নিঃস্ব হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সাধারণত শহরের মানুষের তুলনায় গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে উন্নয়নের মানদন্ড হিসেবে ধরা হয়। গ্রামের উন্নতি মানে দেশের উন্নতি। গ্রাম বাঁচলে দেশ বাঁচবে- এমন একটি শ্লোগানও প্রচলিত রয়েছে। অন্যদিকে শহরের জীবনযাপন গ্রামের চেয়ে উন্নত হবে- এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। গ্রামে বসবাসকারী প্রান্তিক পর্যায়ের একজন মানুষও তা জানে। তারা এটাও জানে, শহরে জীবনযাপন এবং বসবাস করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। শহরের ছিন্নমূল মানুষ বাদে যাদের স্বপ্ন সত্যি হয়, তারাই কেবল শহরে বসবাস করতে পারে। আমাদের দেশে গ্রামের মানুষের মধ্যে সাধারণ একটি ধারণা রয়েছে, শহরে যারা বসবাস করে, তারা বড়লোক। মোটামুটি স্বচ্ছল না হলে শহরে মানসম্মানের সাথে বসবাস করা যায় না। শহরের জীবন মানেই ব্যয়বহুল, শানশওকত ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধায় ভরা। শিক্ষা-দীক্ষা, আয়-রোজগার, উন্নত চিকিৎসা, বিনোদন, অর্থনৈতিক উন্নতির দিক দিয়ে গ্রামের চেয়ে শহর সবসময়ই এগিয়ে। গ্রামের মানুষের এ ধারণা অমূলক নয়। ঢাকার ক্ষেত্রে তো নয়ই। এমনিতেই দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে জীবনযাত্রার ব্যয়ের দিক থেকে ঢাকা শীর্ষস্থানে রয়েছে। এমনকি কানাডার টরেন্টো শহরের জীবনযাত্রার ব্যয়ের তুলনায় ঢাকায় ব্যয় বেশি। এ চিত্র যুক্তরাজ্য ভিত্তিক দ্য ইকোনোমিস্ট পত্রিকার ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-এর জরিপে উঠে এসেছে। তবে বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সম্প্রতি প্রকাশিত খানা আয় ও ব্যয়ের জরিপ-২০১৬ প্রতিবেদনে এবার ভিন্নচিত্র পাওয়া গেল। যেখানে দেখা যায়, শহরের তুলনায় গ্রামে নিত্যপণ্যের দাম বেশি। মূল্যস্ফীতিও বেশি। গ্রামের মানুষের আয়ের তুলনায় ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের আয় কমে গেছে। আয় ও ব্যয়ের ঘাটতি মেটাতে স্বাভাবিক জীবনযাপন সংকুচিত করতে হচ্ছে। ঋণ করে বা সঞ্চয় থেকে থাকলে তা ভেঙ্গে ব্যয় মিটাচ্ছে। বড়ই দুর্দশার মধ্যে কাটছে তাদের জীবন। গ্রামের মানুষের এই টানাপড়েনের অর্থ হচ্ছে, তাদের আয়-রোজগার কমে গেছে। যা আয় করছে, তা দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে করতে পারছে না। প্রয়োজনের চেয়ে কম কিনে আয়ের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এক কেজির জায়গায় আধা কেজি কিনছে। এ চিত্র তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যাদের প্রতিদিনের আয় রয়েছে। গ্রামের কর্মজীবীদের সবার প্রতিদিনের আয় থাকে না। মাঝে মাঝে বেকার থাকতে হয়। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায়, এ শ্রেণীর মানুষ বেশি কষ্টের মধ্যে পড়ছে। আয়ের গ্যাপ পূরণ করার জন্য ধার-দেনা করে চলতে হচ্ছে। যৎসামান্য সঞ্চয় ভেঙে চলতে হচ্ছে। এই সঞ্চয়ও শেষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ এক-দেড় দশক আগে গ্রামের মানুষ যা আয় করত, তা দিয়ে প্রয়োজন মিটিয়ে সঞ্চয়ও করত। স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করত। বিবিএস-এর তথ্যমতে, ২০০০ সালে একটি পরিবার সব খরচ মিটিয়ে ৫৫৯ টাকা সঞ্চয় করতে পারত। ২০০৫ সালে এ সঞ্চয় বেড়ে হয় ৭৭৭ টাকা। ২০১৬ সালে গ্রামে একটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ১৩ হাজার ৩৫৩ টাকা। এর বিপরীতে মাসিক ব্যয় ১৪ হাজার ১৫৬ টাকা। অর্থাৎ প্রতি মাসে আয়ের তুলনায় ৮০৩ টাকা বেশি ব্যয় বা ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এ সময়ে এসে যে মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় আরও অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিবিএস-এর জরিপ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশের মানুষ এখন ভাল নেই। কষ্টেসৃষ্টে জীবন কাটাতে হচ্ছে। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থার মধ্যে তারা নিপতিত।                                                          দুই.                                                                                                                                                                     কষ্টকর জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে শুধু গ্রামের মানুষই যাচ্ছে না, শহরের মানুষদেরও একই অবস্থা বা তার চেয়েও করুণ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে। সীমিত আয়ের যেসব মানুষ রাজধানীতে বসবাস করে, তারা বুঝতে পারছে, জীবন এখন কতো কঠিন হয়ে উঠেছে। প্রতি পদক্ষেপে তাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধিতে তাদের নাভিশ্বাস উঠছে। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুন, শাক-সবজিসহ ন্যূনতম প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের দাম নাগালের বাইরে চলে গেছে। চাল কেনার পর মাছ-গোশত দূরে থাক, প্রয়োজনীয় শাক-সবজি কেনার সামর্থ্য থাকে না। সাধারণ মানুষের পক্ষে এখন শাক-সবজি দিয়ে ভাত খাওয়াও কষ্টকর হয়ে পড়ছে। সীমিত আয়ের মানুষকে নেহায়েত যতটুকু না খেলে নয়, ততটুকু খেয়ে কোনো রকমে দিন পার করতে হচ্ছে। এর উপর যদি অসুস্থ্যতা বা দুর্ঘটনাজনিত কোনো বিপত্তি ঘটে, তবে তা মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে উঠে। আত্মসম্মান দূরে ঠেলে ধার-কর্যর দিকে হাত বাড়াতে হয়। বাড়ির পাশের দোকানে বাকির পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হয়। দোকানির বিরক্ত মুখ সহ্য করতে হয়। একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে এক মুদি দোকানির বক্তব্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, গত কয়েক মাসে তার দোকানে বাকিতে কেনাবেচা বেড়েছে দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। নগদ কেনাবেচা কমে গেছে। আগে যে ক্রেতা মাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা বাকি নিত, এখন নিচ্ছে তিন থেকে চার হাজার টাকা। সময়মতো টাকাও পরিশোধ করছে না। টাকা চাইলে বলে, ভাই কী করব, টাকা নাই। দোকানদার জানান, বেচাকেনা কমে যাওয়ায় তার লাভও কমে গেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সবকিছুর দাম বেশি। খরচ বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। নতুন নতুন খরচের খাতও তৈরি হচ্ছে। অথচ সীমিত আয়ের মানুষের আয় বাড়ছে না এক টাকাও। এই পরিস্থিতিতে সঞ্চয়ের কথা ভাবা দূরের কথা, জমানো টাকাই তাদের ভেঙ্গে খেতে হচ্ছে। এ কথা অনস্বীকার্য, যখন একজন সীমিত আয়ের মানুষকে সঞ্চিত অর্থ ভেঙ্গে চলতে হয়, তখন তাকে প্রান্তিক পর্যায়ে চলে যেতে হয়। কারণ হচ্ছে, বছরের পর বছর ধরে একটু একটু করে যে টাকা জমিয়েছে, তা যদি ভেঙ্গে খেতে হয়, তবে তার পক্ষে এ জীবনে নতুন করে সঞ্চয় করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তাকে প্রান্তিক পর্যায়েই থেকে যেতে হবে। টানাপড়েনের মধ্যে বাকি জীবন কাটাতে হবে। এ সময়ে সীমিত আয়ের কত মানুষ প্রান্তিক পর্যায়ের ঝুঁকিতে আছে বা চলে গেছে, তার সঠিক সংখ্যা কেউ বলতে পারবে না। তবে আশপাশের মানুষের দিকে একটু খেয়াল করলে তা উপলব্ধি করা যায়। যারা শহরে ভদ্রস্ত জীবনযাপন করে, তারা যখন টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে, তখন শত কষ্ট হলেও তা মানসম্মানের ভয়ে প্রকাশ করে না। তাদের মানসিক অবস্থা ও চেহারা দেখে উপলব্ধি করা যায়। মানুষের জীবনযাত্রার এই টানাপড়েন কবে শেষ হবে তা কেউ বলতে পারে না। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে, সরকার মানুষের যে উন্নয়নের কথা এতদিন ধরে বলে আসছে, তা যে অসার ছিল, সাধারণ মানুষ তা বুঝতে পারছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির বিষয়টি এখন তাদের কাছে পরিহাসে পরিণত হয়েছে। একটি শ্রেণী, বিশেষ করে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি করে দিয়েই সরকার মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ক্রেডিট নিচ্ছে। এ শ্রেণীর মানুষকে তুষ্ট করেই সরকার সার্বিক উন্নতির কথা বলছে। সরকারের মধ্যে এ প্রবণতা বিদ্যমান, সরকারি চাকরিজীবীরা সুখে থাকলে, তার ক্ষমতাও দীর্ঘস্থায়ী হবে। ক্ষমতার মূল উৎস প্রশাসন, জনগণ নয়। সাধারণ মানুষ কষ্টে থাকলেও তাদের কিছু বলার থাকে না। যেভাবে রাখা হবে, সেভাবেই থাকবে। বাস্তবেও তাই দেখা যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ ক্ষোভে, দুঃখে ফুঁসে উঠলেও সরকারের কিছু যায় আসছে না। উল্টো সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ভ্যাট-ট্যাক্সের নামে কতভাবে অর্থ আদায় করা যায়, প্রতিনিয়ত তার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। দফায় দফায় গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম বৃদ্ধি, হোল্ডিং ট্যাক্স থেকে শুরু করে এমন কোনো খাত নেই, যেখান থেকে অতিরিক্ত ভ্যাট-ট্যাক্স আদায় করছে না। সরকারের এক নেতাকে বলতে শুনেছি, চালসহ অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম এই ক’মাস হলো বৃদ্ধি পেয়েছে। এর আগে সবকিছুরই দাম কম ছিল। তাকে কে বলবে, মানুষের দম বের হতে খুব বেশি সময় লাগে না। পানিতে ডুবে পাঁচ-দশ মিনিটের বেশি টিকে থাকা যায় না। দম ঠিক রাখতে সবসময় বাতাসের প্রয়োজন এবং তা ঠিক রাখতে হয়। চালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস মানুষের জীবন বাঁচিয়ে রাখার উপকরণ। যত কম সময়ের জন্য হোক না কেন, তা সামর্থ্যরে বাইরে চলে গেলে মানুষের জীবনীশক্তিও কমে যায়। এ পরিস্থিতি যদি চলতেই থাকে, তাহলে মানুষের দুর্দশা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা বোধকরি ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।
তিন.
সাধারণ মানুষের ভাল-মন্দ দেখার সরকারের দায়িত্ব সম্পর্কে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জগৎখ্যাত উক্তি করেছিলেন। বলেছিলেন, গভর্ণমেন্ট অফ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল। জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার, জনগণের জন্যই সরকার। তিনি যখন এ উক্তি করেছিলেন, তখন আমেরিকা এত উন্নতি করেনি। তার এ কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমেরিকার জনগণ উন্নয়নে ঝাপিয়ে পড়েছিল। আমরা মাত্র উন্নয়নের পথে রয়েছি। এ উন্নয়নে জনগণের কর্মস্পৃহা জাগিয়ে তুলতে এবং ধারাবাহিকভাবে তা বজায় রাখতে সরকারে ভূমিকাই মুখ্য। সরকারের উন্নয়ন নীতি ও কর্মপদ্ধতি অনুযায়ী জনগণ পরিচালিত হবে। সরকারকে এ ক্ষমতা জনগণই দিয়েছে। সরকার যদি এ কাজ করতে ব্যর্থ হয়, তবে জনগণকে যেমন দুর্ভোগে পড়তে হয়, তেমনি আফসোসও করতে হয়। দেশের মানুষ এখন এই আফসোসের মধ্যে রয়েছে। তারা দেখছে, যে সরকারের দায়িত্ব তাদের কল্যাণের মাধ্যমে জীবনমান উন্নয়ন করা, তা সে করতে পারছে না। এ নিয়ে সরকারকে কোনো জবাবদিহিও করতে হচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে, বর্তমান সরকার জনগণের প্রত্যক্ষ রায় ও পছন্দে নির্বাচিত হয়নি। নিজে নিজেই নির্বাচিত হয়েছে। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত না হওয়ার কারণে জনগণের দুঃখ-কষ্ট ও উন্নয়ন নিয়ে, তার তেমন মাথাব্যাথা নেই। আর জনগণেরই বা কী ক্ষমতা আছে, তাকে সরিয়ে দেয় ! আমাদের দেশে একটা সময় সরকার হটানো এবং বসানোর ক্ষেত্রে জনগণই মুখ্য ভূমিকা পালন করতো। স্বৈরাচার সরকার হলেও তাকে হটিয়ে দিয়েছে। তবে গণতন্ত্রের মোড়ক ও মুখোশ নিয়ে জনগণের সরাসরি ভোট ছাড়া যে সরকার ক্ষমতায় আসে, তাকে হটানোর অভিজ্ঞতা তাদের কখনো হয়নি। তারা বরাবরই সরল অংকের মতো ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচন করেছে এবং তার শাসন ব্যবস্থা পছন্দ না হলে মেয়াদ শেষে নামিয়ে দিয়েছে। গণতন্ত্রের নামে কর্তৃত্ববাদী কোনো সরকারের মুখোমুখি তাদের হতে হয়নি। তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জেনেছে, বর্তমানে তারা এমনই এক সরকারের অধীনে বসবাস করছে। ক্ষমতার দাপটের কারণে সে কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছে না। নিজের দুর্বলতা ঢাকতে ব্যাপক উন্নয়নের কথা বলছে। অন্যদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়ে গেলেও তার কোনো প্রতিবিধান নেই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত দশ বছরেই দেশ থেকে প্রায় চার লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এসব টাকা কারা, কীভাবে পাচার করলো তার কোনো হদিস নেই। এত অর্থ যদি পাচার হয়ে যায়, তবে দেশের জনসাধারণের ভালো থাকার কোনো কারণ নেই। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় এখন তাদের দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। এ নিয়ে সরকারের কোনো বিকার নেই। সরকার ব্যস্ত ক্ষমতায় কীভাবে টিকে থাকা যায়, এ নিয়ে। সরকারের মধ্যে এ প্রবণতা বিদ্যমান, যে কোনো উপায়ে তাকে ক্ষমতায় থাকতে হবে। জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত কোনো সরকার এ ধরনের আচরণ করতে পারে না। সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের ট্র্যাডিশন এবং সহজ হিসাব হচ্ছে, যে সরকার চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমাতে সক্ষম হবে, জনগণ তাকে নির্বাচিত করবে। নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলোও এ বিষয়টি বেশি প্রাধান্য এবং প্রতিশ্রতি দিয়ে থাকে। ১০ টাকায় চাল খাওয়ানোর মতো মনোমুগ্ধকর প্রতিশ্রতিও দেয়া হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বর্তমান সরকার এ প্রতিশ্রতি দিয়েছিল। জনগণও তা বিশ্বাস করে তাদের বিপুলভাবে নির্বাচিত করে। তবে সে মেয়াদে সরকার তার এ প্রতিশ্রতি পূরণ করতে পারেনি। ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতাসীন হয়ে সে প্রতিশ্রতির প্রতীক হিসেবে শুধু এ বছরের শুরুর দিকে প্রান্তিক জনগণের মাঝে ১০ টাকা কেজিতে চাল বিক্রির উদ্যোগ নেয়। এ নিয়েও নানা ধরনের অনিয়ম হয়। এ কর্মসূচিটি যে এক ধরনের মুখ রক্ষার, লোক দেখানো এবং চালাকিও ছিল, তা দেশের সাধারণ মানুষ জেনে যায়। কারণ ১০ টাকায় চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রতি শুধু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ছিল না এবং তা সে সময় উল্লেখও করা হয়নি। সব মানুষ ১০ টাকায় চাল কিনতে পারবে এমন প্রতিশ্রতিই ছিল। এখন মানুষকে মোটা চাল কিনতে হচ্ছে প্রায় ৫০ টাকায়। চিকন চাল ৭০ টাকায়। এই চাল কিনতে গিয়েই সাধারণ মানুষের এখন কষ্টের সীমা নেই। চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। খোলা বাজারে চাল বিক্রির যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। তাও আবার ৩০ টাকা কেজি দরে আতপ চাল। অথচ এ চালের ভাত আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ খুব একটা খায় না। এমনকি ভিক্ষুককে ভিক্ষা দিতে চাইলেও নেয় না। তারপরও কিছু মানুষ তা কিনছে। কারণ ৫০ টাকা দিয়ে চাল কেনার সামর্থ্য তাদের নেই। তাই কোনো রকমে খেয়ে হলেও তাদের বাঁচতে হবে। অথচ আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, এ কথা ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকারকে গর্ব করতে দেখা গেছে। এখন অবশ্য এ কথা শোনা যায় না। অথচ উন্নয়নের এই ‘ভরা জোয়ারের সময়’ মানুষকে ভাতের কষ্টে পড়তে হবে, এটা কী ভাবা যায় ! বেঁচে থাকার জন্য সাধারণ মানুষকে ব্যাংক-ব্যালেন্স ও সঞ্চয়ের অর্থ ভেঙ্গে খেয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়া কী মানা যায় !
চার.
আগামী এক বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হবে। স্বাভাবিকভাবে সাধারণ মানুষ এ নির্বাচনের অপেক্ষায় আছে। যদি নির্বাচনে নির্বিঘে ভোট দেয়ার সুযোগ পায়, তবে ধরে নেয়া যায়, তাদের কষ্টে থাকার প্রতিপলন রায়ে নিশ্চিতভাবেই দেবে। কাকে নির্বাচন করলে তাদের জীবনযাপন সহজ হবে, তাকেই তারা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে। এ কথা বলা যায়, ক্ষমতা পরিবর্তনের ট্র্যাডিশন যদি বজায় থাকে, তবে বর্তমান সরকারের জন্য ঝুঁকি রয়েছে। সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে যে টানাপড়েন চলছে এবং সরকার যে তা সহজ করতে সক্ষম হচ্ছে না এ বিষয়টি ভোটের ক্ষেত্রে অনেক বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে। কারণ সাধারণ মানুষ রাজনীতির চেয়ে নিজের স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ জীবনযাপনকেই বড় করে দেখে। রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্যও তাই হওয়া উচিত। দুঃখের বিষয়, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তে ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার বিষয়টি মুখ্য হয়ে উঠেছে। তারা মুখে সাধারণ মানুষের কথা বললেও ক্ষমতার রাজনীতিতেই মনোযোগী বেশি। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কথা শুনলে, সহজেই প্রতীয়মাণ হয়, তারা ক্ষমতাকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন এবং যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাচ্ছেন। এদিকে মনোযোগ দেয়ার কারণেই জনস্বার্থের বিষয় উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর