ভূত হয়েছে দামি দামি যান্ত্রিক হাল। সঙ্গে এসেছে ফসলের বীজ, বপন-রোপণ এবং ফসল কাটামাড়াই করার যন্ত্র। আর এসব যন্ত্র চালাতে মাত্র এক থেকে দুজন লোক প্রয়োজন।

ফলে বিত্তবান কৃষকরা ওই যন্ত্র কিনে মজুরের ভূমিকায় কাজ করলেও গ্রামের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দিনমজুরের জীবন থেকে ওই সব ঐতিহ্যময় স্মরণীয় দিন চিরতরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

ঐতিহ্যবাহী গ্রামবাংলার লাঙল, জোয়াল ও বাঁশের মই গরুর হালচাষিরা হারিয়ে যাচ্ছে

আপডেট টাইম : ১২:০৩:৪৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশে প্রায় আশি ভাগ লোক কৃষক। আর কৃষিকাজে তারা কামারের তৈরি এক টুকরো লোহার ফাল দিয়ে কাঠমিস্ত্রির হাতে তৈরি কাঠের লাঙল, জোয়াল আর বাঁশের তৈরি মই ব্যবহার করে জমির চাষাবাদ করতেন।

কৃষিকাজে ব্যবহৃত এসব স্বল্প মূল্যের কৃষি উপকরণ এবং গরু দিয়ে হালচাষ করে তারা যুগের পর যুগ ধরে ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। এতে করে একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা হয়, অন্যদিকে কৃষকের অর্থ ব্যয় হয় কম।

লাঙল, জোয়াল ও বাঁশের মই ছাড়াও হালচাষিরা অতিগুরুত্বপূর্ণ যে দুটি জিনিস ব্যবহার করেন তা হলো গোমাই আর পান্টি। ফসলের পাশের কিংবা ঘাসপূর্ণ জমিতে চাষের সময় গরু যাতে কোনো খাদ্য খেতে না পারে, সেদিক লক্ষ্য রেখে পাট, বেত, বাঁশের কঞ্চি অথবা লতাজাতীয় এক ধরনের গাছ দিয়ে তৈরি গোমাই গরুর মুখে বেঁধে দেওয়া হয়। আর জোরে জোরে হাল চালানোর জন্য ব্যবহার করেন বাঁশের পান্টি।

এটি খুব বেশি দিনের কথা নয়, প্রায় পঁচিশ বছর আগে এসব গরুর হালে লাঙল-জোয়াল আর মই ফুলবাড়ীর গ্রামগঞ্জের জমিতে হরহামেশাই দেখা যেত। চাষিদের অনেকে নিজের জমিতে হালচাষ করার পাশাপাশি অন্যের জমি চাষিয়ে পারিশ্রমিক হিসেবে কিছু অর্থও উপার্জন করতেন।

তারা হাজারো কর্মব্যস্ততার মধ্যেও কখনো কখনো ফুরফুরে আনন্দের মনের সুখে রংপুর অঞ্চলের ভাওয়াইয়া গান গেয়ে গেয়ে জমি চাষ দিতেন। ভোররাত থেকে শুরু করে প্রায় দুপুর পযন্ত জমিতে হালচাষ করতেন তারা। চাষিরা জমিতে হাল নিয়ে আসার আগে চিড়া-গুড় অথবা মুড়ি-মুড়কি দিয়ে হালকা জল খাবার খেয়ে নিতেন। পরে একটানা হট হট, ডাইনে যা, বাঁয়ে যা, বস বস আর উঠ উঠ করে যখন ক্লান্তি আসত, তখন সূর্য প্রায় মাথার উপর খাড়া হয়ে উঠতো।

এ সময় চাষিরা সকালের নাশতার জন্য হালচাষে বিরতি রেখে জমির আইলের ওপর বসতেন। তাদের নাশতার ধরনটাও ছিল ঐতিহ্যবাহী। এক থাল পান্তা ভাতের সঙ্গে কাঁচা অথবা শুকনো মরিচ, সর্ষের খাঁটি তেল আর আলু ভর্তা।

সব চেয়ে মজার ব্যাপার হলো জমিতে হালচাষ দিতে দিতে এক চাষি আরেক চাষিকে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে গানে গানে বলতেন, ‘হালুয়া দাদারে হাল ছাড়িয়া দে, নদীর পাড়ত কইনা কান্দে মোকো বিয়াও দে।’

এসব তো গেল শুকনা মৌসুমে হালচাষের কথা। বর্ষাকালে কারো জমির চাষাবাদ পিছিয়ে গেছে সবার শেষে হাল চাষিরা নিজে থেকে হাল গরু নিয়ে এসে পিছিয়ে পড়া চাষিদের জমি চাষ দিতেন। হাল চাষিদের সঙ্গে আরো যোগ দিতেন রোপার চারা লাগার লোকজন। সকলে অংশগ্রহণে উৎসবমুখর এই কাজটিকে বলা হতো- ‘কিষ্যাণ’। কিষ্যাণে অংশ নেওয়া কিষাণদের জন্য জমিওয়ালা গেরস্থরা বড় বড় মোরগ, হাঁস কিংবা খাসি জবাই করে ভোজ করাতেন।

কিন্তু আজকাল সময়ের আবর্তে ফুলবাড়ীতে এসব গরুর হাল, কৃষি উপকরণ কাঠের লাঙল, জোয়াল, বাঁশের মই হারিয়ে যেতে বসেছে এবং হাল-কিষ্যাণ প্রায় বিলুপ্তির পথে। কেনইবা হবে না।

এ যুগে মানুষের অসীম চাহিদা আর অভাবময় জীবনে উন্নয়নের ছোঁয়া দিতে আবির্ভূত হয়েছে দামি দামি যান্ত্রিক হাল। সঙ্গে এসেছে ফসলের বীজ, বপন-রোপণ এবং ফসল কাটামাড়াই করার যন্ত্র। আর এসব যন্ত্র চালাতে মাত্র এক থেকে দুজন লোক প্রয়োজন।

ফলে বিত্তবান কৃষকরা ওই যন্ত্র কিনে মজুরের ভূমিকায় কাজ করলেও গ্রামের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দিনমজুরের জীবন থেকে ওই সব ঐতিহ্যময় স্মরণীয় দিন চিরতরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।