হাওর বার্তা ডেস্কঃ ভাটি অঞ্চল নদীবিধৌত ও জোয়ার-ভাটা দ্বারা প্লাবিত নিম্নাঞ্চল। বাংলা ভাটা বা ভাটি শব্দ থেকে ‘ভাটি অঞ্চল’’ নামের উৎপত্তি। বাংলাদেশ নদী মাতৃক দেশ। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্রের মতো বৃহৎ নদীগুলো এবং তাদের অসংখ্য শাখা সমগ্র পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এ অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকাকেই বছরের অর্ধেকের চেয়ে বেশি সময় প্লাবিত করে। তাই গবেষকগণ বাংলার বিভিন্ন অংশকে ভাটিরূপে শনাক্ত করেন। বাংলায় সুলতানী আমলের শেষে এবং মুগল শাসন প্রতিষ্ঠার লগ্নে ভাটির বারো ভূঁইয়া মুগলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুগল দরবারি লিখিত উৎস ও ইউরোপীয়দের বর্ণনা দ্বারা বাংলার ভাটি অঞ্চল শনাক্ত করা যেতে পারে।
ইংরেজ পরিব্রাজক রালফ ফিচ ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে তান্ডা পৌঁছেন এবং সেখান থেকে শ্রীপুর, বিক্রমপুর, এবং সোনারগাঁও অঞ্চল ভ্রমণ করেন। তাঁর দেয়া তথ্যগুলি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। তিনি ভাটি এলাকার প্রামাণ্য চিত্র তুলে ধরেন। তাঁর মতে, ভাটি নদী-নালা বেষ্টিত হওয়ায় বারো ভূঁইয়া অনেক দিন ধরে মুগল আক্রমণ প্রতিহত করতে সমর্থ হয়। জেমস গ্রান্ট হিজলী, যশোহর এবং বাকেরগঞ্জকে ভাটির অন্তর্ভুক্ত করেন। হেনরী ব্লকম্যান ফার্ডিনান্ড হুগলি থেকে মেঘনা নদী পর্যন্ত সমগ্র এলাকাকে ভাটি হিসেবে চিহ্নিত করেন। অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলা ও ঐতিহাসিকদের বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের কারণে ভাটির শনাক্তীকরণ নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।
আবুল ফজল এবং মির্জা নাথান মুগল ও বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের বিবরণ দিয়েছেন। তাঁদের রচিত গ্রন্থে ভাটির পরিচয় পাওয়া যায়। আবুল ফজল আকবরনামা ও আইন-ই-আকবরীতে ভাটির যে সংজ্ঞা প্রদান করেন তা অত্যন্ত জটিল ও দুর্বোধ্য। আকবরনামা’য় বর্ণিত ভাটি পূর্ব-পশ্চিমে ৪০০ ক্রোশ এবং উত্তর-দক্ষিণে ৩০০ ক্রোশ পর্যন্ত বিস্তৃত। যার মধ্যে সুন্দরবন ও মেঘনা নদী অর্ন্তভুক্ত। কিন্তু আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে তিনি ভাটি সম্পর্কে বলেন, সুবাহ বাঙালা চট্টগ্রাম থেকে তেলিয়াগড়ি পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিমে ৪০০ ক্রোশ এবং উত্তরে পর্বতমালা থেকে দক্ষিণে মান্দারণ (হুগলি জেলা) পর্যন্ত উত্তর-দক্ষিণে ২০০ ক্রোশ বিস্তৃত। তিনি বলেন ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে মুগল বাহিনী ‘কিয়ারা সুন্দর’ অতিক্রম করে ’কস্ত্তল’ এর নিকটে ঈসা খানকে পরাজিত করেন। ‘কিয়ারা সুন্দর’ এর বর্তমান শুদ্ধনাম এগারসিন্ধুর। যা কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার ব্রহ্মপুত্রের তীরে অবস্থিত। দ্বিতীয় স্থান ’কস্ত্তল’ (সম্ভবত বর্তমান নাম কাসতাইল), একই জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলা এর দুই মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। সেনাপতি শাহবাজ খান এর নেতৃত্বে ঈসা খানের বিরুদ্ধে পরবর্তী যুদ্ধ হয় ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে। যুদ্ধক্ষেত্র ছিল সোনারগাঁ, খিজিরপুর ও কত্রাবো। যুদ্ধে মুগল শক্তিকে পর্যুদস্ত করার পর ঈসা খান নিজে মসনদ-ই-আলা উপাধি গ্রহণ করেন। আকবরনামায় বর্ণিত ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে মানসিংহ এর যুদ্ধের ক্ষেত্র ছিল বিক্রমপুর ও শ্রীপুর।
ইসলাম খান চিশতী ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে বাংলার সুবাহদার নিযুক্ত হন। তিনি কয়েক মাস পর রাজমহল এ আসেন এবং বারো ভূঁইয়াদের দমনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন মির্জা নাথান। মির্জা নাথানের বাহারিস্তান-ই-গায়বীতে ভাটির উল্লেখ আরও স্পষ্ট। নাথান প্রথমেই বলেন যে, ইসলাম খান চিশতী প্রধানতঃ ভাটি আক্রমণের উদ্দেশ্য নিয়েই রাজমহল ত্যাগ করেন। কিন্তু মুসা খান ঢাকার ত্রিশ মাইল পশ্চিমে ইছামতী নদীর তীরে অবস্থিত যাত্রাপুরে সর্বপ্রথম মুগলদের বাধা দেন। যাত্রাপুর চাঁদ প্রতাপ পরগনায় অবস্থিত। চাঁদ প্রতাপ পরগনা বর্তমান মানিকগঞ্জ জেলার ধলেশ্বরী নদীর উত্তর-দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। এ পরগনার জমিদার ছিলেন বিনোদ রায়। অর্থাৎ মুসা খানের যাত্রাপুর বারো ভূঁইয়াদের (ঈসা খানের মৃত্যুর পর বারো ভূঁইয়াদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন মুসা খান) নিয়ন্ত্রিত সীমানার মধ্যে অবস্থিত। তাই ভাটির পশ্চিম সীমা হল যাত্রাপুর বা চাঁদ প্রতাপ পরগণা বা ইছামতি নদী। মির্জা নাথান ও রালফ ফিচের প্রদেয় বর্ণনা অনুযায়ী ভাটির দক্ষিণ সীমা গঙ্গা (পদ্মা) নদী।
আইন-ই-আকবরীতে বলা হয়েছে ভাটির পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য। কিন্তু ভাটির উত্তর সীমা নির্ধারণ করার মতো কোন তথ্য আবুল ফজল বা মির্জা নাথানের বক্তব্যে নির্দিষ্টভাবে পাওয়া যায় না। তবে আকবরনামায় ঈসা খানের যুদ্ধ বিগ্রহের বর্ণনা অনুযায়ী আলপসিংহ পরগণা (বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা) ভাটির অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে মনে হয়। ভাটির উত্তর-পূর্ব সীমানা নির্ধারণ করার সহায়ক একটি বক্তব্য বাহারিস্তান-ই-গায়বীতে পাওয়া যায়। এতে বলা হয় বানিয়াচংয়ের জমিদার আনওয়ার খান (বা আনওয়ার গাজী) ঢাকায় মুগলদের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। মির্জা নাথান আনওয়ার খানকে মুসা খানের মিত্র জমিদার বলে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং বানিয়াচং (বৃহত্তর সিলেট) ভাটির অন্তর্ভুক্ত ছিল। অতএব, ভাটির উত্তর-পূর্ব সীমা বানিয়াচং পর্যন্ত।
ভাটি নিম্নাঞ্চল ও নদী-নালায় পরিপূর্ণ। তাই বর্ষা মৌসুমে ভাটি অঞ্চল বেশিরভাগ সময় জলমগ্ন থাকে। জলাবদ্ধতার কারণে আকবর এর সেনা বাহিনী বার বার ভাটির জমিদারদের নিকট পর্যুদস্ত হয়েছে। কিন্তু ইসলাম খান তাঁর সর্বশক্তি ভাটির বিরুদ্ধে নিয়োগ করেন। তিনি শক্তিশালী নৌবহর গঠন করেন এবং ভাটির জমিদারদের এমনভাবে পরাজিত করেন যে তারা আর বিদ্রোহ করতে পারেনি।
১৬২৪ খ্রিস্টাব্দে যুবরাজ শাহজাহান রাজমহলের যুদ্ধে জয়লাভ করেন এবং সুবাহদার ইবরাহিম খান ফতেহ জঙ্গ কে হত্যা করেন। অতঃপর শাহজাহান ঢাকায় সাতদিন অবস্থান করে বাংলার শাসন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে পুনর্গঠন করেন। তিনি বাংলা ও কামরূপকে চারটি সুবায় বিভক্ত করেন। যেমনঃ সুবা ভাটি, সুবা যশোহর, সুবা রাজমহল এবং সুবা কামরূপ। সুবা ভাটি ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, ত্রিপুরা এবং ভুলুয়া নিয়ে গঠিত ছিল। তিনি দারাব খানকে ভাটির সুবাহদার নিয়োগ করেন। এক বছরেরও কম সময় এ ব্যবস্থা টিকে ছিল।
আকবরনামা ও বাহারিস্তান-ই-গায়েবীতে প্রদত্ত যুদ্ধ বিগ্রহের বিস্তারিত বিবরণের ভিত্তিতে ভাটি অঞ্চল হলো পশ্চিমে ইছামতি নদী, দক্ষিণে গঙ্গা (পদ্মা) নদী, পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য এবং উত্তরে বৃহত্তর ময়মনসিংহসহ উত্তর-পূর্বে সিলেটের বানিয়াচং। তিনটি বড় নদী গঙ্গা (পদ্মা), ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা ও তাদের শাখা-প্রশাখা বিধৌত ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা ও সিলেট বেষ্টিত নিম্নাঞ্চল হলো ভাটি অঞ্চল।