প্রসঙ্গ ক্রসফায়ার মেজর অব. মো. আখতারুজ্জামান

কিশোরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ছাত্রদলের কমিটি করার নামে এক সন্ত্রাসী ছাত্রনেতা সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে নগদ টাকা নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় কমিটি দিয়েছে, যা এলাকার সবাই জানে। ঢাকা মহানগরের এক বড় নেতার কাছে সন্ত্রাসীদের কারণে দেখা করতে পারে না সাধারণ নেতাকর্মীরা। ওই নেতা জিয়ার মাজারে বা কোনো সভা বা জনসভা বা পথসভায় গেলে সন্ত্রাসীদের ধাক্কার চোটে কেউ এমনকি ওই নেতার বাপের সমান নেতারাও দাঁড়াতে পারে না। অনেকবার বলেও এর কোনো সুরাহা হয়নি। ধাক্কিয়ে ওই নেতার পথ করে দেয়াই নাকি নেতার নির্দেশ!

এছাড়া দলের একশ্রেণির সন্ত্রাসী নেতাদের কারণে দলের বা অঙ্গসংগঠনের কোনো সভা বা আলোচনা বিভিন্ন সময়ে হতে পারে না। কোনো সজ্জন ব্যক্তির পক্ষে রাজনীতি করা এখন অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে অনেকে মনে করেন। এই সমস্ত সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করার বা এমনকি নিয়ন্ত্রণ করার কোনো দৃশ্যমান ক্ষমতা দলের আছে কিনা তাও পরিষ্কার নয়।

সরকারি দলের সন্ত্রাসী কার্যক্রমতো আরও কয়েক কাঠি সরেস। টেন্ডার থেকে চাঁদাবাজি, জমি দখল, পরিবহন, বিমানবন্দরে চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসা, অফিস আদালতে খবরদারি, চোরাই কারবার, সীমান্তে চোরাকারবারিসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যেখানে সরকারি দলের একশ্রেণির নেতাকর্মীরা জড়িত নয়। খোদ ঢাকা মহানগরে এই নেতাদের চাঁদা না দিয়ে কারও পক্ষেই বাড়ি ঘর বানানো প্রায় অসম্ভব। ঢাকা শহরের সব ফুটপাথ তাদের দখলে। সবচ মার্কেটে তাদের প্রকাশ্য চাঁদাবাজি। এই অবস্থা সকল মহানগর, জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতেও।

কয়েকদিন পরে সরকারি দলের দখলে থাকবে আসন্ন ঈদের সব গরুর হাট, যেখান থেকে প্রকাশ্যে চড়া হারে চাঁদাবাজি করা হবে। ওই সরকারি নেতাদের চাঁদা না দিয়ে কোনো সাধারণ জনগণ একটি পশুও কিনতে পারবে না। এই হলো সরকারি দলের মধ্য ও নিম্ন স্তরের একশ্রেণির নেতাকর্মীর রাজনীতির হালচাল।

সরকারি দলের উপরের আরেকটি শ্রেণির রাজনীতি হলো শেয়ার কেলেঙ্কারি, ব্যাংক লুট, চোরাকারবারি, মজুদদারি, ঠিকাদারি ইত্যাদি বড় বড় অপরাজনীতি বা অবৈধ ক্ষমতার দালালি। তারা কোনো আইনের তোয়াক্কা করে না। এরা অনেকেই এমপি, মন্ত্রী, বড় ব্যবসায়ী বা সাবেক আমলা।

ওরা সবাই দেশ ও জাতির দুশমন। তাদের ধ্বংস ছাড়া দেশ ও জাতিকে রক্ষা করা কঠিন। এদের কারণে জননিরাপত্তা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে। জনগণ যেকোনো মূল্যে এই সব দুশমনদের হাত থেকে মুক্তি চায়। আইনের শাসনের মূল প্রতিপাদ্য হলো দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন। কিন্তু বর্তমানের আইনের শাসন হয়ে গেছে উল্টা। এখানে অপরাধীর সব অধিকার ভোগ নিশ্চিত করতে হবে। নিহত ব্যক্তিকেই নতুন করে জন্ম নিয়ে এসে আদালতে প্রমাণ দিতে হবে তার হত্যাকারী কে! যেহেতু অপরাধীর বিপক্ষে কোনো সাক্ষী নাই বা জীবনের ভয়ে অপরাধীর বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষী দিতে আসে না বা পাওয়া যায় না কাজেই বিনা সাক্ষীতে অপরাধীর বিচারের যেহেতু সুযোগ নেই তাই বর্তমানের প্রচলিত আইনে কোনো অপরাধীর বিচার হতে পারছে না। ধরা পড়লেই অপরাধীরা ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে যায়। একশ্রেণির সংসদ সদস্য বা রাজনৈতিক নেতারাও অপরাধীদের চরিত্রের সাফাই গাইতে মাঠে নেমে পড়ে। যা সত্যিই দুঃখজনক।

বর্তমান প্রচলিত বিচার প্রক্রিয়ায় সত্যিকার অপরাধী বিশেষ করে যারা দেশ ও সমাজের দুশমন এমন কোনো টপ বা মশহুর টেররিস্টদের বিচার করা কোন অবস্থাতেই সম্ভব নয়। তবে ক্ষমতাসীনরা প্রতিপক্ষকে বাগে পেলে তার নিজের আগ্রহে সাক্ষীসাবুদ সংগ্রহ করে অনেক নিরপরাধীর বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। যার প্রমাণ গত চল্লিশ বছরে অনেক আছে। যেহেতু অপরাধীকে শাস্তি দেয়া সবার কাম্য তাই ক্ষমতাসীন সরকারের এই ধরনের উৎসাহী কাজে জনগণও তেমন প্রতিবাদ বা বাধা সৃষ্টি করে না। সরকারের এই ধরনের হত্যাকে দেশের সুশীল ও মানবাধিকার আন্দোলনকারী মহলও আইনের শাসন ও ন্যায় হিসাবেই মেনে নিচ্ছে। কিন্তু সমস্যা বাঁধছে একই সরকার রাষ্ট্রের অন্য অংশ যখন তারা তাদের বিচারে মৃত্যুদণ্ড রায় দিয়ে সে দণ্ড ক্রসফায়ারে কার্যকরি করে ফেলছে।

দুটিই মৃত্যুদণ্ড এবং দুটিই দিয়েছে রাষ্ট্র নিজেই – একটি দিয়েছে তার বিচার বিভাগ আরেকটি দিয়েছে নির্বাহী বিভাগ। দুটি মৃত্যুদণ্ডই কার্যকরী হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে। তবে এই দুটি ধারার বিচারের মূল পার্থক্য হলো, একটি হচ্ছে প্রকাশ্যে এবং অন্যটি হচ্ছে গোপনে। প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ডের রায় ও তা কার্যকরী করার প্রক্রিয়ায় আইনি সহায়তা দেয়ার নামে অনেকের টুপাইস কামানোর বা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা তথাকথিত অপরাধী ও সরকার অর্থাৎ উভয় পক্ষ থেকেই কম বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু ক্রসফায়ারের বেলায় এই সুযোগটা শুধু সরকারের পক্ষেই থাকে এবং তাতে আইনি সহায়তার কোনো সুযোগ থাকে না, যার ফলে একটি সুবিধাভোগী পেশাজীবী গোষ্ঠী খুবই অসন্তুষ্ট হয়। যার ফলে ক্রসফায়ার হলে অনেককেই বেশ হৈচৈ করতে দেখা যায়। এমনকি সরকারীদলের খাস আদমিরাও বেশ ক্রুব্ধ হয়ে উঠেন।

সম্প্রতি একজন অতীব ক্ষমতাশালী আইনপ্রণেতা আইনজীবী যিনি বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে উচ্চ নিম্ন সব আদালতের বিশেষ করে ঢাকার অর্ধেকেরও বেশি, খাস করে জামায়াত ও বিএনপির মামলার দায়িত্ব নিতে হচ্ছে, না হলে নাকি জনগণ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়! এটা আমার কথা নয়, ঢাকার বিভিন্ন আদালত চত্বরে কান পাতলেই তা প্রকাশ্যেই শোনা যায়। ওই বিশেষ ক্ষমতাশালী আইনজীবী সাংসদ সম্প্রীতি একটি ক্রসফায়ারের ব্যাপারে নাখোশ হয়ে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রকাশ্যে গালমন্দ করছেন। উক্ত পরাক্রমশালী সাংসদ অভিযোগ তুলেছেন বিএনপি ও জামায়াতের প্রতিষ্ঠিত র‌্যালি ও ডিবি নাকি তার সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্যই ক্রসফায়ার শুরু করেছে। তাই সাম্প্রতিক ক্রসফায়ারগুলো জনগণের মধ্যে যথেষ্ট আগ্রহ সৃষ্টি করছে। অনেকে যেমন ক্রসফায়ারের প্রতিবাদ প্রকাশ্যে করছে তেমনি আবার জনগণের ভুক্তভোগী বিশাল অংশ এই ক্রসফায়ারকে নীরবে সমর্থনও করছে। জনগণ বিভিন্ন কারণে ও ভয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে রাজি হয় না কিন্তু সাধারণ জনগণ প্রতিটা ক্রসফায়ারে খুশি হয়। সাধারণ মানুষ মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে এই ক্রসফায়ার ছাড়া তাদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। তারা এটাও বিশ্বাস করে আজ পর্যন্ত যত ক্রসফায়ার হয়েছে তার ৯৫% ভাগ ক্রসফায়ারই সঠিক হয়েছে।

অনেকে বিশেষ করে সুশীল সমাজ ও মানবাধিকার আন্দোলনকারীরা ক্রসফায়ারকে বিচারবহির্ভূত হত্যা বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। তাদের কথা মেনে নিলে বিচারের অন্তর্ভুক্ত হত্যা বলে নিশ্চয় কিছু আছে বলে মেনে নিতে হয়। যদি তাই হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, সেই বিচার অন্তর্ভুক্ত হত্যা কারা করে? আমার ব্যক্তিগত বিনীত নিবেদন হলো- হত্যা হত্যাই এবং কোনো হত্যাই কাম্য নয়। কোনো নিরাপরাধীর হত্যাতো কোনো অবস্থাতেই মেনে নেয়া যায় না। তবে অপরাধীকে তার প্রাপ্য মৃত্যুদণ্ড দিতে বিচার অন্তর্ভুক্ত বা বহির্ভূত যেভাবেই হোক হত্যা করাকে মেনে নিতে জনগণ প্রস্তুত। সরকার যদি অপরাধীকে হত্যা তা বিচারের অন্তর্ভুক্ত হোক বা বহির্ভূতই হোক তা করে যদি জননিরাপত্তা ও জনগণের জান-মাল নিরাপদ ও রাষ্ট্রের ও সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারে তাহলে সে হত্যায় জনগণের পূর্ণ সমর্থন থাকবে। প্রয়োজনে এই লেখার প্রথমে বর্ণিত দেশ ও জাতির দুশমনদের ধ্বংস করার জন্য হত্যা করতে আইন করে র‌্যাব ও পুলিশকে অনুমতি দেয়া হোক। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট র‌্যাব ও ডিবির দপ্তরে তিন সদস্য বিশিষ্ট ক্রসফায়ার সেল করা হোক যারা অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে প্রতিটি ক্রসফায়ারের পূর্বে বিচার বিশ্লেষণ করে ক্রসফায়ারের সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করবে।

কোনো ক্রসফায়ার ব্যক্তিগত আক্রোশ অথবা ব্যক্তিস্বার্থে হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য র‌্যাব ও পুলিশ সদর দপ্তরের একটি করে ক্রসফায়ার মূল্যায়ন কমিটি করা যেতে পারে। ওই কমিটি ক্রসফায়ারের পরে প্রতিটি ঘটনার বিস্তারিত পর্যালোচনা করে দেখবে এবং কমিটি যদি কোনো ক্রসফায়ারে আক্রোশ বা ব্যক্তিস্বার্থের ন্যূনতম আলামত পায় তাহলে জড়িত কর্মকর্তাকেও ক্রসফায়ারে দেবে। র‌্যাব ও পুলিশ সদর দপ্তরে আলাদা দুটি কমিটি করে র‌্যাবের বেলায় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল পদমর্যাদার অফিসারকে প্রধান করে র‌্যাবের ডিডিজি, একজন জেলা ও দায়রা জজ এবং পুলিশের বেলায় একজন সচিবকে প্রধান করে পুলিশের একজন আইজি ও জেলা ও দায়রা জজকে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব দিতে হবে; যারা সপ্তাহে অন্তত দুইদিন বসে সব ক্রসফায়ারের ঘটনা পর্যালোচনা করবে। ক্রসফায়ার অপপ্রয়োগ হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের ব্যবস্থা করবে এবং তাদের নির্দেশ র‌্যাব ও ডিবিকে বিনা প্রশ্নে মানতে এবং কার্যকরী করতে হবে।

ক্রসফায়ার বন্ধ করা যাবে না। ক্রসফায়ারকে আইনি বৈধতা দিতে হবে। এটি আজকের সময়ের দাবি। যারা অপরাধ করে বা অপরাধের সুবিধাভোগী বা দুর্বলচিত্তের বা দুর্নীতিপরায়ণ বা সুবিধাবাদী বা সুযোগসন্ধানী তারা কেউই ক্রসফায়ার চাইবে না; কিন্তু এর বাইরের তাবৎ জনগণ ক্রসফায়ারের পক্ষে। ক্রসফায়ার বিচার অন্তর্ভুক্ত হত্যা এবং এই হত্যা করার প্রকাশ্য সরকারি ঘোষণা দিলেই অপরাধ করা ৯০% ভাগ কমে যাবে। হয়তো এখন যে হারে ক্রসফায়ার হয় ক্রসফায়ারকে বৈধতা দিলে তা ১০% ভাগে নেমে আসবে বা হয়তো প্রয়োজনও পড়বে না বলেই জনগণের বিশ্বাস। যদি বিশ্বাস না হয় তা হলে আইনটা করেই দেখুন, র‌্যাব গঠন করার পরে যেভাবে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছিল তার চেয়েও ভালোভাবে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এখন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়। যে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সময় তাদেরই করায়ত্ত হবে। জনগণ শান্তি চায় এবং শান্তির জন্যই ক্রসফায়ার দরকার।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর