হাওর বার্তা ডেস্কঃ প্রাচীন সভ্যতার বিজ্ঞ মানুষজনের অনেক অদ্ভুত বিশ্বাস ছিল, আধুনিক বিজ্ঞান ও পরিবেশ শাস্ত্র যার বেশ কিছু আজো মান্য করে। যেমন, যে শহরে নদী নেই সেই জনপদবাসী অভাগা। যত সুন্দর করেই নগরায়ন করো না কেন, নদীর কোনও বিকল্প নেই। হয়না ! হতে পারেনা !
নদী তুমি কোন কথা কও ? অশথের ডালাপালা তোমার বুকের ‘পরে পড়েছে যে,জামের ছায়ায় তুমি নীল হ’লে.আরো দূরে চলে যাইসেই শব্দ সেই শব্দ পিছে-পিছে আসে নদী না কি ? নদী তুমি কোন কথা কও ?’।
“নরসুন্দা একটি ‘মৃত’ নদীর নাম”
বাংলাদেশের মানুষ, যারা পদ্মা-মেঘনা-বুড়িগঙ্গা দেখে বড় হয়েছেন, তাদের কাছে এই সত্যটি মর্মে মর্মে প্রতিভাত।চিন্তায়, চেতনায় নদীর কুলুধ্বনি বাংলাদেশকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে ঐতিহাসিক কাল থেকেই।
নদী সংলগ্ন মানুষ শেষ নি:শ্বাস বের হওয়া পর্যন্ত নদীকে মনে রাখেন। ভিটেমাটি ছেড়ে আসার বহু বহু বছর পরেও আমার এক মার্কিনবাসী বন্ধু প্রায় আমাকে সে দেশের নদীর উপমা টেনে ইমেইল করে। সে থাকে যে শহরে, তার নাম অস্টিন। অস্টিনবাসী ভাগ্যবান। কেননা এ শহরে একটি নদী আছে! কলোরাডো নাম। পদ্মা না হলেও অপরূপা ! উদ্ভিন্ন যৌবনাও বলা চলে !
নগর বন্ধুরা জানায়, এ নগরীর নদীতে কেউ নাইতে নামেনা ! প্রাকৃতিক কম্মো করেনা। পাড়ে কাপড়ও কাচেনা! সবুজে-শ্যামলে টলটল জল স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ। দেখলে দু’দণ্ড পাশে বসে মন-প্রাণ জুড়োতে ইচ্ছে করে! হাতছানি দিয়ে ডাকে বাংলাদেশের নদীর স্মৃতি।
কলোরাডো তীরে অস্টিন। বন্ধুর চিঠি ছাড়াও সভ্য দুনিয়ায় ইন্টারনেটে খোঁজ-খবর করতে গিয়ে দেখেছি, নদী থাকলেই হয়না, তাকে যত্ন-আত্তি করে রাখতেও জানতে হয়। প্রেয়সীর মতো। তোমায় সাজাব যতনে কুসুমে রতনে ! লন্ডনের টেমস, প্যারিসের শ্যেন কিংবা আরও পূবে দানিয়ুবকে দেখলে মনে হয়, কতো সবুজ, কতো জীবন্ত। সবাই যেন ফুলশয্যা রাতের কনে! চিরযৌবনা। বিশ্বের দেশে দেশে নদীকে মানুষের মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে। মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধের শাস্তির মতোই নদীর প্রতি কোনও অনাচার করা হলে শাস্তির বিধান রাখা হচ্ছে।
কলোরাডোও তাই, বন্ধুটি অনেক বার জানিয়েছে, নদী সেখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ ও সুরক্ষিত ! পাড় নিপুনভাবে বাঁধানো! তার ওপর হাঁটার রাস্তা, জগিংয়ের, সাইক্লিংয়ের। মানুষের আর সারমেয়ের একই রকম খাতির !
তার চিঠি পড়তে পড়তে ভাবি, আহা ! এমন খাতির যদি আমাদের দেশে নদী ও মানুষের জন্য হতো ! আফসোস বাড়ে নদীর দুর্দশা দেখে। কয়দিন আগে গিয়েছিলাম নরসুন্দা নদী তীরের কিশোরগঞ্জ। আশৈশবের প্রমত্তা নদীটিকে জীর্ণ ও নোংরা করা হয়েছে। দখল আর দুষণে বিপণ্ন নরসুন্দা এখন মৃত-প্রায়।
অথচ মানুষ, নদী ও নগরকে কতো সুন্দর করেই না সাজায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। অস্টিনের কথাই ধরা যাক। জন্মস্থান নয়, তবু বন্ধুটি জানাতে কসুর করে না যে, তার বেশ লাগছে শহরটিকে ! একটা ওল্ড ওয়ার্ল্ড চার্ম আছে, মনে হয় আধুনিক আমেরিকায় নয়, যেন কোনও ইউরোপীয় ছায়াময় শহর। ডাউনটাউনের আইটি হাবে বেশ কয়েকটি ঝকঝকে বহুতল থাকলেও আবাসিকদের বাড়িগুলি বেশিরভাগই এক তলা নয় দোতলা, স্থাপত্যেও সাবেকি ঐতিহ্য !
পথ চলতে চলতে চোখে পড়ে মুক ও বধিরদের জন্য একটি স্কুল। প্রকাণ্ড ক্যাম্পাস, আমাদের গোটা চারেক কলেজ ক্যাম্পাস ঢুকে যেতে পারে। ফলকে নাকি লেখা আছে- প্রতিষ্ঠানটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। স্কুলটি চালু হয়েছিল ১৮৫৭ সালের পয়লা এপ্রিল। আমাদের উপমহাদেশের দিল্লির তখতে তখন বাহাদুর শাহ, ব্যারাকপুরে ইংরেজের সেনা ছাউনিতে তখন বিদ্রোহের শলতে পাকানো সবে শুরু হয়েছে। আমরা যখন লড়ছি, ওরা তখন গড়ছে। ওদের গড়া চলছেই, আমাদের লড়াই থামছে না।
কোনও কিছু ভাল না মন্দ সেটা নির্ধারণ করার ব্যাপারে সকলেরই নিজস্ব একটা বিবেচনাবোধ বা মানদণ্ড আছে। যেমন একটা লেখা ভাল হওয়ার প্রথম অনিবার্য পূর্বশর্তটি হল সেটা পাঠযোগ্য কি না, তাতে প্রসাদ গুণ আছে কি না। যে ছবি দেখলে নিষ্পলক চোখে তার সামনে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে সেটা ভাল ! একইভাবে সিনেমা হলের সিটে টানটান হয়ে বসে যদি একটা ছবি দেখে ফেলা যায়, তাহলে সেটাও নির্ঘাত ভালই !
যে শহরে বসবাস করছি, যে নদীটিকে পাশে পেয়েছি, যে বৃক্ষ ও উদ্ভিদ থেকে সুভাস ও সুষমা নিচ্ছি, যে প্রাণ-বৈচিত্র্য ও পাখির কাকলীতে নিত্য সজিব ও মুখরিত হচ্ছি, তাদের ব্যাপারে আমরা কিভাবে এতো নিম্ন বিবেচনাবোধের পরিচয় দিতে পারছি? যারা প্রকৃতির অংশ হয়ে নানাভাবে আমাদের উপকার করছে, তাদেরকে ক্ষূণ্ন ও হনন করতে আমরা বিন্দুমাত্র বিচলিত হচ্ছি না। আমরা যে স্বজনতুল্য নদী, পাখি, পুষ্প ও বৃক্ষরাজির ক্ষতি করে আমাদেরই চরম সর্বনাশ করছি, এই সত্যটি কবে বুঝতে পারবো? অনেক বেদনা ও কষ্টে নদী যে আর্তনাদ করছে, তা কবে শুনতে পাবো ?
‘নদী, তুমি কোন কথা কও ?’ আমরা তো কোনদিন শুনতেও চাই নি !