হাওর বার্তা ডেস্কঃ ২০০৯-১০ সাল নাগাদ প্রথম হাসান আজিজুল হকের খাঁচা পড়েন আকরাম খান। পড়ার সময়ই চোখের সামনে গল্পের চরিত্রগুলোকে দেখতে পাচ্ছিলেন। তখনই ঠিক করেন গল্পটা নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। তখনই গল্পের প্রধান পুরুষ চরিত্র আম্বুজাক্ষের ভূমিকায় আজাদ আবুল কালামকে ভেবে রেখেছিলেন। আকরাম খানের মতো আজাদ আবুল কালামও হাসান আজিজুল হক ভক্ত। তাই সহজেই রাজি হয়ে গেলেন। তবে আকরাম খান তখন অন্য একটি সিনেমার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাই তখনই এই গল্প নিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়নি। ২০১২ সালে হাসান আজিজুল হক ঢাকায় এলে নিজের আগ্রহের কথা জানান আকরাম খান। হাসান আজিজুল হক অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘তোমার জন্ম কত সালে ?’
‘১৯৭৪ সালে। ’ ‘আর এই গল্প লেখা কত সালে?’ ‘১৯৬৭ সালে। ‘আর গল্পের পেক্ষাপট কত সালে?’ ‘১৯৪৭ সাল। ’‘৪৭-এর পেক্ষাপট, ৬৭-তে লেখা। আর তোমার জন্ম ৭৪-এ। তুমি এটা নিয়ে সিনেমা করার কথা কেন ভাবলে ?’ ‘৪৭-এর প্রেক্ষাপট, ৬৭-তে লেখা হলেও গল্পের বিষয়বস্তু সমসাময়িক। বিশ্বজুড়ে এখনো দেশান্তরের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া আপনার গল্প পড়ে আমি মধ্যবিত্ত বাঙালিদের জীবন উপলব্ধি করতে পেরেছি। ’
উত্তর শুনে খুশি হয়েই অলিখিত সম্মতি দিয়েছিলেন হাসান আজিজুল হক। এরপর ২০১২ সালের শেষদিকে আজাদ আবুল কালাম একটি খসড়া চিত্রনাট্য লিখে ফেলেন। আকরাম খান কিছু পরিবর্তন এনে চূড়ান্ত করেন মূল চিত্রনাট্য। শুরু হয় প্রযোজক খোঁজা। কিন্তু চলচ্চিত্রটির ব্যবসায়িক দিক না থাকায় কোনো প্রযোজক আগ্রহ দেখায়নি। এমন অবস্থায় ২০১১-১২ অর্থবছরে চিত্রনাট্যটি জমা দেওয়া হয় সরকারি অনুদানের জন্য। সরকারি অনুদান পাওয়ার পর ২০১৫-এর মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয় শুটিং, শেষ হয় ২০১৬ সালের মাঝামাঝি। আর মুক্তি পায় ২২ সেপ্টেম্বর। উল্লেখ্য, সিনেমাটি ১৭০ মিনিটের।
গল্পের জায়গাজমি
নড়াইলের লোহাগড়ার ইটনার হাজরা বাড়িতে খাঁচা সিনেমার প্রায় ৮০ শতাংশ শুটিং হয়েছে। এই লোকেশন খুঁজে বের করতে সময় লেগেছে এক বছরের বেশি। আকরাম খান জানান, ‘এমন একটা বাড়ি খুঁজছিলাম, যেটা অনেক পুরানো ও বাস অনুপযোগী। সেই সঙ্গে বাড়ির আশপাশে যেন বন-জঙ্গলের মতো বাসা বাঁধা থাকে। আর লম্বা বারান্দা ও পুকুর। এমন একটা বাড়ির জন্য অনেককে বলে রেখেছিলাম। তাঁরা ছবি তুলে পাঠাতেন। পছন্দ হলে সেই বাড়ি গিয়ে দেখে আসতাম। এভাবে চলল কয়েক মাস। কিন্তু মনমতো বাড়ি পাচ্ছিলাম না। একদিন সহকারী পরিচালক রাকিব জানল, নড়াইলে এমন প্রচুর বাড়ি আছে। আমি তাকে লোক পাঠিয়ে ছবি তুলে পাঠাতে বললাম। কয়েকটি ছবি পাঠাল, কিন্তু একটাও আমার পছন্দ হয়নি। তারপর একদিন সে ইটনার এই বাড়ির ছবি পাঠাল। ছবি দেখে পছন্দ হলো। চলে গেলাম সেই বাড়িতে। বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখার পর আমার পছন্দ হলো। তারপর ঠিক করলাম এখানে শুটিং করব। এখানে শুটিং করার আরো একটি কারণ ছিল—এলাকাটা নিরিবিলি, সেই সঙ্গে পুরাতন জিনিসপত্র সংগ্রহ করা সহজ ছিল। ’ এ ছাড়া মুন্সীগঞ্জের দোহার ও নাটোরের রানী ভাবানীর প্রাসাদের একাংশে শুটিং হয়েছে।
খাঁচার সাজসরঞ্জাম
খাঁচা সিনেমায় একটি বক্স ক্যামেরা দেখানো হয়েছে, সে ক্যামেরাটি অনেক বছরের পুরানো। এই ক্যামেরায় কোনো প্রকার ফোকাস নেই। নেই কোনো আধুনিক সুযোগ সুবিধা। শুধু সূর্যের আলোর সাহায্যে ছবি তোলা যায়। এমন ক্যামেরার সংখ্যা এখন বাংলাদেশে হাতে গোনা। খাঁচা যেহেতু ১৯৪৭-৬৪ সালের দৃশ্যপটে বানানো হয়েছে, সেহেতু এমন একটি ক্যামেরার প্রয়োজন ছিল। এমন প্রশ্নে পরিচালক জানালেন, ‘অনেক খোঁজ নিয়ে আমি ফটোগ্রাফি প্রতিষ্ঠান পাঠশালায় যোগাযোগ করি। সেখান থেকে জানতে পারলাম পুরান ঢাকায় একজনের কাছে এমন একটা ক্যামেরা আছে। আমার এক সহকারীকে পাঠালাম। অনেক অলিগলি পার হয়ে খুঁজে পেল তাঁকে। কিন্তু মালিক ক্যামেরা নিতে রাজি না। অনেক বোঝানোর পর আর ঠিকঠাক ক্যামেরার যত্ন নেওয়া হবে, এই নিশ্চয়তা দেওয়ায় উনি রাজি হলেন।
খাঁচা সিনেমায় চেয়ার, খাট, আলমারি, কাঁসার বাটি, ল্যাম্প, চিনা মাটির কাপ, দলিলসহ আরো অনেক বছরের পুরনো জিনিসপত্র ব্যবহার হয়েছে, দুর্লভ এসব জিনিসপত্রের প্রায় সব সংগ্রহ করা হয়েছে ইটনা থেকে। আকরাম জানালেন, ‘আমরা প্রায় এক বছর ধরে এসব জিনিসপত্র একটা রুমে রাখতাম। প্রথমে আমাকে ছবি তুলে এসব জিনিস দেখানো হতো। প্রয়োজন মনে হলে সংগ্রহ করে রাখতে বলতাম। আর একটা কথা বলতেই হয়, এই এলাকার মানুষের কাছে আমার টিম কৃতজ্ঞ। তারা আমাদের শুটিংয়ে অনেক সাহায্য করেছে। প্রয়োজনে নিজেদের জিনিসপত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন। তাদের কারণেই আমরা এসব জিনিসপত্র সংগ্রহ করে ব্যবহার করতে পেরেছি। ’
গরুর গাড়ি এখন আর তেমন দেখা যায় না। শুটিংয়ের জন্য দশ কিলোমিটার দূর থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল গরুর গাড়ি। আর সেই কারণেই সব কিছু প্রস্তুত থাকার পরও একদিন শুটিং প্রায় সবাইকে দুই ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়েছিল আকরাম খান জানালেন, ‘নাটোরে যেখানে গরুর গাড়ির দৃশ্যের শুটিং করেছি সেখানে তেমন রাস্তা ছিল না। প্রায় সব রাস্তাই কাঁচা। তাই অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। শুটিংয়ের সময় যখন কিছুদূর যাওয়ার পর কাট বলি, কিন্তু শট মনমতো না হওয়ায় টেক টু নিতে হয়। তখন সবাই আগের জায়গায় এলেও গরুর গাড়ি আগের জায়গায় নিয়ে আসা সম্ভব হতো না। কারণ গরু পেছনের দিকে চলে না। তাই অনেক রাস্তা ঘুরিয়ে আমাদের গরুর গাড়িকে আবার সেই দৃশ্যের জন্য প্রস্তুত করতে হতো, যা ছিল অনেক সময়সাপেক্ষ। এ ছাড়া দৃশ্যের প্রয়োজনে ছইওয়ালা নৌকা দরকার ছিল। অনেক খোঁজার পরও পাইনি। শেষমেশ আমরা নিজেরা একটা ছই বানিয়ে নিলাম।
দশ কিলোমিটার দূর থেকে বিশাল দেহের মইশাল গরুর গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এসেছেন। মাথায় লাল গামছা। তাঁর ধারণা, তাঁকে শুটিংয়ে নেওয়া হবে। এত পথ ভ্রমণ করে তিনি যখন জানতে পারলেন তাঁকে শুটিংয়ে রাখা হচ্ছে না, খুব মন খারাপ করলেন। তাঁকে জানানো হলো এমন দৃশ্যের জন্য একজন সরু মইশালের প্রয়োজন। অনেক বোঝানোর পর রাজি হয়েছিলেন তিনি। সিনেমায় গরুর গাড়ি চলার জন্য ধানক্ষেতের মধ্যে যে রাস্তা দেখানো হয়েছে, সেই জায়গার দৃশ্য ধারণের সময় ঘটেছিল মজার ঘটনা। দৃশ্যটা এমন—দুই ধারে ধানক্ষেত, মাঝ দিয়ে কাঁচা রাস্তা দিয়ে গরুর গাড়ি যাবে। দৃশ্য ধারণের সময় দেখা গেল ক্যামেরাতে একটা আধুনিক প্রাচীর দেখা যাচ্ছে। শুটিং বন্ধ করা হলো। সেই দেয়ালের সামনে বেড়া দেওয়া হলো কয়েক ঘণ্টা ধরে। আধুনিকতার সেই ছাপ মুছে তারপর শুরু হলো শুটিং।
অস্কারে খাঁচা
খাঁচা আকরাম খানের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র। আগে ঘাসফুল নামের একটি চলচিত্র পরিচালনা করেছেন। নিজের দ্বিতীয় চলচ্চিত্রই ৯০তম অস্কারে দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। ‘অস্কারে অনেক ভালো ভালো সিনেমা যায়। আমি জানি না সেখানে আমার সিনেমার অবস্থান কী হবে। তবে আমি মনে করি খাঁচার মতো একটা সিনেমা অস্কারে যাওয়ায় আমাদের দেশে যে জীবনঘনিষ্ঠ ও দায়বদ্ধ ব্যাপার নিয়ে বিশুদ্ধ সিনেমাচর্চা হয় এটা বিশ্বকে দেখানোর একটা সুযোগ হয়েছে। এ ছাড়া আমার কাছে মনে হয় গল্পটা ৪৭-এর হলেও দেশান্তর এখনো যেহেতু বিশ্বজুড়ে চলছে অস্কারের জুরিরা এই বিষয়টি কানেক্ট করতে পারবেন। ’ পরপর দুইটা সিনেমা করার পর আকরাম খান এখন পড়ালেখা করছেন ইতিহাস নিয়ে। নতুন সিনেমার কাজ করতে চান বিশ শতক থেকে ষাটের দশকের কোনো প্রেক্ষাপট নিয়ে।
সংক্ষেপে খাঁচা
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর এ দেশের এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবার ভারতের এক মুসলমান পরিবারের সঙ্গে বাড়ি বদল করার চেষ্টা করে। কিন্তু ঘটনার একপর্যায়ে ভাগ্যের ফেরে আটকে যায় তারা। মূলত দেশ ভাগ হওয়ার পর যারা আটকে পড়ে, তাদেরই গল্প বলার চেষ্টা করা হয়েছে এ পরিবারটির মাধ্যমে। খাঁচা চলচ্চিত্রের প্রধান পুরুষ চরিত্র আম্বুজাক্ষের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আজাদ আবুল কালাম। ছবির প্রধান নারী চরিত্র সরোজিনীর ভূমিকার অভিনয় করেছেন জয়া আহসান।