জাকির হোসাইনঃ বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে, সম্মিলিতভাবে হাওর অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। উত্তরে ভারতের মেঘালয়, পূর্বে আসাম-মনিপুর আর দক্ষিণে ত্রিপুরা-মিজোরামের পার্বত্যাঞ্চলের ঢালে অবস্থিত এ অঞ্চল দেশের সমতল অঞ্চলের চেয়ে একটু নিচু প্রকৃতির। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এ অঞ্চলের উচ্চতা মাত্র ৪-৫ মিটারের মধ্যে।
ফলে অঞ্চলটিকে অনেকটা Boul কিংবা পাতিলের পেটের নিচের অংশের মতো লাগে। বঙ্গোপসাগর থেকে প্রবাহিত বিশেষ ধরনের মৌসুমি জলবায়ু এবং উজানে হিমালয় পর্বতমালার উপস্থিতির কারণে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় চেরাপুঞ্জি অঞ্চলে; হাওর অঞ্চল তার মাত্র কয়েক কিলোমিটার ভাটিতেই অবস্থিত। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১৮টি আন্তঃসীমান্ত নদী দিয়ে মেঘালয়, আসাম, মনিপুর, ত্রিপুরা ও মিজোরাম অঞ্চলের বৃষ্টির জলের একটি বড় অংশ এবং কিশোরগন্জ,নেএকোনা,সিলেট, সুনামগঞ্জসহ হাওর অঞ্চলের মধ্য সংগৃহীত বৃষ্টির জলের সবটুকুই ভৈরব ব্রিজের নিচ দিয়ে প্রবাহিত মেঘনা নদী হয়ে সমুদ্রে পতিত হয়। হাওরাঞ্চলের ১.৯৯ মিলিয়ন হেক্টর ভূমির প্রায় ৪৩ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ২১ লাখ একরজুড়ে রয়েছে ছোট-বড় ৩৭৫টি হাওর, যা অধিকতর নিচু প্রকৃতির। এলাকাবাসী এসব হাওরকে আলাদা আলাদা নামে ডাকলেও বৃষ্টিপাতের মৌসুমের প্রায় ছয়-সাত মাসজুড়ে এই সব হাওর মিলে একটিমাত্র বিশাল জলাভূমিতে পরিণত হয়। পৃথিবীর বিরলতম, বৃষ্টিজলের এই বিপুল জলরাশির সায়রকে (সাগর) আঞ্চলিক ভাবে ভাটি এলাকার ভাষায় হাওর বলে অভিহিত করা হয়।
বাংলাদেশে যে ২৩৭ প্রকারের দেশী মাছ পাওয়া যায়, তার মধ্যে ১৪৩ প্রকারের বসবাস হাওরাঞ্চলে। কার্তিক মাসের শেষ দিকে যখন পানি নেমে যেতে থাকে, তখন প্রথমে ভেসে ওঠে অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমি, বীজতলা আর পরিযায়ী পাখিদের একটি বড় অংশের বিচরণ ক্ষেত্র। সবশেষে ভেসে ওঠে সেই সব ধানের জমি, যা বাংলাদেশের মোট ধানের পাঁচ ভাগের এক ভাগের জোগান দেয়। বিশ্বের অভ্যন্তরীণ জলাভূমির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে তৃতীয় স্থানের অধিকারী, এর পেছনেও হাওরের বিশাল অবদান রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে শুধু চীন আর ভারত। প্রকৃতপক্ষে আয়তনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বাংলাদেশের অবস্থান তাদের চেয়ে অনেক বেশি সামনে।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত এবং প্রতি বছর প্রাকৃতিকভাবে নবায়নকৃত মিঠাপানির এত বড় সমুদ্র পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি আছে বলে জানা নেই।
হাওর যেমন পানিজনিত, তেমনি এখানকার মানুষের সমস্যার প্রায় সবটাই পানিজাত। প্রথমেই মনে রাখা ভালো, হাওরের পানি কোনো স্থির বিষয় নয়, বৈশাখ থেকে জমতে শুরু করলেও আষাঢ়ের আগ পর্যন্ত পুরো হাওর ডোবে না আর আশ্বিন-কার্তিকের পর হাওরের ভাসা পানি থাকে না। ফলে ‘শীতে পাও, বর্ষায় নাও’ বলা হলেও আশ্বিন-কার্তিকে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম পাও ঠিকমতো কাজ করে না। বর্ষায় দ্বীপের মতো ভেসে থাকে যে বিচ্ছিন্ন একটি একটি গ্রাম, যোগাযোগের সমস্যার কারণে সেসব গ্রাম এ সময়ে প্রকৃতই অগম্য এবং অবাসযোগ্য হয়ে ওঠে। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ উন্নয়নের যেসব অনুষঙ্গ আধুনিক যোগাযোগের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে বিবেচিত, তার সবকিছু থেকেই বঞ্চিত হয় হাওরাঞ্চলের মানুষ। ফলে এখানকার মানুষের একটি অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত দাবি হলো হাওরাঞ্চলের উন্নয়ন।
প্রকৃত উন্নয়ন বঞ্চিত এই অঞ্চলে বসবাসকারী প্রায় তিন কোটি মানুষের উন্নয়নের এই তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে ‘সমতলের উন্নয়ন চিন্তা’ কীভাবে প্রতারিত করে এবং প্রতিনিয়ত ‘অনুন্নয়নের উন্নয়ন’ ঘটায়, তার দুটি উদাহরণ দিচ্ছি, যা থেকে অতি সহজেই তার মর্ম অনুধাবন করা সম্ভব। (এক) সাম্প্রতিককালে হাওরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে/হচ্ছে।
সবাই জানেন হাওরের ভূমি সমতলের চেয়ে অনেক নিচু প্রকৃতির। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য সমতলে যে মাপের খুঁটি ব্যবহার করা হয়েছে, ঠিক একই মাপের খুঁটি ব্যবহার করা হয়েছে হাওরেও। ফলে বর্ষায় যখন হাওর ডুবে যায় কয়েক মিটার পানির নিচে, তখন স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের তার নেমে আসে মাথার কাছাকাছি। ফলে বর্ষায় হাওরজুড়ে নৌকার যে অবাধ যাতায়াত ছিল তা হয়ে উঠেছে কিছু ক্ষেত্রে অসম্ভব আর অনেক ক্ষেত্রে বিপদসংকুল। (দুই) যোগাযোগ সমস্যার সমাধান হিসেবে হাওরেও ‘সাব-মার্জিবল’ (বর্ষায় ডুবে থাকে আর শীতকালে ভেসে ওঠে এমন) রাস্তার বদলে জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছে ‘আভুরা সড়ক’ (বর্ষায়ও ডুববে না এমন সড়ক)-এর ধারণাকে। প্রকৃতিবিধ্বংসী উন্নয়নবাদী ও বাণিজ্য বিস্তারকারী রাজনৈতিক ব্যবসায়ীরা অতি সহজেই জনগণকে সন্তুষ্ট করা এবং নিজেদের আখের গোছানোর সহায়ক এসব রাস্তাঘাট নির্মাণ করতে গিয়ে যে কয়েকটি (প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল) ব্রিজ বা কালভার্ট এরই মধ্যে নির্মাণ করেছে, তার অধিকাংশই সমতলের রাস্তা-ঘাটের মাপমতো তৈরি করায় এসবের নিচ দিয়ে নৌকা চলাচলের চিরাচরিত পথগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। আরও উদ্ভট হলো, এসব ব্রিজের নির্মাণ পদ্ধতি। সাম্প্রতিককালে ব্রিজ নির্মাণে যে ‘বক্স’ পদ্ধতির প্রচলন হয়েছে, (যা ব্রিজের প্রকৃত উচ্চতার তুলনায় নিচের দিকে আরো নিচু হয়ে ঝুলে থাকে) হাওরেও নির্বিচারে সেই প্রযুক্তিই ব্যবহূত হচ্ছে। ফলে যোগাযোগের উন্নতি ঘটানোর নাম করেই ধ্বংস করা হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। হাওরের উন্নয়ন বিভ্রাট নিয়ে যে বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন, এ পরিসরে তা যথাযথভাবে করা সম্ভব নয়।
তাই অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারে কয়েকটি বিষয় এখানে তুলে ধরা হলো। (ক) হাওরের মত্স্যসম্পদ: মোট হাওর অঞ্চলের ৪৩ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৮ লাখ হেক্টর বা ২১ লাখ একর নিচু ভূমি। নদীপ্রবাহের মধ্যে অনেক ছোট ছোট নদী, খাল, বিল, হাওর,বাঁওড়, ডোবা মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার জলমহাল রয়েছে। এসব জলা বা জলমহালে প্রায় সারা বছরই পানি থাকে, যদি না বিশেষ যন্ত্রপাতির সাহায্যে এগুলোকে সেচ দিয়ে শুকিয়ে না ফেলা হয়। হাওরে যেসব মাছ পাওয়া যায় তার মধ্যে রুই-কাতলা-মৃগেল-চিতল- আইর- পাবদা- ও কয়েক প্রকার বড় চিংড়ি ছাড়া বাকি প্রায় সব প্রকার মাছেরই প্রজনন ক্ষেত্র এসব জলমহাল ও নিচু ভূমি।
হাওরের মানুষ এখন জীবনের নিরাপত্তার বিষয়েই বেশি চিন্তিত। অতিবৃষ্টি বা বন্যার মতো দুযোগের চেয়ে আইন-শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা বেশি ভাবাচ্ছে তাদেরকে’।
কিশোরগঞ্জ-৪ পূ্র্বাঞ্চলীয় (ইটনা, মিটামন, অষ্টগ্রাম) উপজেলা নিয়ে গঠিত বিস্তীর্ণ ও দুর্গম হাওরাঞ্চল জেলার মোট আয়তনের প্রায় তিনভাগের একভাগ হলেও প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধা সেখানে অপ্রতুল। নাগরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার নয়।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাওরবাসী বলছেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিরূপ পরিবেশের প্রতিকূল জীবনের পাশাপাশি নাগরিক নিরাপত্তাহীনতা, সামাজিক সুরক্ষার অভাব ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতি বেড়ে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে হাওরের জীবন-যাপন। প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রাণবৈচিত্র্য ও পর্যটন সম্ভাবনার হাওরাঞ্চলের উন্নয়ন-অগ্রগতি, আধুনিকায়ন ও সমৃদ্ধি বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
‘শুধু আইন-শৃঙ্খলাজনিত নিরাপত্তাহীনতাই নয়, চিকিৎসা ও অন্যান্য প্রয়োজনে যাতায়াতেও মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই ।