সাংবাদিক সহায়তায় তহবিল গঠনে গণমাধ্যম মালিকদের ভূমিকা

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চারটি স্তম্ভের মধ্যে গণমাধ্যমকে একটি বলে বিবেচনা করা হয়। গণমাধ্যমকে বলিষ্ঠ রাখতে আমাদের সাংবাদিক বন্ধুরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। একটি সংবাদ তৈরি হবার সাথে সাথে সে সংবাদটি পাঠকের হাতে পৌঁছে দিতে তারা তৎপর হয়ে ওঠেন। সাংবাদিকতা একটি মর্যাদাপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং পেশা। বর্তমান সময়ে এ পেশার গুরুত্ব অপরিসীম। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সমাজ ও দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার সুযোগ এই পেশায় অনেক বেশি।

একজন সাংবাদিক তার নৈতিকতা ও নীতিবোধ থেকেই সাংবাদিকতা পেশায় আসে। তারা তাদের লেখায় সমাজের অনিয়মগুলো যেমন তুলে ধরেন তেমনি ভালো খবরটি পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে সর্বদা সচেষ্ট থাকেন। গণমাধ্যমকর্মীরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চেকপয়েন্ট হিসেবে কাজ করে থাকেন। প্রতি মুহূর্ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একজন সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহ করে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেন। দেশ বিদেশের নানা ধরনের খবর সাংবাদিকরা তুলে আনেন। তাদের প্রচারিত তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা, পেশাগত নৈতিকতা, নিরপেক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা হতে পারে একটি দেশের উন্নয়নের অংশীদার। অথচ সেই সকল সাংবাদিকের জীবনের অসহায় মুহুর্তে আমরা কতটুকু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই? শুধু সাধারণ জনগণ নয়, অনেক ক্ষেত্রে খোদ সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম মালিকদেরও সেই অসহায় পরিবারটির পাশে দাঁড়াতে দেখা যায় না। এ মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে, সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে তারা আহত বা নিহত হলে তাদের কিংবা তাদের পরিবারের প্রতি সকলের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে প্রণীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে সকল নাগরিকের চিন্তা ও বিবেক, বাক এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান গণমাধ্যমবান্ধব সরকার গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা ও কল্যাণে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ সরকার গণমাধ্যমকর্মীদের মর্যাদা, অধিকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৩ সালে অষ্টম সংবাদপত্র মজুরি বোর্ড (অষ্টম ওয়েজ বোর্ড) প্রণয়ন করেছে এবং এর বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের ভিত্তিতে ২০১৪ এর ২০ ফেব্রুয়ারি শিল্প মন্ত্রণালয় সংবাদপত্রকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।

গণমাধ্যমকে সমাজের দর্পন বলা হয়। তাই গণমাধ্যমকে গতিশীল রাখতে সরকার তার দায়-দায়িত্বের জায়গা থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সাংবাদিকদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। অসচ্ছল, অসুস্থ ও আহত সাংবাদিক এবং নিহত সাংবাদিকদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য সাংবাদিক সহায়তা ভাতা/অনুদান-২০১২ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকগণ এই নীতিমালার আওতাভুক্ত। আর্থিকভাবে অসচ্ছল সাংবাদিকগণ এবং মৃত্যুজনিত কারণে সাংবাদিক পরিবার এই ভাতা/অনুদানের জন্য বিবেচিত হবেন। সাধারণভাবে জনপ্রতি মাসিক দুই হাজার টাকা ভাতা হলেও বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মাসিক ভাতা চার হাজার টাকা এবং মৃত্যুজনিত, অসুস্থতা কিংবা দুর্ঘটনাজনিত চিকিৎসার ক্ষেত্রে এককালীন পঞ্চাশ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত অনুদান প্রদান করা হচ্ছে। অসংখ্য চাহিদার বিপরীতে সীমিত সম্পদের এই দেশে এ আর্থিক সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হলেও নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ।

তথ্য মন্ত্রণালয় স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় এবং প্রয়োজনে সরাসরি অসচ্ছল সাংবাদিক সহায়তা ভাতা/অনুদান মঞ্জুরি বাস্তবায়ন করছে। সারাদেশের সাংবাদিকদের এই সহায়তার আওতায় আনতে জেলা, ঢাকা মহানগর ও জাতীয় কমিটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এই কমিটির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে এ বছর ১৭৭ জনকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬২৩ জনকে দেওয়া মোট আর্থিক সহায়তার পরিমাণ ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

এর পাশাপাশি সরকার সাংবাদিকদের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে ‘বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট আইন ২০১৪’ এবং এর আলোকে ‘বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট বিধিমালা ২০১৫’ প্রণয়ন করেছে। এই ট্রাস্টের মাধ্যমে দুঃস্থ ও অসচ্ছল সাংবাদিকদের কল্যাণসাধন; পেশাগত কাজ করতে গিয়ে অক্ষম ও অসমর্থ সাংবাদিককে আর্থিক সাহায্য প্রদান; অসুস্থ সাংবাদিকদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা বা আর্থিক সাহায্য প্রদান; সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা;

দুর্ঘটনায় বা দায়িত্বপালনকালে কোনো সাংবাদিক গুরুতর আহত হলে তাকে বা তার মৃত্যু ঘটলে তার পরিবারকে সাহায্য প্রদান এবং অবসরপ্রাপ্ত প্রথিতযশা দুঃস্থ সাংবাদিক অথবা প্রয়াত প্রথিতযশা সাংবাদিকদের অসচ্ছল পরিবারের সদস্যদের আর্থিক সহায়তা প্রদান ও তাদের কল্যাণসাধন করা হবে। বাংলাদেশ ফেডারেল ইউনিয়ন অভ জার্নালিস্ট (বিএফইউজে) এর সহযোগিতায় এই ট্রাস্ট জেলা ও মহানগর ভিত্তিক সাংবাদিকদের তালিকা এবং অনুদান/ভাতা গ্রহীতার হালনাগাদ তালিকা সংরক্ষণ করবে।

এছাড়াও জনগণের মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতা সমুন্নত রেখে সম্প্রচার মাধ্যমসমূহের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার ‘জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা-২০১৪’ প্রণয়ন করেছে। এর ফলে সম্প্রচারিত তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা, পেশাগত নৈতিকতা ও নিরপেক্ষতা এবং সম্প্রচারের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতা তৈরি হবে।

এ বছরের ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিক সহায়তা ভাতা/অনুদান প্রদান উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিক সহায়তার জন্য স্থায়ী তহবিল গঠনে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টে সরকারের পাশাপাশি সম্পদশালী গণমাধ্যম মালিক ও সমাজের বিত্তশালীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তাঁর এই আহ্বানের মাধ্যমে সাংবাদিকদের কল্যাণ ও নিরাপত্তার বিষয়টি যেমন উঠে আসে তেমনি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দায়-দায়িত্বের বিষয়টিও ফুটে ওঠে।

একটা সময় ছিল যখন গণমাধ্যমের মালিকানার সাথে ব্যবসায়িক বিষয়টির তেমন সম্পর্ক ছিল না। এখন গণমাধ্যমের মালিকানার সাথে ব্যাবসায়িক সম্পর্ক যেমন রয়েছে তেমনি সামাজিক দায়বদ্ধতার (কর্পোরেট সোস্যাল রেসপনসিবিলিটি) সম্পর্কও রয়েছে। দেশের বড় বড় ব্যাবসায়ীদের অনেকেরই একটি করে সংবাদপত্র, অনলাইন মিডিয়া (নিউজ মিডিয়া), টিভি, রেডিও আছে। কারো কারো আবার একাধিকও রয়েছে। তাই এ ব্যাবসায়ীদেরও সাংবাদিক সহায়তার বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে, সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।

সরকার তার দায়িত্বের জায়গা থেকে সাংবাদিক সহায়তা ভাতা/অনুদান নীতিমালা এবং সর্বশেষ বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট আইন এবং বিধিমালা প্রণয়ন করেছে। আর এই সহায়তার জায়গাটুকুকে একটি নিশ্চিত নিরাপত্তার জায়গায় পৌঁছানোর দায়িত্ব আমাদের সকলের, বিশেষ করে গণমাধ্যম মালিকদের। সকল গণমাধ্যম মালিকদের অষ্টম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করা উচিত। সম্পদশালী গণমাধ্যম মালিক ও সমাজের বিত্তশালীদের সহযোগিতায় সরকারের এই সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টকে একটি স্থায়ী শক্তিশালী তহবিল রূপে গড়ে তোলাই আমাদের ব্রত হোক।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর