হাওর বার্তা ডেস্কঃ হাওরের পানি ঝিম ধরিলেছে ভাই। লামতো চায় না। ক্ষেত না করলে ইবার যে কিতা অইব আল্লায় জানে। গত শুক্রবার বাড়ির পাশের কালিকোটা হাওর দেখিয়ে এভাবেই কথা বলছিলেন সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার বল্লভপুর গ্রামের প্রান্তিক কৃষক মতিন মিয়া। তাঁর এ উদ্বেগের সত্যতা পাওয়া যায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যে।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, অন্যান্য বছর এ সময়ে হাওরে ছয়-সাত হাজার হেক্টরের বেশি বোরো জমি চাষ হয়ে যায়। এ বছর এখন পর্যন্ত এর অর্ধেক জমিও চাষ হয়নি।
মতিন মিয়ার মতো হাওরের এ নতুন সংকট নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন এখন সুনামগঞ্জের প্রায় সাড়ে তিন লাখ কৃষক পরিবার। নিকট অতীতে তারা এমন সংকটের মুখোমুখি হয়নি। সরকার পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রথমবারের মতো প্রায় ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিলেও প্রাকৃতিক কারণে বিলম্বিত পানি নিষ্কাশনের কাজ করার সুযোগ নেই। তাই কৃত্রিম কারণে যেসব হাওরের পানি নামছে না, সেসব হাওরে বিচ্ছিন্নভাবে পানি নিষ্কাশনের কাজ চলছে।
যথাসময়ে বীজতলা না ভাসায় বীজতলা ছাড়াই উঁচু জমিতে বীজ ফেলছে কৃষকরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও হাওরের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত অক্টোবর ও নভেম্বরে সুনামগঞ্জে বৃষ্টিতে নদ-নদী ও হাওরের পানি বাড়ে। এ পানি এখনো নামছে না। অন্যান্য বছর নভেম্বরের শুরু থেকেই বীজতলা ভেসে ওঠে। এ বছর ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে এসেও বীজতলা ভাসেনি। কৃষি বিভাগ বড় হাওরগুলো থেকে পানি না নামায় চাষাবাদ নিয়ে আশঙ্কায় আছে। সূত্র জানায়, বড় হাওরগুলোর মধ্যে শনি, মাটিয়ান, সোনামোড়ল, কালিকোটা, পাকনার হাওর, দেখার হাওর, হালির হাওরসহ বড় হাওরগুলো থেকে এখনো পানি নামছে না। এসব হাওরের বীজতলা এখনো ডুবে আছে।
কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, ১ পৌষ থেকে ১৫ মাঘ পর্যন্ত বোরো আবাদের মৌসুম। ৪০ থেকে ৪৫ দিন বয়সী চারা লাগানো হয়ে থাকে বোরো ক্ষেতে। তবে জলাশয় শ্রেণির জমিতে দুই মাস বয়সী চারাও লাগায় সুনামগঞ্জের কৃষকরা। কিন্তু এবার বিলম্বে পানি নামায় বীজতলাও বিলম্বে ভাসে। ফলে ৩০ থেকে ৩৫ দিনের চারা এখন হাওরে লাগাচ্ছে কৃষকরা। এভাবে বিলম্বে পানি নামলে নিচু শ্রেণির জমি এবার পতিত থাকার আশঙ্কা করছে তারা।
সরেজমিন এসব হাওর ঘুরে দেখা গেছে, এখনো ফসলি জমিতে হাঁটুপানি জমে আছে। মাইলের পর মাইল বিস্তৃত হাওরের জমিতে পানি থইথই করছে। যে হারে পানি নামছে, এভাবে নামতে থাকলে ১৫ জানুয়ারির আগে ক্ষেত লাগানোর উপযোগী হবে না বলে কৃষকরা জানিয়েছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, জেলায় এ বছর দুই লাখ ২২ হাজার ৫৫২ হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। এ পর্যন্ত চাষ হয়েছে তিন হাজার হেক্টরের কম। অথচ অন্যান্য বছর এ সময়ে ছয় হাজার হেক্টরের বেশি আবাদ হয়ে থাকে।
জানা গেছে, এ সংকটের কারণে গত মাসে জাতীয় পত্রিকাগুলোতে বিরাট বিজ্ঞাপন দিয়ে চাষিদের করণীয় ও বীজতলা তৈরির পরামর্শ দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। গত ২৩ নভেম্বর পানিসম্পদমন্ত্রী এ বিষয়ে সুনামগঞ্জে হাওর পরিদর্শন করতে আসেন। ওই দিন তিনি সন্ধ্যায় সার্কিট হাউসে সুধীজনদের সঙ্গে মতবিনিময়সভায় পানি বিলম্বে নামার বিষয়টি স্বীকার করেন। স্থানীয় সুধীজন তাঁকে পানি নিষ্কাশনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানালে মন্ত্রী অনুষ্ঠানে জানান, পানি নিষ্কাশনের জন্য সরকার ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এ বরাদ্দ গত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহেই বিতরণ করা হয়েছে।
পাকনার হাওরের কৃষক চঞ্চল তালুকদার বলেন, ‘আমার পাঁচ-ছয় হাল জমি আছে। এখন পর্যন্ত ১ শতাংশ জমিও চাষ করতে পারিনি। ভাসেনি বীজতলাও। অথচ অন্যান্য বছর এ সময়ে অর্ধেক জমি আবাদ হয়ে যায়। ’ তিনি বলেন, এ বছর হাওরের বেশির ভাগ জমিই পতিত থাকবে।
একই এলাকার কৃষক সুশীল তালুকদার বলেন, ‘হাওরের এমন অবস্থা আমি আগে আর দেখিনি। এখনো বীজতলা ভাসেনি। কবে বীজ ফেলব আর কবে আবাদ করব! এবার কোনো কারণে হাওরে ফসল না হলে এ অঞ্চলের মানুষ বড় বিপদে পড়বে। ’
হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, এমন সংকটে হাওরবাসী আগে আর পড়েনি। ফসলহারা নিঃস্ব কৃষকের সামনে এখন কঠিন সময়। যদি এ বছর ফসল উৎপাদিত না হয়, তাহলে হাওরে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। বাংলাদেশের আরেক মঙ্গা এলাকা হবে সুনামগঞ্জ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক ভূইয়া বলেন, পানি বিলম্বে নামার এ সংকট হাওরবাসীর জন্য নতুন। এটা জলবায়ুজনিত। কারণ হাওর ও নদীর পানির লেভেল এখনো এক। তবে দিনে যেভাবে রোদ থাকছে তাতে পানি শুকাতে বেশি সময় লাগবে না। তিনি বলেন, হাওরের এ সংকট নিরসনে সরকার পানি নিষ্কাশনের জন্য যে ৩০ লাখ টাকা দিয়েছিল, তা বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জাহেদুল হক বলেন, ‘আমি অনেক হাওর ঘুরেছি। বীজতলা তৈরির ব্যবস্থা নেই। কারণ এখনো বড় হাওরগুলোর বীজতলা ভেসে ওঠেনি। তবে আমাদের পরামর্শে বিকল্প স্থানে বীজ ফেলে এখন চাষাবাদ করছে অনেক কৃষক। ’ তিনি বলেন, এ বছর এ সংকটের কারণে কম বয়সী চারা আবাদ করছে অনেকে।
সূত্র: কালের কন্ঠ