হাওর বার্তা ডেস্কঃ শাকিল ভাইকে নিয়ে কিছু লিখতে গেলে এখন কোনো শব্দই খুঁজে পাই না, কখনোবা মনে হয় শাকিল ভাইকে নিয়ে লেখার মতো কোনো শব্দই আমার অভিধানে নেই। মানুষ হিসেবেও শাকিল ভাই তেমনই, মাঝেমধ্যে মনে হয় মানুষটিকে আমি খুব বেশি চিনতে পেরেছিলাম, আবার মনে হয় আমি তাকে আদৌ বুঝতে পারিনি। শাকিল ভাই আসলে কখনো ছিলেন বহুরূপী, কখনোবা বর্ণচোরা। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আমি যে শাকিল ভাইকে আবিষ্কার করেছিলাম তা হচ্ছে কোমল মনের শিশুসুলভ এক শাকিল ভাইকে।
শাকিল ভাইয়ের সাথে আমার ব্যবধান এক প্রজন্মের, যেকোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে বয়স প্রায়ই অন্যতম বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় অথচ শাকিল ভাইয়ের সাথে কাটানো সময়গুলোতে আমার কখনো মনে হয়নি আমাদের মাঝে বয়সের একটি পার্থক্য আছে, মনে হতো আমি আমার প্রিয় বন্ধুর সাথেই আছি, কখনো মনে হতো অগ্রজ সহোদর তার অনুজকে পরম মমতায় আগলে রেখেছেন। শাকিল ভাই যখন কারো সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন, তখন বলতেন, ‘ও হচ্ছে সুমন, আমার এবং আমার মেয়ে মৌপির বন্ধু’, এতোটাই ভালোবাসতেন আমাকে।
শাকিল ভাইয়ের সাথে আমার স্মৃতি অনেক, আমাদের স্মৃতির সাক্ষী হয়ে আছে প্যারিস, ভার্সাই, রোম, ভ্যাটিকান সিটি, ফ্রাঙ্কফুর্ট, সালজবুর্গ, ভিয়েনা, ব্রাটিসলাভা। এইসব শহরে রাত্রিবেলা আমার দুই ভাই গলা ছেড়ে গেয়েছি ‘ধনধান্যে পুষ্পেভরা আমাদেরই বসুন্ধরা’, ‘এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদীর তীরে’ গান দুটি। এই গান দুটি গাওয়ার সময় অঝোরে কাঁদতেন তিনি, আর আমাকে বলতেন, ‘তুই দেশ ছেড়ে এতোদূরে কিভাবে থাকিসরে সুমন? আমার যে এই কয়দিনেই দম বন্ধ হয়ে আসে, বাংলাদেশের বাতাস ছাড়া আমার ফুসফুস চলে না।’
একজন মানুষের দেশের প্রতি কতোটা প্রেম আর মমতা থাকলে এভাবে বলতে পারেন! এই ক্ষয়ে যাওয়া নষ্ট সমাজে শাকিল ভাই ছিলেন অনন্য।
আমি কবিতা এবং গানের ভীষণ ভক্ত, আমাদের দুজনের পছন্দের তালিকায় ছিলেন পিন্টু ভট্টাচার্য, শ্যামল মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুবীর সেন, এরিক ক্লেপ্টন, জন ম্যাকডিলান, জন এল্টন, লাকী আখান্দ, জীবনানন্দ দাশরা। জাভেদ আখতার, সাহীর লুদিয়ানভি, গুলজার ছিলেন আমাদের প্রিয় গীতিকবি। সম্ভবত এই পছন্দের ঐক্যতান আমাকে শাকিল ভাইয়ের এতো কাছে টেনে নিয়েছিলো। আমাদের গল্পের টেবিলে কখনো তাই আলোচনার রসদের অভাব ছিলো না। ইউরোপের শিল্প-সাহিত্যের শহরে আমরা পুরো রাত গল্প করে কাটিয়েছি এমনও হয়েছে, কখনো আমি মুগ্ধ শ্রোতা, কখনোবা তুমুল তর্ক-বিতর্ক। এই যে, আমি তাঁর সাথে কোনো বিষয়ে দ্বিমত করছি এ নিয়ে কখনো বড় হিসেবে আমার উপর তাঁর মত চাপিয়ে দেওয়ার কোনো মনোভাব শাকিল ভাইয়ের মাঝে ছিলো না। আমাদের তর্ক ছিলো মহাভারতের কর্ণ-অর্জুনকে নিয়ে, ছিলো হোমারের ইলিয়াডের প্যারিস-হেলেনের প্রেম নিয়ে, ছিলো রামায়ণের রাম-রাবণ নিয়ে। কখনো কখনো বিতর্কের মাঝে সিলসিলার জাভেদ আখতারের ‘ম্যা অর ম্যারি তানহায়ি’র’ স্বীয় অনুবাদে ‘আমি আর আমার একাকীত্বরা’ তার ভরাট এবং ক্লান্ত গলায় আবৃত্তি করতেন। আর আমিও সব তর্ক-বিতর্ক ভুলে তখন এক মুগ্ধ শ্রোতা আর মনে হতো এক ক্ষত-বিক্ষত ক্লান্ত এক যোদ্ধার বিষাদগাথা শুনছি আমি।
শাকিল ভাই ছিলেন রাজনীতির মানুষ, আমি নিজেও রাজনীতির সাথে জড়িত এবং আমরা একই রাজনৈতিক আদর্শ এবং দর্শনে বিশ্বাসী। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, ত্যাগ, শ্রমে শাকিল ভাইয়ের কাছে আমি নিতান্তই শিশু। তাই শাকিল ভাইয়ের সাহচর্যে রাজনীতির পাঠ নেওয়া থেকে আমি নিজেকে কখনোই বঞ্চিত রাখতে চাইতাম না। তাই, স্বভাবতই আমাদের আলোচনায় রাজনীতি চলে আসতো। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের এক সত্যিকারের সৈনিক ছিলেন তিনি, ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একজন বিশ্বস্ত যোদ্ধা। ভাই একটি কথা প্রায়ই বলতেন, ‘আমার পীরের নাম শেখ হাসিনা, আমি তার মুরিদ’, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এতোটাই ভালোবাসতেন।
আমি তখন ছুটিতে দেশে, শাকিল ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিবো বসে আছি। শাকিল ভাই আসলেন, মুখে তাঁর এক উজ্জ্বল হাসি। বললেন, ‘আমি কী খেয়ে এসেছি জানিস?’ আমি বললাম, ‘আপনার হাসি দেখেতো মনে হচ্ছে, আপনি অমৃত খেয়ে এসেছেন!’
ভাই বললেন, ‘আপা (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ) নিজের হাতে বানানো আলুচপ আর পিয়াজু খাইয়েছেন আমাকে’। আমি বললাম, ‘তবেতো আসলেই অমৃতের চেয়ে বেশি!’
বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন তাঁর ধ্যান-জ্ঞান।
শাকিল ভাই নিজেকে দাবি করতেন চন্দ্রাহত আর ভ্যান গখকে নিয়ে জন ম্যাকডিলানের গাওয়া ‘Starry starry night’ গানটি ছিলো তার ভীষণ পছন্দের। প্রকৃতির নিয়ম কি অদ্ভুত শাকিল ভাইকে যখন শেষ বিদায় জানিয়ে মন খারাপের গাড়ি করে ময়মনসিংহ থেকে ফিরছিলাম সেই রাতটিও ছিলো ‘Starry Starry’ আর চাঁদটিকেও মনে হচ্ছিলো বেদনাহত!
‘Starry starry night’ গানটির এই কয়েকটি লাইন অদ্ভুতভাবে মিলে যায় শাকিল ভাইয়ের সাথে। তাই লাইনগুলো উৎসর্গ করছি আমার প্রিয় শাকিল ভাইকে-
‘This world was never
Meant for one
As beautiful as you.’
ওপারে ভালো থাকবেন শাকিল ভাই…