বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রবিষয়ক মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) এর সাম্প্রতিক এক জনমত জরিপে বলা হয়েছে, জরিপে দেখা যায়, ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর গত দেড় বছরে সরকার ও আওয়ামী লীগের প্রতি জনসমর্থন বাড়ছে। জরিপে অংশ নেওয়া লোকজনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন যথাক্রমে ৬৬ ও ৬৭ শতাংশ। দেশের সম্ভাবনার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে ৬২ শতাংশ মনে করছেন, দেশ সঠিক পথেই এগোচ্ছে। এ ছাড়া ৭২ শতাংশ মনে করেন, সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ইতিবাচক, ৬৮ শতাংশের মতে নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভালো এবং ৬৪ শতাংশ মনে করেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে।
অন্যদিকে দেশটির ৬৭ শতাংশ মনে করে আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল হওয়া উচিত। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের বিরোধী মাত্র ২২ শতাংশ লোক।
সংস্থাটির জরিপের ফলাফলে বলা দেখানো হয়, গত ২৩ মে থেকে ১০ জুন ১৮ থেকে বেশি বয়সের ২৫৫০ জন নারী-পুরুষ এই জরিপে অংশ নেন। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের অর্ধেক নারী এবং অর্ধেক পুরুষ। বাংলাদেশের সাতটি বিভাগে পরিচালিত জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৭৪ শতাংশ গ্রামে এবং ২৬ শতাংশ থাকেন শহরে।
গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ ও কনসোর্টিয়াম ফর ইলেকশনস অ্যান্ড পলিটিক্যাল প্রসেস স্ট্রেনদেনিংয়ের সহায়তায় আইআরআই নিয়েলসন-বাংলাদেশকে দিয়ে জরিপটি চালিয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশে জরিপ চালিয়ে আসছে আইআরআই।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নির্দলীয় সংস্থা আইআরআই ১৯৮৩ সালে যাত্রা শুরু করে। মার্কিন সিনেটর এবং ২০০৮ সালে সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী রিপাবলিকান পার্টির সদস্য জন ম্যাককেইন এখন আইআরআইয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
জানা যায়, গত মে ও জুনে পরিচালিত আইআরআইয়ের এই জরিপে আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে জরিপে অংশ নেওয়া লোকজনের বিপরীতমুখী অবস্থানটা বেশ স্পষ্ট। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৪৩ শতাংশ মত দিয়েছেন, যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করা উচিত। আবার ৪০ শতাংশ মনে করেন, বর্তমান সংসদকে পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া উচিত।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে পরিচালিত আইআরআইয়ের জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪০ শতাংশ মত দিয়েছিলেন যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের আয়োজনের। আর ৪৫ শতাংশ ওই জরিপে বর্তমান সংসদকে পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।
আইআরআইয়ের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী ও সরকার ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের কাজ নিয়েও জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের প্রশ্ন করা হয়েছিল। এর মধ্যে সেনাবাহিনী, র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যা ব), আদালত, নির্বাচন কমিশন, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কাজের প্রতি যথাক্রমে ৮৬, ৭৬, ৭৩, ৫৯, ৮৩ ও ৮০ শতাংশ উত্তরদাতা ইতিবাচক সমর্থন দিয়েছেন। উত্তরদাতাদের ৪৬ শতাংশ রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করেছেন। আবার ৪৬ শতাংশ বিরোধিতা করেছেন।
বিরোধী দলের কাজের বিরোধীদের সংখ্যা ৪৮ শতাংশ আর সমর্থকের সংখ্যা ৪১ শতাংশ। সংসদের কাজের প্রতি সমর্থন ও বিরোধিতাকারীর সংখ্যা যথাক্রমে ২১ ও ৬৭ শতাংশ।
দেশের প্রধান সমস্যা কী, তা জানতে চাইলে জরিপে উত্তরদাতাদের বড় অংশই দুর্নীতির কথাই বলেছেন। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ২৪ শতাংশ মনে করেন, দুর্নীতি দেশের প্রধান সমস্যা। এ ছাড়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা/আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে বড় সমস্যা হিসেবে দেখছেন যথাক্রমে ১৬ ও ১৫ শতাংশ উত্তরদাতা।
সরকারি সেবা পেতে কর্মকর্তাদের ঘুষ কিংবা উপহার দিতে হয় কি না জানতে চাইলে ৮৮ শতাংশ না সূচক উত্তর দিয়েছেন। আবার জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ১১ শতাংশ জানিয়েছেন, সরকারি সেবা নিতে গিয়ে তারা ঘুষ কিংবা উপহার দিয়েছেন। যারা ঘুষ কিংবা উপহার দিয়েছেন, তাদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ জানিয়েছেন, টাকার অঙ্কে ঘুষ কিংবা উপঢৌকনের পরিমাণ পাঁচ হাজার টাকার বেশি।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে বলে মনে করেন উত্তরদাতাদের ৪৮ শতাংশ। আর ২০ শতাংশ মনে করেন স্থিতিশীলতা থাকবে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপারে জানতে চাইলে উত্তরদাতাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন ও বিরোধিতার হার ৬০ ও ২৯ শতাংশ। বিএনপির প্রতি এই হার যথাক্রমে ৪২ ও ৪৬ শতাংশ। আর জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রতি এই হার একই, যথাক্রমে ২৫ ও ৬০ শতাংশ।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, অর্থনীতি সুদৃঢ়করণ, নিরাপত্তা জোরদার, জাতি গঠন, জাতিগত সহিংসতা রোধ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কেমন—প্রশ্ন করা হলে সব সূচকেই উত্তরদাতারা আওয়ামী লীগকে এগিয়ে রেখেছেন।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুরোপুরি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কি না জানতে চাইলে ৩৩ শতাংশ জোরালোভাবে এ মতের পক্ষে বলেছেন। আবার ২৫ শতাংশ জোরালোভাবে বিশ্বাস করেন, ইসি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নয়। ভোটাধিকার দেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে—এ প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে ৬৭ শতাংশ একমত হলেও ২১ শতাংশ এর সঙ্গে একমত নন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন প্রথম আলোকে জানান, আইআরআই তাদের ডেকেছিল, তাদের সামনেই তারা এ বিষয়ে একটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, এ জরিপে দুটি বিষয় এসেছে। এক, দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছে। দুই, তারা একটি দ্রুত নির্বাচন চেয়েছে। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল তামাশার নির্বাচন। বিএনপির এই নেতা বলেন, জরিপে এক জায়গায় বলা হয়েছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সরকারের প্রতি জনসমর্থন বাড়ছে। এটা জরিপের ফলাফলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ, সরকারের প্রতি সমর্থন বাড়লে মানুষ দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছে কেন?