ঢাকা ০৬:২৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রোহিঙ্গাদের হত্যা ধর্ষণ নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৪২:৫১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ অক্টোবর ২০১৭
  • ২৯৫ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করতেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

বুধবার (১৮ অক্টোবর) মানবাধিকার সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করার প্রমাণ তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, মিয়ানমার থেকে ‘স্থায়ীভাবে রোহিঙ্গাদের বের করে দিতেই’ এসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে করা প্রতিবেদনে রাখাইনে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের লোমহর্ষক চিত্র উঠে এসেছে। এ নির্যাতন বন্ধ না হওয়ায় বাংলাদেশ অভিমুখে রোহিঙ্গা স্রোতও থামছে না।

এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। রাখাইন রাজ্য থেকে ঘুরে গিয়ে জাতিসংঘের অপর এক শীর্ষ কর্মকর্তা জেফ্রি ফেল্টম্যান বলেন, তিনি সেখানে বহু পুড়ে যাওয়া বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখেছেন। মঙ্গলবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্যাটেলাইট ছবি, ফটো, ভিডিও এবং অন্যান্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে অ্যামনেস্টি তাদের প্রতিবেদনে বলছে, হাজার হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ এবং শিশু একটি ব্যাপক ও পরিকল্পিত আক্রমণের শিকার হয়েছেন, যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সমান। বিবিসি জানায়, রাখাইন রাজ্য থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১২০ রোহিঙ্গা নারী এবং পুরুষের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে অ্যামনেস্টি। প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম চুক্তিতে ১১ ধরনের অপরাধকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রাখাইন রাজ্যের সহিংসতায় এ ধরনের ছয়টি অপরাধ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে খুন, বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য করা, নির্যাতন, ধর্ষণ, নিপীড়ন এবং অন্যান্য অমানবিক কর্মকান্ড। সবচেয়ে নৃশংস অপরাধের প্রত্যক্ষদর্শীরা এসব তৎপরতার জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ড, ৩৩ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন এবং সীমান্তরক্ষা বাহিনীকে দায়ী করেছেন।

২৫ আগস্ট রাখাইনে কয়েকটি পুলিশ ও একটি সেনা চৌকিতে হামলা চালায় রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন আরসা। এতে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য নিহত হন। এর জেরে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ সামরিক অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা। এ প্রসঙ্গে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সংকট মোকাবিলা বিষয়ক পরিচালক টিরানা হাসান বলেন, রাখাইনের সব রোহিঙ্গাদের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী; তারা স্পষ্টভাবে রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে চিরতরে বিতাড়িত করার চেষ্টায় আছে। তিনি বলেন, এ নৃশংস অপরাধের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে প্রথম ধাপ হচ্ছে এসব অপরাধের কথা ফাঁস করে দেয়া। যারা এসব অপরাধ করেছে তাদের অবশ্যই বিচার করতে হবে। টিরানা হাসান বলেন, আরেকটি ভুয়া অভ্যন্তরীণ তদন্তের নামে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এসব ঘটনাকে কোনোমতেই ধামাচাপা দিতে পারে না।

ধর্ষণ এবং বিভিন্ন যৌন অপরাধ : অ্যামনেস্টি বলছে, তদন্তে তারা প্রমাণ পেয়েছে, (রাখাইনের) মংডুর মিন গিই গ্রাম (তুলাতলী নামেও পরিচিত) এবং বুথিডংয়ের কিউন পক গ্রামের কোনো কোনো নারীকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ধর্ষণ করেছে। অ্যামনেস্টি যৌন সহিংসতার শিকার সাতজন রোহিঙ্গা নারীর সঙ্গে কথা বলেছে। তাদের মধ্যে চারজন নারী এবং ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরী। পরিচয় গোপন রেখে ‘এসকে’ নামে ৩০ বছর বয়সী রোহিঙ্গা নারীর সাক্ষ্য প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে অ্যামনেস্টি। ওই নারী বলেন, তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে নারীদের আলাদা করে ফেলে। আমিসহ পাঁচ নারীকে চার সেনা আটকে রাখে। তারা আমাদের কাছ থেকে জোর করে টাকাপয়সা ও অন্যান্য জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। তিনি বলেন, আমার দুই বছরের ছেলে শফিকে তারা লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করে। এক আঘাতেই শফি সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। আমার বাকি তিন ছেলেকেও খুন করা হয়। তিনি বলেন, এরপর নগ্ন করে তাদের হাতের লাঠি দিয়ে আমাদের আঘাত করার পর আমরা দুর্বল হয়ে পড়ি। তারা লাঠি দিয়ে আমাদের যৌনাঙ্গেও আঘাত করেছে। এরপর তারা আমাদের ধর্ষণ করে। লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটি বলছে, নারী ও শিশুদের ধর্ষণের পর রোহিঙ্গা বাড়িগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।

রাখাইনে হত্যালীলা : প্রতিবেদনে বলা হয়, আগস্টের শেষ দিকে আরসার হামলার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা বেসামরিক জনগণের ওপর প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালানো শুরু করে। তাদের সঙ্গে কখনও কখনও যোগ দেয় স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী। এসব হামলার মুখে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষরা যখন পালাতে থাকেন, তখন সেনা এবং পুলিশ সদস্যরা পেছন থেকে তাদের গুলি করে হত্যা করে। বার বছর বয়সী ফাতিমা অ্যামনেস্টিকে জানায়, তার আট ভাইবোন, মা-বাবা এবং বৃদ্ধ দাদি একদিন দেখতে পান গ্রামের অন্য অংশ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। ভয়ে তারা দৌড়ে বাড়ি ছেড়ে পালানোর সময় উর্দি পরা কিছু লোক পেছন থেকে তাদের ওপর গুলি চালায়। তার বাবা এবং ১০ বছর বয়সী বোনের গায়ে গুলি লাগে। তার নিজের ডান উরুতেও গুলি লাগে। এ সংকটের প্রকৃত চিত্র উদঘাটনের জন্য অ্যামনেস্টি রাখাইনে জাতিসংঘকে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।

সংকট সমাধানে চেষ্টা অব্যাহত থাকবে-গুতেরেস : জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তার ব্যক্তিগত ও জাতিসংঘের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদর দফতরে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তিনি এ অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। বৈঠকে তারা রোহিঙ্গা সমস্যাসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক এজেন্ডা নিয়ে মতবিনিময় করেন। বাংলাদেশের এসডিজি বাস্তবায়ন কার্যক্রমে মহাসচিব বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ভূমিকার প্রশংসা করেন এবং এক্ষেত্রে স্পিকারসহ সংসদ সদস্যদের সাধুবাদ জানান।

রাখাইন পরিস্থিতির বর্ণনা দিলেন জাতিসংঘ কর্মকর্তা : রাখাইন রাজ্য থেকে ঘুরে গিয়ে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জেফ্রি ফেল্টম্যান বলেন, তিনি সেখানে বহু পুড়ে যাওয়া বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখেছেন। মিয়ানমারে পাঁচ দিনের সফর শেষে মঙ্গলবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন। তিনি রাখাইনে সিত্তের পাশের কয়েকটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, আমি দেখেছি পরিকল্পিত বৈষম্যের কারণে কীভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আর্থ-সামাজিকভাবে প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সরবরাহের সুযোগ দিতে আবারও তিনি মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

এখনও আসছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা : রাখাইন রাজ্যে নতুন করে রোহিঙ্গা নিপীড়ন শুরু হওয়ার পর বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী এগিয়ে আসার প্রায় দুই মাস হতে চললো। মাঝে কয়েক দিন রোহিঙ্গা স্রোত কম থাকলেও সম্প্রতি এ সংখ্যা বেড়েছে। এ নিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচআর একটি ড্রোন থেকে তোলা একটি ভিডিও চিত্র প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, একটি ছোট্ট নদীর পাড় ধরে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলছে, রাখাইনে কমপক্ষে ২৮৮টি রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

রোহিঙ্গাদের হত্যা ধর্ষণ নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা

আপডেট টাইম : ১২:৪২:৫১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ অক্টোবর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করতেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

বুধবার (১৮ অক্টোবর) মানবাধিকার সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করার প্রমাণ তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, মিয়ানমার থেকে ‘স্থায়ীভাবে রোহিঙ্গাদের বের করে দিতেই’ এসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে করা প্রতিবেদনে রাখাইনে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের লোমহর্ষক চিত্র উঠে এসেছে। এ নির্যাতন বন্ধ না হওয়ায় বাংলাদেশ অভিমুখে রোহিঙ্গা স্রোতও থামছে না।

এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। রাখাইন রাজ্য থেকে ঘুরে গিয়ে জাতিসংঘের অপর এক শীর্ষ কর্মকর্তা জেফ্রি ফেল্টম্যান বলেন, তিনি সেখানে বহু পুড়ে যাওয়া বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখেছেন। মঙ্গলবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্যাটেলাইট ছবি, ফটো, ভিডিও এবং অন্যান্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে অ্যামনেস্টি তাদের প্রতিবেদনে বলছে, হাজার হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ এবং শিশু একটি ব্যাপক ও পরিকল্পিত আক্রমণের শিকার হয়েছেন, যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সমান। বিবিসি জানায়, রাখাইন রাজ্য থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১২০ রোহিঙ্গা নারী এবং পুরুষের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে অ্যামনেস্টি। প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম চুক্তিতে ১১ ধরনের অপরাধকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রাখাইন রাজ্যের সহিংসতায় এ ধরনের ছয়টি অপরাধ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে খুন, বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য করা, নির্যাতন, ধর্ষণ, নিপীড়ন এবং অন্যান্য অমানবিক কর্মকান্ড। সবচেয়ে নৃশংস অপরাধের প্রত্যক্ষদর্শীরা এসব তৎপরতার জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ড, ৩৩ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন এবং সীমান্তরক্ষা বাহিনীকে দায়ী করেছেন।

২৫ আগস্ট রাখাইনে কয়েকটি পুলিশ ও একটি সেনা চৌকিতে হামলা চালায় রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন আরসা। এতে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য নিহত হন। এর জেরে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ সামরিক অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা। এ প্রসঙ্গে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সংকট মোকাবিলা বিষয়ক পরিচালক টিরানা হাসান বলেন, রাখাইনের সব রোহিঙ্গাদের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী; তারা স্পষ্টভাবে রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে চিরতরে বিতাড়িত করার চেষ্টায় আছে। তিনি বলেন, এ নৃশংস অপরাধের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে প্রথম ধাপ হচ্ছে এসব অপরাধের কথা ফাঁস করে দেয়া। যারা এসব অপরাধ করেছে তাদের অবশ্যই বিচার করতে হবে। টিরানা হাসান বলেন, আরেকটি ভুয়া অভ্যন্তরীণ তদন্তের নামে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এসব ঘটনাকে কোনোমতেই ধামাচাপা দিতে পারে না।

ধর্ষণ এবং বিভিন্ন যৌন অপরাধ : অ্যামনেস্টি বলছে, তদন্তে তারা প্রমাণ পেয়েছে, (রাখাইনের) মংডুর মিন গিই গ্রাম (তুলাতলী নামেও পরিচিত) এবং বুথিডংয়ের কিউন পক গ্রামের কোনো কোনো নারীকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ধর্ষণ করেছে। অ্যামনেস্টি যৌন সহিংসতার শিকার সাতজন রোহিঙ্গা নারীর সঙ্গে কথা বলেছে। তাদের মধ্যে চারজন নারী এবং ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরী। পরিচয় গোপন রেখে ‘এসকে’ নামে ৩০ বছর বয়সী রোহিঙ্গা নারীর সাক্ষ্য প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে অ্যামনেস্টি। ওই নারী বলেন, তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে নারীদের আলাদা করে ফেলে। আমিসহ পাঁচ নারীকে চার সেনা আটকে রাখে। তারা আমাদের কাছ থেকে জোর করে টাকাপয়সা ও অন্যান্য জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। তিনি বলেন, আমার দুই বছরের ছেলে শফিকে তারা লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করে। এক আঘাতেই শফি সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। আমার বাকি তিন ছেলেকেও খুন করা হয়। তিনি বলেন, এরপর নগ্ন করে তাদের হাতের লাঠি দিয়ে আমাদের আঘাত করার পর আমরা দুর্বল হয়ে পড়ি। তারা লাঠি দিয়ে আমাদের যৌনাঙ্গেও আঘাত করেছে। এরপর তারা আমাদের ধর্ষণ করে। লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটি বলছে, নারী ও শিশুদের ধর্ষণের পর রোহিঙ্গা বাড়িগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।

রাখাইনে হত্যালীলা : প্রতিবেদনে বলা হয়, আগস্টের শেষ দিকে আরসার হামলার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা বেসামরিক জনগণের ওপর প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালানো শুরু করে। তাদের সঙ্গে কখনও কখনও যোগ দেয় স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী। এসব হামলার মুখে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষরা যখন পালাতে থাকেন, তখন সেনা এবং পুলিশ সদস্যরা পেছন থেকে তাদের গুলি করে হত্যা করে। বার বছর বয়সী ফাতিমা অ্যামনেস্টিকে জানায়, তার আট ভাইবোন, মা-বাবা এবং বৃদ্ধ দাদি একদিন দেখতে পান গ্রামের অন্য অংশ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। ভয়ে তারা দৌড়ে বাড়ি ছেড়ে পালানোর সময় উর্দি পরা কিছু লোক পেছন থেকে তাদের ওপর গুলি চালায়। তার বাবা এবং ১০ বছর বয়সী বোনের গায়ে গুলি লাগে। তার নিজের ডান উরুতেও গুলি লাগে। এ সংকটের প্রকৃত চিত্র উদঘাটনের জন্য অ্যামনেস্টি রাখাইনে জাতিসংঘকে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।

সংকট সমাধানে চেষ্টা অব্যাহত থাকবে-গুতেরেস : জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তার ব্যক্তিগত ও জাতিসংঘের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদর দফতরে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তিনি এ অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। বৈঠকে তারা রোহিঙ্গা সমস্যাসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক এজেন্ডা নিয়ে মতবিনিময় করেন। বাংলাদেশের এসডিজি বাস্তবায়ন কার্যক্রমে মহাসচিব বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ভূমিকার প্রশংসা করেন এবং এক্ষেত্রে স্পিকারসহ সংসদ সদস্যদের সাধুবাদ জানান।

রাখাইন পরিস্থিতির বর্ণনা দিলেন জাতিসংঘ কর্মকর্তা : রাখাইন রাজ্য থেকে ঘুরে গিয়ে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জেফ্রি ফেল্টম্যান বলেন, তিনি সেখানে বহু পুড়ে যাওয়া বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখেছেন। মিয়ানমারে পাঁচ দিনের সফর শেষে মঙ্গলবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন। তিনি রাখাইনে সিত্তের পাশের কয়েকটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, আমি দেখেছি পরিকল্পিত বৈষম্যের কারণে কীভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আর্থ-সামাজিকভাবে প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সরবরাহের সুযোগ দিতে আবারও তিনি মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

এখনও আসছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা : রাখাইন রাজ্যে নতুন করে রোহিঙ্গা নিপীড়ন শুরু হওয়ার পর বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী এগিয়ে আসার প্রায় দুই মাস হতে চললো। মাঝে কয়েক দিন রোহিঙ্গা স্রোত কম থাকলেও সম্প্রতি এ সংখ্যা বেড়েছে। এ নিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচআর একটি ড্রোন থেকে তোলা একটি ভিডিও চিত্র প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, একটি ছোট্ট নদীর পাড় ধরে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলছে, রাখাইনে কমপক্ষে ২৮৮টি রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।