হাওর বার্তা ডেস্কঃ হাওরে এখন যে পরিমাণ পানি আছে অন্য বছর এ সময়ে তারচেয়ে অন্তত ৩ ফুট নিচে থাকত পানি। পৌষ মাস শুরু হওয়ার আগে এ পানি শুকিয়ে যেত। এরপর শুরু হতো জমিতে ধান রোপণের প্রক্রিয়া। আর এ সময়ে উঁচু জমিতে বীজতলা করা হতো। বাংলা ক্যালেন্ডারের হিসাব অনুযায়ী প্রান্তিক কৃষক জমি তৈরির জন্য প্রস্তুত হতেন। বীজ বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা জমি প্রস্তুতে ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু এবার জমি তৈরি তো দূরের কথা বীজতলা করার জায়গা-ই নেই সুনামগঞ্জের বড় সব কটি হাওরে। পাহাড়ি ঢলে হাওর এলাকার একমাত্র ফসল তলিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে এবার পানি উন্নয়ন বোর্ড আগাম বন্যা ঠেকাতে প্রস্তুতি নিয়েছে। কিন্তু জলাবদ্ধতা নিরসনে কোনো বাজেট রাখেনি। অথচ এবার প্রধান সমস্যা এ জলাবদ্ধতা।
উদ্ভূত এ পরিস্থিতিতে হাওরের পানি নিষ্কাশনে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের কাছে ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়েছেন। এ টাকা দিয়ে তিনি জেলার সব কটি হাওরের জলাবদ্ধতা নিরসন করবেন বলে মন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছেন । পানি নিষ্কাশনের যে টাকা চাওয়া হয়েছে সেটা সাময়িক। বাস্তবিক অর্থে সুনামগঞ্জের হাওর বাঁচাতে হলে মেগা প্রকল্প হাতে নিতে হবে। এতে অন্তত তিন হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন। ডিসি বলেন, সম্ভাবনাময় এ জেলাকে সাজাতে আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখন প্রয়োজন সবার সহযোগিতা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবার সুনামগঞ্জের ৫৩টি হাওরে প্রায় ৬৮০ কিলোমিটার বাঁধ সংস্কার করবে। এতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৬০ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত বছর যেসব ঠিকাদার কাজ করেনি তাদের দরপত্র বাতিল করে ১৭টি উপ-প্রকল্পের মাধ্যমে অনুন্নয়ন রাজস্ব খাতের আওতায় ২৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এ ছাড়া উন্নয়ন রাজস্ব খাতে কাজের বিনিময়ে টাকার (কাবিটা) আওতায় ৩১ কোটি ৫২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে নদী ড্রেজিংয়ে। জাদুকাটা, আপার বৌলাই, পুরাতন সুরমা ও রক্তি নদীর ৯৮ কিলোমিটার খননে ২১৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিকখাওর বার্তাকে বলেন, জেলার ১৮টি হাওরে ২৯টি রেগুলেটরের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশনের জন্য ১ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়। সেখানে ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দের আশ্বাস দিয়েছেন মন্ত্রী। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নদী ও হাওরের পানি সমতল। এর কারণ নদীর পানি কমছে খুবই ধীরগতিতে। নদীর পানি না কমলে হাওরের পানি কমবে না। হাওরের পানি না কমলে একদিকে কৃষক ধান রোপণ করতে পারবেন না, অন্যদিকে বাঁধ সংস্কারের কাজও শুরু করা কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, বাঁধ ভাঙার স্থান বা আয়তন যদি নির্দিষ্ট করা না যায় তাহলে কোন পিআইসি কতটুকু বাঁধ সংস্কার বা নির্মাণ করবে তা নির্ধারণ করা যাবে না। তাই পানি নামার সঙ্গে কৃষকের পাশাপাশি বাঁধ সংস্কারের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারাও বিপাকে আছেন।
পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ২২ নভেম্বর দু’দিনের সফরে সুনামগঞ্জের হালির হাওর, শনির হাওর, জলাংগাহাওর ও সোনামোড়ল হাওর পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি জলাবদ্ধতার বিষয়টি প্রত্যক্ষ করে কম সময়ে যে ধান ঘরে তোলা যায় সেই জাতের বীজ রোপণের পরামর্শ দেন। একমাত্র বি-আর ২৮ জাতের বীজ রোপণের জন্য স্থানীয় কৃষকদের অনুরোধ জানান তিনি।
সরেজমিন দেখা যায়, বড় বড় হাওরে যেন সবেমাত্র বর্ষা শুরু হয়েছে। নদী ও হাওরের পানি সমতল। এ সময় স্থানীয় কৃষকরা জানান, জলাবদ্ধতার কারণে এবার জমিতে ধান রোপণের কাজ অন্তত দেড় থেকে দুই মাস পিছিয়ে যাবে। একমাত্র বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ায় পেটের তাগিদে যেসব কৃষক কাজের সন্ধানে এলাকা ছেড়েছেন তারাও আর ফিরে আসেননি। জলাবদ্ধতার খবর পেয়ে তারা এবার আরও হতাশ।
শনির হাওরপারের গ্রাম তাহিরপুর উপজেলার রাজধর পুরের ফারুক হোসেন হাওর বার্তাকে বলেন, অন্য বছর এ সময় শনির হাওরের পানি আরও তিন ফুট নিচে থাকত। পৌষ মাস হচ্ছে এ হাওরে ধান রোপণের মোক্ষম সময়। এবার যে অবস্থা দেখছি, তাতে মাঘ মাসের শেষদিকে চাষ শুরু হতে পারে। মাঘ মাসের শেষের দিকে ধান রোপণ শুরু হলে আবার বর্ষা হওয়ার আগে ধান কাটা সম্ভব কিনা জানতে চাইলে ফারুক বলেন, একমাত্র বি-আর ২৮ জাতের বীজ রোপণ করা হলে ধান কাটা সম্ভব। তবে বেশি ফলনের আশায় এ এলাকার কৃষক বি-আর ২৯ বা অন্য জাতের বীজ রোপণ করেন। বেশি ফলনশীল বীজের ধান পাকতে সময় বেশি লাগে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে এ কৃষক বলেন, বি-আর ২৮ বীজ ২৫-৩০ দিনের মধ্যে পেকে যায়। আর ২৯ জাতের বীজ পাকতে সময় লাগে সর্বোচ্চ দুই মাস।
২৩ নভেম্বর জেলার সার্কিট হাউসে বন্যা-পরবর্তী হাওর মেরামত ও সংরক্ষণ বিষয়ে মতবিনিময় সভায় জেলার বড় বড় হাওরে জলাবদ্ধতার সমস্যা নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা ও গণ্যমান্য ব্যক্তি মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জলাবদ্ধতাকে বড় সমস্যা উল্লেখ করে সুনামগঞ্জ সদর আসনের এমপি পীর ফজলুর রহমান মিজবাহ বলেন, এ সময়ে পানি যা নেমে যাওয়ার কথা তার চেয়ে অনেক বেশি রয়ে গেছে। সব কটি বড় হাওরে পানি এখনও অনেক বেশি। তাই পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা জরুরি হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, হাওরের জলাবদ্ধতা নিরসন না করা গেলে হাওরের মানুষের বিপর্যয় কাটবে না। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন পানি নিষ্কাশন। হাওরের কৃষকরা জানিয়েছেন, যে সময়ে তারা বীজতলা তৈরি করেন সেখানেও এখন পানি। তিনি উঁচু স্থানে বীজতলা তৈরির আহ্বান জানিয়ে বলেন, পানি নামতে যদি দেরি হয় তাহলেও প্রস্তুতি রাখতে হবে। যাতে করে পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বীজ রোপণ করা যায়।
ধর্মপাশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুন খন্দকার বলেন, ‘পানি নিষ্কাশন করার উদ্যোগ না নেয়া হলে সময়মতো কৃষক ধান রোপণ করতে পারবেন না।’ তিনি বলেন, ‘শুধু ধর্মপাশা উপজেলা সীমানায়ই প্রায় ৩শ’ কিলোমিটার বাঁধে কাজ হবে। সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন সুপারভিশন কর্মকর্তা (এসও) আছেন। একজন এসও দিয়ে এ দীর্ঘ হাওর রক্ষাবাঁধ পর্যবেক্ষণ করা যাবে না।’ তিনি মতবিনিময় সভায় উপস্থিত পানিসম্পদমন্ত্রীর কাছে অতিরিক্ত আরও কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়োগের দাবি জানান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বড় হাওরের মধ্যে সোনামোড়ল, চন্দ্রসোনারথাল, কাইলানি, ঘোড়াডোবাসহ ৯টি হাওর এখনও অনেক পানির নিচে।
এদিকে দিরাই ও শাল্লা উপজেলার বরাম, ছায়ার হাওর, কালিয়াঘোটা, চাপতি, জগন্নাথপুরের নলুয়ার হাওর, সুনামগঞ্জ সদর ও ছাতক উপজেলার দেখার হাওর ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জের সঙ্গার হাওর ঘুরে ভরা মৌসুমের মতো পানি দেখা গেছে।
পাউবোর সুপারভিশন কর্মকর্তা সংকটের বিষয়টি তুলে ধরেন দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মঈন উদ্দিন ইকবাল। মতবিনিময় সভায় জেলার সব কটি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা একের পর এক পাউবোর লোকবলের অভাবের কথা তুলে ধরেন। একপর্যায়ে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে থামিয়ে এ বিষয়ে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, এবার প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে বাঁধ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকবল সংকটের বিষয়টি সবাই তুলে ধরেছেন। এ জনবল দিয়েই পানি উন্নয়ন বোর্ড দীর্ঘ বছর ধরে বাঁধ সংস্কারসহ হাওর রক্ষায় কাজ করেছে। তিনি বলেন, গত বছর মিডিয়া বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির তথ্য তুলে ধরেছে। দুর্নীতি হয়েছে কিনা সে বিষয়ে কোনো কথা বলব না। কারণ দুর্নীতি দমন কমিশন এ বিষয়ে তদন্ত করছে। আমি শুধু বলব পাউবোর জেলার কয়েকজন কর্মকর্তা এতদিন এ অসাধ্য কাজটি করেছেন। মন্ত্রী বলেন, ১৯ হাজার লোকবলের মধ্যে এখন ৯ হাজার লোক নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যক্রম চলছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের দাবির সঙ্গে একমত হয়ে মন্ত্রী আরও কয়েকজন কর্মকর্তা পদায়নের প্রতিশ্রুতি দেন। ধানের বীজ পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে কৃষকদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, প্রকৃতির ওপর আমাদের কোনো হাত নেই। হাওর নিয়ে আমাদের নতুনভাবে ভাবতে হবে। বেশি ফলনের আশায় যে কৃষক বি-আর ২৯ বীজ রোপণ করেন তা পরিবর্তন করে বি-আর ২৮ জাতের বীজ রোপণ করতে হবে। তাতে অন্তত ৩৫ দিন আগে ধান কাটতে পারবেন।