হাওর বার্তা ডেস্কঃ হবিগঞ্জের চা বাগানগুলোতে সুদখোর ও দাদন ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা উদ্ধেগজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। চড়া সুদে টাকা দিয়ে সপ্তাহের শেষে শ্রমিকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। দীর্ঘদিন ধরে এ অপকর্মটি চলে আসলেও দাদন ও সুদখোর ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধে কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। ফলে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা চা শ্রমিকরা দিনে দিনে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে। প্রকাশ, সিলেট বিভাগের ১৩৮টি চা বাগানের মধ্যে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট, মাধবপুর, নবীগঞ্জ, বাহুবলে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ২২টি চা বাগান রয়েছে। প্রতি বছর এসব বাগান থেকে উৎপন্ন হচ্ছে বিপুল পরিমাণ চা।
যা দেশের চাহিদা পূরণ করেও বিদেশে রপ্তানি করা হয়। দেশীয় ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী চা শিল্পে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিক। বৃটিশ আমল থেকে সভ্য সমাজের আলো-বাতাস বঞ্চিত এসব শ্রমিক সারা দিন খাটুনির পর হাজিরা পায় জনপ্রতি ৪৮-৫০ টাকা। যা একটি সংসারের ভরণ-পোষণের জন্য একেবারেই ন্যূনতম। চা বাগান থেকে প্রাপ্ত কিছু বাড়তি সুযোগ মিলিয়ে হাজিরায় টাকায় কিছু কিছু শ্রমিক তাদের পোষ্যদের নিয়ে অতিকষ্টে দিন অতিবাহিত করতে পারলেও বৃহৎ অংশটির কাছে তা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর এ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে দাদন ও সুদখোর ব্যবসায়ীরা। সংঘবদ্ধ চক্রটি এ সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় শর্ত সাপেক্ষে। ১ হাজার টাকায় সপ্তাহে ১০০ টাকা সুদ। মাসের ৪ সপ্তাহে হাজারে ৪০০ টাকা। একজন শ্রমিক সপ্তাহে ৬ কর্মদিবসে মজুরি পাচ্ছে ২৮৮ থেকে ৩০০ টাকা। ২ হাজার টাকা ঋণগ্রস্ত রশিদপুর চা বাগানের জনৈক শ্রমিক জানান, দাদন ব্যবসায়ীর ২০০ টাকা পরিশোধ করার পর মাত্র ৮৮-১০০ টাকা হাতে থাকে তার। যা নিয়ে পরবর্তী সপ্তাহের খরচ চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে। ফলে বাধ্য হয়ে তাকে পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। অথচ একত্রে ২ হাজার টাকা যোগাতে না পেরে মহাজনের ঋণও পরিশোধ করা যাচ্ছে না। সরজমিন বিভিন্ন চা বাগান ঘুরে দেখা গেছে, দাদন ব্যবসায়ীও সুদখোর চক্রটির সদস্যরা চা বাগান সংলগ্ন গ্রামের বাসিন্দা। শ্রমিকদের কাছে ওরা বস্তির লোক হিসেবে পরিচিত। বিকেল গড়িয়ে এলেই সুদখোর মহাজনরা বাগানের বিভিন্ন লাইনে ঘোরাফেরা করে। এরা টাকা নিয়ে শ্রমিকদের প্রলুব্ধ করে। অভাবগ্রস্ত শ্রমিকরা চোখের সামনে মহাজনের হাতে ৫০০ ও হাজার টাকার নোট দেখে লোভ সামলাতে পারে না। ভবিষ্যৎ পরিণামের কথা না ভেবেই এরা টাকা নিয়ে নিচ্ছে। একত্রে ১ হাজার টাকায় সপ্তাহে সুদ পরিশোধ করবে ১০০ টাকা। যা ৪ সপ্তহের মাসের হিসাবে সুদেরহার শতকরা ৪২ ভাগেরও উপরে। কোনো কোনো শ্রমিক ১০০ থেকে ৫০০০ টাকা বা এরও উপরে ঋণ গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে মজুরির টাকায় সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে যখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে ঋণগ্রস্ত শ্রমিকরা নিজের শেষ সহায় সম্বল গরু-ছাগল ও ঘরের মূল্যবান জিনিসপত্র বিক্রি করে তা পরিশোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে জেলার সব কয়টি বাগানে সুদখোর দাদন ব্যবসায়ীদের এ অপতৎপরতা অব্যাহত থাকলেও তা রোধে বাগান কর্তৃপক্ষ কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ফলে দিনে দিনে যেমন শক্তিশালী হচ্ছে দাদন ও সুদখোর ব্যবসায়ীদের ঋণ কার্যক্রম তেমনি নিঃস্ব থেকে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে চা বাগানের শ্রমিকরা। এ ব্যপারে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি চা বাগানকে ঘিরে সুদখোর দাদন ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ওই চক্রের সদস্যরা চা বাগানের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর বাসিন্দা। ওরা পেশি শক্তিতে বলিয়ান। ফলে ঋণ গ্রহণে শ্রমিকদের আগ্রহ থাকায় চা বাগানে সুদখোরদের ও দাদন ব্যবসায়ীদের অবাধ বিচরণ রোধ করা যাচ্ছে না।