ঢাকা ০৯:৪৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওরের অতিথি পাখিদের বুকে যেন কেউ তীর না মারে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৩১:০৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ নভেম্বর ২০১৭
  • ৫৬৮ বার

মনোয়ার হোসাইন রনিঃ সূর্য কিছুক্ষণ পরেই ডুবে যাবে পূর্ব পশ্চিমের দিকে। সোনালি আভার সঙ্গে মায়াবী সন্ধ্যার মিশেলে পৃথিবী ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের আলোতে। সন্ধ্যার দিকে চামড়াবন্দরের এসে ভিড়তেই শোনা গেল মাগরিবের আজান। পৃথিবী এখন আরেক রূপ ও বৈচিত্র্য নিয়ে শুরু করেছে রাত্রির আয়োজন। পেছনের স্তব্ধ হাওরও এখন বড়ই অন্য রকম এক ঘুমন্ত জগৎ।  Image result for অতিথি পাখির ছবি

হাওরের বুকে অতিথি পাখিদের সাথে উষ্ণতা ও আশ্রয়ের খোঁজে আসছে দূরান্তের অতিথি পাখি ।

প্রকৃতির প্রতিকূলতা থেকে বাঁচতে যেসব অতিথি পাখি হাজার হাজার মাইল পাড়ি দেয় সুনিশ্চিত খাদ্যের সন্ধান, সন্তান জন্মদান ও বেঁচে থাকার নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, যে পাখি বেছে নেয় এদেশের শ্যামল প্রকৃতিকে, নির্মম শিকারীর শ্যেনদৃষ্টি থেকে বাঁচার সৌভাগ্য তাদের প্রায়ই হয় না। শিকারীর বন্দুকের গুলিতে কিংবা ফাঁদে বহু পাখি হারায় তাদের স্বজনকে। এই বুঝি নিজের প্রাণটাও যায় এমন আতঙ্কও সারাক্ষণ তাদের অশান্তিতে রাখে। কখনো ফিরে যেতে হয় দোসর হারানোর বেদনা নিয়ে।Image result for অতিথি পাখির ছবি

বাংলাদেশের অল্প কিছু জায়গা ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অতিথি পাখি মানুষের আগ্রাসী ক্ষুধার শিকার হয়। শিকারীরা অর্ধমৃত আহত এসব পাখিকে শহরে, গ্রামে-গঞ্জের বাজারে কিংবা রাস্তা-ঘাটে বিক্রি করে। যদিও অনেক স্থানে কর্তৃপক্ষের সহায়তায় অতিথি পাখি শিকার বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। কোথাও কোথাও ‘পাখি সংরক্ষণ কমিটিও গড়ে উঠেছে। কিন্তু এতো কিছুর পরেও বাংলাদেশের সবখানে পরিযায়ী অতিথি পাখিরা মোটেও নিরাপদ নয়। সুযোগ পেলেই নিষ্ঠুর মানুষ অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে পাখি শিকার।Image result for অতিথি পাখির ছবি

মূলত শিকার, যান্ত্রিকীকরণ, রাসায়নিক দ্রব্যের অপব্যবহার ইত্যাদি কারণে অতিথি পাখির আগমন কমছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ এজন্য চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের তরুণ গবেষক সারোয়ার মোরশেদ জানান, ‘অপরিচ্ছন্ন জলাধার, বিষাক্ত পানি, বর্জ্য অতিথি পাখিদের আর আকৃষ্ট করছে না। তারা প্রাকৃতিক নিরাপত্তা পাচ্ছে না বাংলাদেশের পরিবর্তমান জল ও মাটিতে। কচুরিপানা ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ কমে যাওয়ায় তাদের আশ্রয়ের স্থানও কমে যাচ্ছে। জঙ্গলা ভরাট করে বসতি স্থাপনের ফলেও অতিথি পাখিরা আবাস হারাচ্ছে।’

হাওরের এক কৃষক বলেন, ‘একদশক আগেও এদেশে ২০০ থেকে ২১৫ প্রজাতির অতিথি পাখি আসতো। এ সংখ্যা প্রতি বছরই কমে যাচ্ছে। ব্যাপকহারে পাখি শিকার ও জলাভূমির সংখ্যা কমে যাওয়ায় অতিথি পাখিরা এদেশকে আর নিরাপদ ভাবছে না। তাদের আশ্রয়ের পরিধিও সঙ্কুচিত হচ্ছে।’

সব কিছু সমাধান হলো, অবাধে অতিথি পাখি শিকারের বিষয়টি। শুধু নিজে খাওয়ার জন্যই নয়,  বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করার জন্য চলছে পাখি শিকার ।  নৌকার মাঝি জানান, জেলে সেজে রাতের আঁধারে শিকারী দল দীর্ঘ জাল পেতে রাখে এবং ভোরের দিকে শত শত পাখি ধরে নিয়ে চলে যায়।’Image result for অতিথি পাখির ছবি

আইনকে উপেক্ষা করে একশ্রেণীর অসাধু মানুষ কতৃর্ক পাখি শিকার এবং  প্রকাশ্যে ও হাট-বাজারে ফেরি করে অতিথি পাখি বিক্রি করার ঘটনা চোখের সামনেই দেখতে পাওয়া যায়। খোদ রাজধানীর জাতীয় সংসদ ভবন বা সচিবালয়ের আশেপাশে পর্যন্ত অতিথি পাখি বিক্রি করতে দেখা যায়।

কখনো ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক একটি-দুটি বাজারে পাখিসহ কাউকে কাউকে গ্রেফতার করেন । কিন্তু এতে পাখি শিকারের মতো অপরাধ বন্ধ করা যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিলাম অষ্টগ্রাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সঙ্গে।  তিনি বলেন, ‘ গ্রামের গরীব মানুষ পেটের দায়ে পাখি শিকার করে বিক্রি করছে। কিন্তু যারা কিনছে তারা শহরে শিক্ষিত ও ধনী শ্রেণী। প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর জন্যে নয়, রুচির পরিবর্তনের জন্যই তারা নিজেরা শিকার করে কিংবা কিনে নেয় অতিথি পাখি। এটা বক বা সরালী হাঁসে আর কতটুকুই গোশত হয়। অতিথি পাখি ছাড়াও তাদের প্রোটিনের চাহিদা মেটানো কিংবা রুচির পরিবর্তন করা যায়। এক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতা ও প্রকৃতিপ্রেমই সবচেয়ে বেশি কাজে আসবে।’Image result for অতিথি পাখির ছবি

উপজেলার চেয়ারম্যান বলেন, অতিথি পাখি রক্ষায়  জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য আমরা স্থানীয়ভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি। আইনের প্রয়োগ বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিয়েছি।’

হাওরাঞ্চলের তিনটি উপজেলা নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসনের এমপি প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক হাওর বার্তাকে বলেন, ‘প্রাণিসম্পদ, জীববৈচিত্র্য, বিশেষ করে অতিথি পাখি রক্ষায় বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা কাজ করছি।’

সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনকে এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে জানান এমপি, ‘পাখি শিকার যাতে না হয়, সেজন্য আইনি ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে হাওর থেকে পাখি নিয়ে ঢাকা বা চট্টগ্রামের বাজারে যাওয়ার পথগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সাধারণত ভৈরব, কুলিয়ারচর, নিকলি, করিমগঞ্জ দিয়ে মাছের সঙ্গে গোপনে পাখি নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর ট্রেনে বা বাসে সেগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করা হয়। আমরা প্রায়-প্রতিটি পয়েন্টেই দফায় দফায় তল্লাশী করার জন্য প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে বলেছি।’  Image result for অতিথি পাখির ছবি

বাংলাদেশে অতিথি পাখির জন্যে সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১২টি অভয়ারণ্য থাকার কথা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অভয়ারণ্য বলতে যা বুঝায় তা আজও পরিপূর্ণভাবে গড়ে ওঠেনি। ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনের ২৬ ধারা মতে, পাখি শিকার ও হত্যা দণ্ডনীয় অপরাধ। শীতের শুরুতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় অতিথি পাখি হত্যা, জাল ব্যবহার ও শিকার ইত্যাদির ক্ষেত্রে কিছু আইনগত কার্যকারিতা দেখায়। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই এ তৎপরতায় ভাটা পড়ে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী সংস্থা জাতীয় সংসদের সামনেও দিনের বেলা অতিথি পাখি অবাধে বিক্রি হতে দেখা যায়। পত্র-পত্রিকায় এর ছবিও ছাপা হয়। কিন্তু এতে কারও টনক নড়ে না। বার বার একই ছবির পুনরাবৃত্তি ঘটে। কখনো কখনো কর্তৃত্বশীল নেতা বা প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তারা অতিথি পাখি দিয়ে ভোজ বা বনভোজন করে। এমন নিকৃষ্ট মানসিকতার খবরও মিডিয়ায় ছাপা হয়েছে। এসব অনাচার কঠোর হস্তে দমন করা না হলে অতিথি পাখি নিধন বন্ধ হবে না।Image result for অতিথি পাখির ছবি

মায়া-মমতায় জড়ানো পাখির দেশ, গানের দেশ, কবিতার দেশ নামেই পরিচিত আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। অনিন্দ্য কারণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এদেশ পেয়েছে অতিথি পাখি সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে বিশেষ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ‘ফ্রেন্ডশীপ ইস্ট এশিয়ান-অস্ট্রেলিয়ান ফ্লাইওয়ে’ নামক অতিথি পাখি সংরক্ষণ ও গবেষক ষিয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশকে এই স্বীকৃতি দিয়েছে। ‘ফ্রেন্ডশীপ ফর ইস্ট এশিয়ান-অস্ট্রেলিয়ান ফ্লাইওয়ে’র একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে সরেজমিন তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে দেওয়া সনদপত্রটি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়কে হস্তান্তর করে।

সংস্থাটির দেয়া সনদ অনুযায়ী, বাংলাদেশের টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, হাটল হাওর, ইটনা হাওর ,মিঠামইন হাওর, অষ্টগ্রামের হাওর, নিঝুম দ্বীপ ও সোনাদিয়া-এই ৬টি এলাকা অতিথি পাখিসমৃদ্ধ অঞ্চল। তাদের মতে, এসব এলাকায় বহু বছর ধরে অতিথি পাখিরা নিরাপদে বাস করছে। অবিলম্বে এসব অঞ্চল সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি অন্য যেসব স্থানে পাখিরা আসে, সেগুলোর ব্যাপারেও মনোযোগী হতে সংস্থাটি আহ্বান জানিয়েছে।Image result for অতিথি পাখির ছবি

প্রশাসনিকভাবে কঠোর আইনের পাশাপাশি সামাজিকভাবে জনসচেতনতা ও সৌন্দর্য পিপাসু মানসিকতাই বাঁচাতে পারে অতিথি পাখিদের। প্রকৃতির অনন্য উপহার অতিথি পাখি আমাদের নিজস্ব সম্পদ, সারা পৃথিবীর সম্পদ। এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা, নিরাপদে রাখা আমাদের কর্তব্য। শীতের মরণ ছোবল থেকে বাঁচতে উত্তরের যে পাখিরা আমাদের দেশে আসে তাদের বিপদের সুযোগ নেয়া নৈতিকতার পরিপন্থি। বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতিতে অতিথি পাখি যেন পায় অবসর শান্তি। স্বজনসহ তারা যেন নিজ দেশে ভালভাবে ফিরতে পারে এ সুযোগ তাদের দিতে হবে। কখনো যেন তারা স্বজন হারানোর ব্যথা বুকে চেপে করুণ হৃদয়ে স্বদেশে ফিরে না যায়।

ভালোবেসে যে সবুজ-শ্যামল দেশটিতে তারা আসে, ভালোবাসা নিয়েই যেন এখান থেকে অতিথি পাখিরা ফিরে যেতে পারে। প্রকৃতি, পরিবেশ ও পাখির সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কই নিরাপত্তা দিতে পারবে অতিথি পাখিদের।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

হাওরের অতিথি পাখিদের বুকে যেন কেউ তীর না মারে

আপডেট টাইম : ১২:৩১:০৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ নভেম্বর ২০১৭

মনোয়ার হোসাইন রনিঃ সূর্য কিছুক্ষণ পরেই ডুবে যাবে পূর্ব পশ্চিমের দিকে। সোনালি আভার সঙ্গে মায়াবী সন্ধ্যার মিশেলে পৃথিবী ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের আলোতে। সন্ধ্যার দিকে চামড়াবন্দরের এসে ভিড়তেই শোনা গেল মাগরিবের আজান। পৃথিবী এখন আরেক রূপ ও বৈচিত্র্য নিয়ে শুরু করেছে রাত্রির আয়োজন। পেছনের স্তব্ধ হাওরও এখন বড়ই অন্য রকম এক ঘুমন্ত জগৎ।  Image result for অতিথি পাখির ছবি

হাওরের বুকে অতিথি পাখিদের সাথে উষ্ণতা ও আশ্রয়ের খোঁজে আসছে দূরান্তের অতিথি পাখি ।

প্রকৃতির প্রতিকূলতা থেকে বাঁচতে যেসব অতিথি পাখি হাজার হাজার মাইল পাড়ি দেয় সুনিশ্চিত খাদ্যের সন্ধান, সন্তান জন্মদান ও বেঁচে থাকার নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, যে পাখি বেছে নেয় এদেশের শ্যামল প্রকৃতিকে, নির্মম শিকারীর শ্যেনদৃষ্টি থেকে বাঁচার সৌভাগ্য তাদের প্রায়ই হয় না। শিকারীর বন্দুকের গুলিতে কিংবা ফাঁদে বহু পাখি হারায় তাদের স্বজনকে। এই বুঝি নিজের প্রাণটাও যায় এমন আতঙ্কও সারাক্ষণ তাদের অশান্তিতে রাখে। কখনো ফিরে যেতে হয় দোসর হারানোর বেদনা নিয়ে।Image result for অতিথি পাখির ছবি

বাংলাদেশের অল্প কিছু জায়গা ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অতিথি পাখি মানুষের আগ্রাসী ক্ষুধার শিকার হয়। শিকারীরা অর্ধমৃত আহত এসব পাখিকে শহরে, গ্রামে-গঞ্জের বাজারে কিংবা রাস্তা-ঘাটে বিক্রি করে। যদিও অনেক স্থানে কর্তৃপক্ষের সহায়তায় অতিথি পাখি শিকার বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। কোথাও কোথাও ‘পাখি সংরক্ষণ কমিটিও গড়ে উঠেছে। কিন্তু এতো কিছুর পরেও বাংলাদেশের সবখানে পরিযায়ী অতিথি পাখিরা মোটেও নিরাপদ নয়। সুযোগ পেলেই নিষ্ঠুর মানুষ অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে পাখি শিকার।Image result for অতিথি পাখির ছবি

মূলত শিকার, যান্ত্রিকীকরণ, রাসায়নিক দ্রব্যের অপব্যবহার ইত্যাদি কারণে অতিথি পাখির আগমন কমছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ এজন্য চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের তরুণ গবেষক সারোয়ার মোরশেদ জানান, ‘অপরিচ্ছন্ন জলাধার, বিষাক্ত পানি, বর্জ্য অতিথি পাখিদের আর আকৃষ্ট করছে না। তারা প্রাকৃতিক নিরাপত্তা পাচ্ছে না বাংলাদেশের পরিবর্তমান জল ও মাটিতে। কচুরিপানা ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ কমে যাওয়ায় তাদের আশ্রয়ের স্থানও কমে যাচ্ছে। জঙ্গলা ভরাট করে বসতি স্থাপনের ফলেও অতিথি পাখিরা আবাস হারাচ্ছে।’

হাওরের এক কৃষক বলেন, ‘একদশক আগেও এদেশে ২০০ থেকে ২১৫ প্রজাতির অতিথি পাখি আসতো। এ সংখ্যা প্রতি বছরই কমে যাচ্ছে। ব্যাপকহারে পাখি শিকার ও জলাভূমির সংখ্যা কমে যাওয়ায় অতিথি পাখিরা এদেশকে আর নিরাপদ ভাবছে না। তাদের আশ্রয়ের পরিধিও সঙ্কুচিত হচ্ছে।’

সব কিছু সমাধান হলো, অবাধে অতিথি পাখি শিকারের বিষয়টি। শুধু নিজে খাওয়ার জন্যই নয়,  বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করার জন্য চলছে পাখি শিকার ।  নৌকার মাঝি জানান, জেলে সেজে রাতের আঁধারে শিকারী দল দীর্ঘ জাল পেতে রাখে এবং ভোরের দিকে শত শত পাখি ধরে নিয়ে চলে যায়।’Image result for অতিথি পাখির ছবি

আইনকে উপেক্ষা করে একশ্রেণীর অসাধু মানুষ কতৃর্ক পাখি শিকার এবং  প্রকাশ্যে ও হাট-বাজারে ফেরি করে অতিথি পাখি বিক্রি করার ঘটনা চোখের সামনেই দেখতে পাওয়া যায়। খোদ রাজধানীর জাতীয় সংসদ ভবন বা সচিবালয়ের আশেপাশে পর্যন্ত অতিথি পাখি বিক্রি করতে দেখা যায়।

কখনো ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক একটি-দুটি বাজারে পাখিসহ কাউকে কাউকে গ্রেফতার করেন । কিন্তু এতে পাখি শিকারের মতো অপরাধ বন্ধ করা যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিলাম অষ্টগ্রাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সঙ্গে।  তিনি বলেন, ‘ গ্রামের গরীব মানুষ পেটের দায়ে পাখি শিকার করে বিক্রি করছে। কিন্তু যারা কিনছে তারা শহরে শিক্ষিত ও ধনী শ্রেণী। প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর জন্যে নয়, রুচির পরিবর্তনের জন্যই তারা নিজেরা শিকার করে কিংবা কিনে নেয় অতিথি পাখি। এটা বক বা সরালী হাঁসে আর কতটুকুই গোশত হয়। অতিথি পাখি ছাড়াও তাদের প্রোটিনের চাহিদা মেটানো কিংবা রুচির পরিবর্তন করা যায়। এক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতা ও প্রকৃতিপ্রেমই সবচেয়ে বেশি কাজে আসবে।’Image result for অতিথি পাখির ছবি

উপজেলার চেয়ারম্যান বলেন, অতিথি পাখি রক্ষায়  জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য আমরা স্থানীয়ভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি। আইনের প্রয়োগ বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিয়েছি।’

হাওরাঞ্চলের তিনটি উপজেলা নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসনের এমপি প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক হাওর বার্তাকে বলেন, ‘প্রাণিসম্পদ, জীববৈচিত্র্য, বিশেষ করে অতিথি পাখি রক্ষায় বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা কাজ করছি।’

সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনকে এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে জানান এমপি, ‘পাখি শিকার যাতে না হয়, সেজন্য আইনি ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে হাওর থেকে পাখি নিয়ে ঢাকা বা চট্টগ্রামের বাজারে যাওয়ার পথগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সাধারণত ভৈরব, কুলিয়ারচর, নিকলি, করিমগঞ্জ দিয়ে মাছের সঙ্গে গোপনে পাখি নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর ট্রেনে বা বাসে সেগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করা হয়। আমরা প্রায়-প্রতিটি পয়েন্টেই দফায় দফায় তল্লাশী করার জন্য প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে বলেছি।’  Image result for অতিথি পাখির ছবি

বাংলাদেশে অতিথি পাখির জন্যে সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১২টি অভয়ারণ্য থাকার কথা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অভয়ারণ্য বলতে যা বুঝায় তা আজও পরিপূর্ণভাবে গড়ে ওঠেনি। ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনের ২৬ ধারা মতে, পাখি শিকার ও হত্যা দণ্ডনীয় অপরাধ। শীতের শুরুতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় অতিথি পাখি হত্যা, জাল ব্যবহার ও শিকার ইত্যাদির ক্ষেত্রে কিছু আইনগত কার্যকারিতা দেখায়। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই এ তৎপরতায় ভাটা পড়ে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী সংস্থা জাতীয় সংসদের সামনেও দিনের বেলা অতিথি পাখি অবাধে বিক্রি হতে দেখা যায়। পত্র-পত্রিকায় এর ছবিও ছাপা হয়। কিন্তু এতে কারও টনক নড়ে না। বার বার একই ছবির পুনরাবৃত্তি ঘটে। কখনো কখনো কর্তৃত্বশীল নেতা বা প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তারা অতিথি পাখি দিয়ে ভোজ বা বনভোজন করে। এমন নিকৃষ্ট মানসিকতার খবরও মিডিয়ায় ছাপা হয়েছে। এসব অনাচার কঠোর হস্তে দমন করা না হলে অতিথি পাখি নিধন বন্ধ হবে না।Image result for অতিথি পাখির ছবি

মায়া-মমতায় জড়ানো পাখির দেশ, গানের দেশ, কবিতার দেশ নামেই পরিচিত আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। অনিন্দ্য কারণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এদেশ পেয়েছে অতিথি পাখি সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে বিশেষ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ‘ফ্রেন্ডশীপ ইস্ট এশিয়ান-অস্ট্রেলিয়ান ফ্লাইওয়ে’ নামক অতিথি পাখি সংরক্ষণ ও গবেষক ষিয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশকে এই স্বীকৃতি দিয়েছে। ‘ফ্রেন্ডশীপ ফর ইস্ট এশিয়ান-অস্ট্রেলিয়ান ফ্লাইওয়ে’র একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে সরেজমিন তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে দেওয়া সনদপত্রটি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়কে হস্তান্তর করে।

সংস্থাটির দেয়া সনদ অনুযায়ী, বাংলাদেশের টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, হাটল হাওর, ইটনা হাওর ,মিঠামইন হাওর, অষ্টগ্রামের হাওর, নিঝুম দ্বীপ ও সোনাদিয়া-এই ৬টি এলাকা অতিথি পাখিসমৃদ্ধ অঞ্চল। তাদের মতে, এসব এলাকায় বহু বছর ধরে অতিথি পাখিরা নিরাপদে বাস করছে। অবিলম্বে এসব অঞ্চল সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি অন্য যেসব স্থানে পাখিরা আসে, সেগুলোর ব্যাপারেও মনোযোগী হতে সংস্থাটি আহ্বান জানিয়েছে।Image result for অতিথি পাখির ছবি

প্রশাসনিকভাবে কঠোর আইনের পাশাপাশি সামাজিকভাবে জনসচেতনতা ও সৌন্দর্য পিপাসু মানসিকতাই বাঁচাতে পারে অতিথি পাখিদের। প্রকৃতির অনন্য উপহার অতিথি পাখি আমাদের নিজস্ব সম্পদ, সারা পৃথিবীর সম্পদ। এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা, নিরাপদে রাখা আমাদের কর্তব্য। শীতের মরণ ছোবল থেকে বাঁচতে উত্তরের যে পাখিরা আমাদের দেশে আসে তাদের বিপদের সুযোগ নেয়া নৈতিকতার পরিপন্থি। বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতিতে অতিথি পাখি যেন পায় অবসর শান্তি। স্বজনসহ তারা যেন নিজ দেশে ভালভাবে ফিরতে পারে এ সুযোগ তাদের দিতে হবে। কখনো যেন তারা স্বজন হারানোর ব্যথা বুকে চেপে করুণ হৃদয়ে স্বদেশে ফিরে না যায়।

ভালোবেসে যে সবুজ-শ্যামল দেশটিতে তারা আসে, ভালোবাসা নিয়েই যেন এখান থেকে অতিথি পাখিরা ফিরে যেতে পারে। প্রকৃতি, পরিবেশ ও পাখির সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কই নিরাপত্তা দিতে পারবে অতিথি পাখিদের।