অগ্নি পরীক্ষায় দুই নেত্রী

হাওর বার্তা ডেস্কঃ একাদশ জাতীয় সংসদের ঠিক এক বছর আগে অগ্নি পরীক্ষায় দুই নেত্রী। দুই নেত্রী একা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে দলের ওপর নির্ভর করতে পারছেন না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী নির্বাচন দুই নেত্রীর জন্যই অস্তিত্বের পরীক্ষা। যতটা না দুই দলের লড়াই, তারচেয়ে দুই নেত্রীর যুদ্ধ।

২০০৮ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে বিজয়ী হয়। এরপর দলটি টানা আট বছরেরও বেশি ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে নির্দলীয় ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেভাবে সংসদ নির্বাচন করে একই নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করে। এর প্রতিবাদে বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ডাক দেয়। ১৫৪ টি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হয়। সে সময় ২০১৪ এর নির্বাচন অন্তর্বর্তী বা আপদকালীন ব্যবস্থা মনে করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগও বলেছিল এটা সাংবিধানিক দায় পূরণের নির্বাচন। শীগগিরই নতুন নির্বাচন হবে। ওই নির্বাচনকে সমর্থন দেয় ভারত। নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি রণে ভঙ্গ দেয়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এরকম একটি নির্বাচন করে বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল মাত্র দুই সপ্তাহ। সেখানে আওয়ামী লীগ সেরকম একটি নির্বাচন করে তার মেয়াদ পূর্ণ করতে চলেছে। প্রথম রাউন্ডে তাই শেখ হাসিনা বেগম জিয়াকে নক আউট করেছেন। এসময় তিনি সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন। বেগম জিয়াকে টেলিফোন করে গণভবনে ডেকেছেন। বেগম জিয়া এসব প্রস্তাব একের পর এক প্রত্যাখ্যান করে ‘আপোষহীন’ হতে চেয়েছিলেন, কিন্ত হয়েছেন ‘অস্তিত্বহীন’। ৯১ সালের পর এবারই প্রথম বিএনপি জাতীয় সংসদে নেই। বিএনপির নেতারা প্রকাশ্যে না বললেও ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় স্বীকার করেন, ২০১৪ র নির্বাচনে না যাওয়া ছিল মারাত্মক ভুল। বিশেষ করে পাঁচটি সিটি নির্বাচনে বিজয়ের পর ‘সর্বদলীয় সরকারের’ অধীনে নির্বাচনে গেলে বিএনপি চমক দেখাতো। ওই নির্বাচনের পর বিএনপি হতোদ্যম, হতাশ, উদ্দেশ্যহীন একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। কিন্ত বিএনপির জনপ্রিয়তা কমেনি। বাংলাদেশে আওয়ামী বিরোধী ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ জনগণ এখনো বিএনপিকে সমর্থন করে। কিন্ত দলটির সাংগঠনিক অবস্থা নাজুক। সিনিয়র নেতারা জানেন না দল কোন পথে এগুবে। বেগম জিয়া এবং তাঁর পুত্রই এককভাবে সব সিদ্ধান্ত নেন। বেগম জিয়ার ঘনিষ্ঠরা মনে করেন, ওয়ান ইলেভেনের পর থেকেই বেগম জিয়া সিনিয়র নেতাদের বিশ্বাস করতে পারেন না। এখন সেই অবিশ্বাস আরও বেড়েছে। বিশেষ করে,২০১৪ তে ঢাকায় আন্দোলনের ব্যর্থতাকে বেগম জিয়া-তারেক ‘নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতা’ই মনে করেন। আগামী নির্বাচন তাই বিএনপির জন্য অস্তিত্বের পরীক্ষা। এই নির্বাচনে যদি বিএনপি অংশ নিয়ে বিজয়ী হয় তাহলে আবার পাদপ্রদীপে আসবেন বেগম জিয়া। নির্বাচনে অংশ নিয়ে যদি বেগম জিয়া বিরোধী দলে যান তাহলেও বিএনপি গণতান্ত্রিক একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিকাশের সুযোগ পাবে। নির্বাচন বর্জন করে যদি তিনি একতরফা নির্বাচন ঠেকিয়ে দিতে পারেন, তাহলে আবার তিনি ‘আপোষহীন’ নেত্রীর তকমা ফেরত পাবেন। আর নির্বাচন বর্জন করে যদি সেটা ঠেকাতে ব্যর্থ হন তাহলে তিনি কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবেন। কি সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি? এটা বেগম জিয়া এবং তাঁর ছেলে ছাড়া কেউ জানে না। সিদ্ধান্ত যেটাই নেন, বেগম জিয়া একাকী এবং নিঃসঙ্গ। তাঁকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য দলে কেউ নেই। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তের সব দায় বেগম জিয়াকেই বহন করতে হবে।

শেখ হাসিনা ২০১৪ এর নির্বাচনের পর তাঁর অবস্থান সংহত করেছেন। উন্নয়নের গণতন্ত্র এই শ্লোগানের বাস্তব প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশকে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। টানা আট বছর প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের উপরে রেখে তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বে সেরা পাঁচটি বিকাশমান দেশের একটিতে পরিণত করেছেন। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ইমেজ বাড়িয়েছেন। এই মুহূর্তে দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা তিনি। তাঁর উন্নয়ন চিন্তা সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করেছে। এত সব কিছুর পরেও তিনি একা ও নিঃসঙ্গ। গত আট বছরে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বিকশিত হতে পারেনি। তার চিন্তা এবং উদ্যমের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না আওয়ামী লীগ। বরং দলে অনুপ্রবেশকারীরা দলের ত্যাগী পরীক্ষিত নেতা কর্মীদের ‘বাস্তুহারা’ করেছেন। দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন নানা অপকর্ম ছড়িয়ে সাধারণ মানুষের কাছে দলের ইমেজ নষ্ট করেছে। দুর্নীতি এখনো এক বিরাট সমস্যা হিসেবেই রয়ে গেছে। দলের বেশ কিছু এমপির দুর্নীতি, সন্ত্রাসের অভিযোগ দলকে এক বিব্রতকর অবস্থায় নিয়ে গেছে। চাল সংকট, খাদ্য সংকট, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি নানা সিদ্ধান্ত জনদূর্ভোগ বাড়িয়েছে। আট বছর ক্ষমতায় থাকার পরও তাই আওয়ামী লীগও সাংগঠনিক ভাবে ক্ষয়িষ্ণু, ছন্নছাড়া। ২০১৪ সালে শেখ হাসিনা একাই সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সিনিয়র নেতারা প্রায় কিছুই জানতেন না। ২০১৪ সালের নির্বাচন দলে শেখ হাসিনার ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করেছে। অনেকেই মনে করেন, দেশও পরিচালিত হয় কার্যত: তাঁর একক সিদ্ধান্তে। দলের নেতা বা মন্ত্রী নন, শেখ হাসিনা, আমলা ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপরই বেশি নির্ভরশীল। বেগম খালেদা জিয়ার মতো তিনিও ওয়ান ইলেভেনের পর বেশির ভাগ নেতাদের খুব একটা আস্থায় নিতে পারেন না। ২০১৪ সালের পর রাজনৈতিক নেতারা আরও গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছেন। নীতি নির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্তই তাঁরা জানেন না। শেখ হাসিনা কঠিন সময়ে তাঁর ছোট বোনের ওপরই বেশি ভরসা করেন। আগামী নির্বাচন তাঁর জন্যও অগ্নি পরীক্ষা। এই নির্বাচন তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী আর বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০তম বার্ষিকী ক্ষমতায় থেকেই করতে চান । আগামী নির্বাচনে তিনি কি করবেন? কোটি টাকার প্রশ্ন। ২০১৪ র মত এক তরফা নির্বাচন ২০১৮ তে করা সম্ভব নাও হতে পারে। শেখ হাসিনা বিএনপিকে নিয়েই নির্বাচন করতে চান, তবে সেই বিএনপি বেগম জিয়ার বিএনপি কিনা, তা একটি ভাবনার বিষয়। খালেদা জিয়ার মামলা যেভাবে এগুছে তাতে আগামী নির্বাচনের আগে এসবের রায় হবার সম্ভাবনাই বেশি। শেখ হাসিনা কি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অযোগ্য বানিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হবেন ? নাকি, এই মামলার বিনিময়ে তাঁকে নির্বাচনের মাঠে নামাবেন? শেখ হাসিনা কি এই নির্বাচনও সাজানো ছকে করে বিজয়ী হবেন, নাকি ২০০১ এর মতো বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হবেন? শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়ার ঘটনা অন্য যেকোনো রাজনীতিবিদের চেয়ে অনেক বেশি। এমনকি যখন তিনি প্রায় ‘লৌহমানবী’ তখনো তিনি যাদের বিশ্বাস করে উচ্চ পদে বসিয়েছেন, তাঁরা তাঁর সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমারের ঘটনাটা তো চোখের সামনে। বাকিগুলো না হয় এখানে নাই উল্লেখিত হলো । এই নির্বাচন বেগম জিয়ার জন্য যেমন অস্তিত্বের পরীক্ষা তেমনি অস্তিত্বের পরীক্ষা শেখ হাসিনার জন্যও।

শেখ হাসিনা রাজনীতির বিচক্ষণতার দৌড়ে খালেদা জিয়ার থেকে ঢের এগিয়ে । আসলে এখন তাদের কোনো তুলনাই চলে না । তবে একটি বিষয়ে দুজনের দারুণ মিল, দলে তাঁদের কোনো টিম নেই । বিশ্বাসী রাজনৈতিক কর্মী নেই। দুজন তাই একাকী। লড়বেন একাই। এই লড়াই হয়তো বাংলাদেশে দুই নেত্রী যুগের অবসান ঘটাবে। যিনি হারবেন রাজনীতিতে তিনি অস্তমিত হবেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর