হাওর বার্তা ডেস্কঃ মিঠামইন যেন এক অশান্ত জনপদ। সড়কি-বর্শা-বল্লমের ঝনঝনানিতে হাওরের এই ছোট্ট উপজেলায় কারণে-অকারণে রক্ত ঝরছে। গোষ্ঠীগত বিরোধে অস্থির সেখানকার জনজীবন। বিশেষ করে উপজেলার ঘাগড়া, কেওয়ারজোড় ও ঢাকী এই তিন ইউনিয়নে সংঘাত-সংঘর্ষ নিত্য-নৈমিত্ত্যিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা গোষ্ঠীগত বিরোধ এলাকাবাসীর কাছে অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। পান থেকে চুন খসলেই বেজে ওঠে দেশীয় অস্ত্রের প্রাণঘাতী যুদ্ধের ধামামা। আজ এ গ্রাম তো কাল ওই গ্রামে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, সেচ স্কিম, জলমহাল ও জমির মালিকানা দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে সৃষ্ঠ এ গোষ্ঠীগত বিরোধে ঝরছে একের পর এক প্রাণ। কেবল পুরুষেরাই নয়, এর বলি হচ্ছে নারী-শিশুরাও। অনেককেই বরণ করতে হচ্ছে পঙ্গুত্ব। অসংখ্য মানুষের জীবনে নেমে এসেছে দুর্বিষহ অন্ধকার। আবার মামলার জালে নিঃস্ব হয়ে অনেককে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। তবুও গোষ্ঠীবিরোধের এ অভিশপ্ত মরণ নেশা থামছে না।
এরকম পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকী ইউনিয়নের চারিগ্রামে প্রভাবশালী দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ঘটেছে ‘ফাইভ মার্ডার’ এর মতো ভয়ঙ্কর ঘটনা। যার মধ্যে রয়েছেন তিন সহোদর। পক্ষে-বিপক্ষে পাঁচজন নিহত হওয়া ছাড়াও জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে নিহত তিন সহোদরের বড় ফরদিস মিয়ার পুত্র রিফাকুল ইসলাম (২৮)। তাকে গত বৃহস্পতিবার রাতে কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়েছে।
এলাকাবাসী ও সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, জলমহাল বিরোধে চারিগ্রামে এর আগে ‘১৯৬৫ সালে ফোর মার্ডার’ এর ঘটনা ঘটে। তখন নদীর দখল নিয়ে প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন বর্তমানে একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেয়া সোলেমান ভূঁইয়ার বড় ভাই জুলহাস ভূঁইয়া। এর পাল্টা জবাবে খুন হন প্রতিপক্ষের আলাউদ্দিন ও লালু মিয়াসহ তিনজন। এরপর থেকে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে গ্রামটিতে হানাহানি লেগেই আছে। সময়ের পালাবদলে গোষ্ঠীবিরোধ আরো ব্যাপকতা পেয়েছে। নিজেদের শক্তিবৃদ্ধিতে সমমনা কয়েকটি গোষ্ঠীর সমন্বয়ে সেখানে গড়ে ওঠেছে গ্রুপ বা পক্ষ। এবার পাঁচজনের খুনে ফের রক্তাক্ত হলো চারিগ্রামের হাওরপাড়। ঢাকী ইউনিয়নেরই চারিগ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম বড়কান্দা। ২০১৪ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর সকালে বড়কান্দা গ্রামের ইউপি সদস্য বাসেদ মিয়ার পক্ষের সঙ্গে আবুল হোসেনের পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার পর পাওয়া যায় মুজাক্কির (৯) ও চায়না (৮) নামে দুই শিশুর লাশ। এই ঘটনার ১০ মাস আগে ২০১৩ সালের নভেম্বরে দু’পক্ষের সংঘর্ষে আবুল হোসেনের পক্ষের হবিদ মিয়া নামে এক ব্যক্তি খুন হয়। এর আগে ঢাকী গ্রামে প্রভাবশালী দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে সংঘটিত হয় ‘ফোর মার্ডার’ এর আরেকটি ভয়ঙ্কর ঘটনা।
পার্শ্ববর্তী ঘাগড়া ইউনিয়নে গোষ্ঠীগত বিরোধকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ইতিহাসও বেশ পুরনো। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে গত ৪ঠা সেপ্টেম্বর ঘাগড়া গ্রামের দু’পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আনিছ (৩০) নামে একজন নিহত ও পুলিশসহ অন্তত ৫০ জন আহত হয়। নিহত আনিছ ঘাগড়া মিয়াহাটির আরাফাত মিয়ার ছেলে। ওইদিন সকালে পুলিশের উপস্থিতিতেই দু’পক্ষের সংঘর্ষ চলে। সংঘর্ষ এড়াতে পুলিশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ করেও ব্যর্থ হয়। ঘাগড়া ইউনিয়নে এমন সংঘর্ষ অহরহই ঘটছে। গোষ্ঠীগত বিরোধের জেরে ধারাবাহিক সংঘর্ষে তছনছ এলাকার মানুষের স্বাভাবিক জীবন। গোষ্ঠীবিরোধের জেরে গত অর্ধশতাব্দীকাল ধরেই নিয়মিত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। নিজ নিজ অবস্থান থেকে সড়কি, বর্শা, দা, বল্লম, টেঁটা, ইটের সুরকি নিয়ে মাথায় হেলমেট পড়ে চলে যুদ্ধ প্রস্তুতি। দেশীয় অস্ত্রের এসব যুদ্ধে ২০১৪ সালের ৩০শে জুলাই প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হয় ঘাগড়া বাজারের মুদি ব্যবসায়ী আতাউর রহমান (৩০)। এর আগে ২০১২ সালের ১৩ই মার্চ দু’পক্ষের সংঘর্ষে মারা যায় গ্রামের ইরাজ মিয়া (৬৫)। ২০০৪ সালে ঘাগড়া বাজারের ভিটি দখলকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সংঘর্ষে ঘটে ডাবল মার্ডারের ঘটনা। সংঘর্ষে নিহত হন মীর জাহান মোমেন এবং প্রতিপক্ষের ইরান শেখ। এছাড়া ১৯৭৪ সালে ঘাগড়া গ্রামের সাদেকিন মিয়া ও ১৯৮৪ সালে মো. দুলু মিয়া গোষ্ঠী বিরোধের জেরে খুন হন। একই রকম ভাবে ২০১৩ সালের ১৭ই এপ্রিল ঘাগড়া কলাপাড়ার খুর্শিদ মিয়ার গোষ্ঠী ও কালন মিয়ার গোষ্ঠীর বিরোধে সংঘর্ষে রিয়াজুল ইসলাম (১৮) নামে এক কিশোর নিহত হয়। এই মামলার গ্রেপ্তারকৃত আসামি ইছহাক আলী (৭০) ওই বছরেরই (২০১৩) ১৪ই আগস্ট কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে গোষ্ঠীবিরোধকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে এই ইউনিয়নের কলাপাড়া গ্রামের মো. সোবহান হাজী ও শের আলী মিয়া, হোসেনপুর গ্রামের কাজী আব্বাস ও মো. মোয়াজ্জেম, ভরা গ্রামের মো. মানিক মিয়া এবং ধোবাজোড়া গ্রামের মো. জয়নাল আবেদিন খুন হন বলে জানা গেছে। ঘাগড়া ইউনিয়নের ঘাগড়া গ্রামের পার্শ্ববর্তী ধোবাজোড়া ও সিহারা গ্রামও বাদ যায়নি গোষ্ঠীগত বিরোধের এই ভয়াল খেলা থেকে। ধোবাজোড়া গ্রামের হাফিজ উদ্দিন মেম্বার পক্ষের সঙ্গে সিহারা গ্রামের আবুল নাসিরের পক্ষের ছোট্ট বিরোধ ২০১৪ সালে হঠাৎ করেই তুঙ্গে ওঠলে ঘটে ট্রিপল মার্ডারের মতো ঘটনা। দু’গোষ্ঠীর সংঘর্ষের বলি হয়ে ২০১৪ সালের ১১ই জুন ঘটনাস্থলেই নিহত হয় আবুল নাসিরের পক্ষের মর্জিনা আক্তার (১৪) নামে এক মাদরাসা ছাত্রী ও রুবেল মিয়া (১৬) নামে এক কিশোর। সংঘর্ষে আহতদের মধ্যে হাফিজ উদ্দিন মেম্বার পক্ষের আবদুর রশিদ (৬৫) এক সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ১৮ই জুন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
ঘাগড়া ও ঢাকী ইউনিয়নের মতোই গোষ্ঠীগত বিরোধে বার বার রক্ত ঝরছে পার্শ্ববর্তী কেওয়ারজোড় ইউনিয়নে। ঘটেছে এক সঙ্গে ‘ফাইড মার্ডার’ এর ঘটনাও। ১৯৮১ সালে ইউনিয়নের তেলিখাই কান্দিপাড়ায় একই গোষ্ঠীর ৫জন খুন হয়। তারা হলেন, আজিম উদ্দিন, সুরুজ মিয়া, চান্দু মিয়া, ওয়হাদ মিয়া ও মো. আবু মিয়া। এর আগে ও পরে আরো অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। ১৯৭৪ সালে কেওয়ারজোড় বড়হাটির স্কুল শিক্ষক রায়মোহন দাসকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এছাড়া ১৯৮৩ সালে খুন হয় কাদিরখলা গ্রামের মো. করম আলী মেম্বার, ১৯৯৮ সালে খুন হয় কাঞ্চনপুর গ্রামের আফজাল মিয়া, ২০০০ সালে খুন হয় কাঞ্চনপুর গ্রামের টিটু মিয়া, ২০১১ সালে খুন হয় তেলিখাই গ্রামের মো. সাদ্দাম মিয়া।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব ঘটনায় মামলা হলেও বিচারের আগেই অধিকাংশ খুনের ঘটনা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে স্থানীয়ভাবেই মীমাংসা হচ্ছে। কিন্তু সে মীমাংসার রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও বিবদমান পক্ষগুলো সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে নানান অজুহাতে মীমাংসার উদ্যোগকে আমলে না নিয়ে নিজ নিজ শক্তি প্রদর্শনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এসব বিবাদ রাজনৈতিক না হলেও কোন কোন পক্ষকে পর্দার আড়াল থেকে রাজনৈতিক প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
কয়েকজন এলাকাবাসী জানান, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাওর এলাকায় পুরনো বিরোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তখন কখন যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায় সাধারণ মানুষকে সব সময়ে এ আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। কিন্তু ভয়াবহ এ পরিস্থিতি থেকে তাদের কোনভাবেই মুক্তি মিলছে না। এলাকায় অধিপত্য বিস্তার, জলমহাল নিয়ন্ত্রণ এবং গোষ্ঠীগত বিরোধের কারণে গত অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে হাওর এলাকায় নিয়মিত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। দুর্গমতার কারণে ঘটনার খবর জানার পরও পুলিশকে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে কমপক্ষে এক-দেড় ঘন্টা সময় লাগে। সংঘর্ষের এক একটি মামলায় প্রতিপক্ষের প্রায় সবাইকে আসামি করা হয়। চাঁদা তুলে চালানো হয় মামলার খরচ। এরপরও এলাকার মানুষকে এ ভয়াবহ যুদ্ধ থেকে ফেরানো যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে মিঠামইন থানার ওসি মো. আলমগীর হোসেন বলেন, হাওর এলাকার মানুষের মধ্যে আদিযুগের মনোভাব এখনো বিরাজমান। এরপরও সংঘর্ষ এড়াতে পুলিশ সব সময় তৎপর থাকে।
মিঠামইনে সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা হয়নি
মিঠামইনে জলমহালে পাটিবাঁধ দেয়াকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সংঘর্ষে তিন সহোদরসহ পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনায় শোকে স্তব্ধ হাওরের প্রত্যন্ত গ্রাম চারিগ্রাম। নিহতের স্বজনদের আর্তনাদ আর আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠেছে এলাকার পরিবেশ। পুরুষশূণ্য গ্রামটিতে মোতায়েন রয়েছে বিপুল সংখ্যক পুলিশ। শুক্রবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে নিহতদের পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে ভাষাহীন হয়ে পড়েন স্থানীয় সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক। এদিকে সংঘর্ষে হতাহতের এই ঘটনায় গত শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত কোন পক্ষই থানায় মামলা করেনি। বিকালে কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে নিহত পাঁচজনের লাশের ময়নাতদন্ত শেষে বাড়িতে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছিল।
মিঠামইন থানার ওসি মো. আলমগীর হোসেন জানান, এ ঘটনায় কোন পক্ষই এখন পর্যন্ত থানায় মামলা করেনি। এ ঘটনায় কেউ আটক বা গ্রেপ্তারও নেই। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এছাড়া পুনরায় সংঘর্ষ এড়াতে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
মানব জমিন