তিন দফায় চিঠি দেওয়ার পরেও সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত টাকা ফেরত আনার বিষয়ে কোনো সাড়া মেলেনি। আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে গচ্ছিত ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ফেরত আনাটা অনেকটাই অনিশ্চিত বলে একটি সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকে (এসএনবি) তিন দফায় চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ব্যাপারে এসএনবির সাড়া না মেলায় ফের চিঠি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০১৪ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ৫০ কোটি ৬০ লাখ সুইস ফ্রাঁ গচ্ছিত রয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা (এক ফ্রাঁ ৮৫ টাকা হিসাবে)। ২০১৩ সালে এ অর্থের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ১৬০ কোটি টাকা। এর আগে ২০১২ সাল শেষে ছিল এক হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, নাগরিকত্ব গোপন রেখে যারা সুইস ব্যাংকে টাকা রেখেছেন, তাদের তথ্য অবশ্য এ প্রতিবেদনে আনা হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সুইস ব্যাংকে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশের যেসব নাগরিকের টাকা জমা রয়েছে তাদের তালিকা চাওয়া হয়। সুইস ব্যাংক সে চিঠির কোনো জবাব দেয়নি। এ ছাড়া পাচার করা টাকার তথ্য সংগ্রহ করতে সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে এমওইউ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চিঠি দেওয়া হয়। সে চিঠিরও কোনো জবাব মেলেনি। পরে বিশ্বখ্যাত এইচএসবিসির মাধ্যমে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ থেকেও সুইজারল্যান্ড শাখায় টাকা পাচারের তথ্য প্রকাশিত হলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চিঠি দিয়ে সে তালিকাও চাওয়া হয়। কিন্তু তারও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) না থাকায় পাচার হওয়া টাকা সম্পর্কে কোনো তথ্য বা অর্থ ফেরত আনা যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমরা তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। এ ব্যাপারে বিশ্বের পাঁচটি দেশের সঙ্গে এমওইউ হয়েছে। কিন্তু এখনো সুইস ব্যাংকের সঙ্গে এমওইউ হয়নি। ফলে তাদের সহায়তা পাওয়া কঠিন।’
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন বাস্তবায়নে কাজ করছে এগমন্ট গ্রুপ। বাংলাদেশ দুই বছর আগে এর সদস্য হয়েছে। সুইজারল্যান্ডও এগমন্টের সদস্য। এই গ্রুপের সদস্য দেশগুলো পরস্পর তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। এর আওতায় অনেক দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তথ্য বিনিময় হচ্ছে। সুইস ব্যাংকের ক্ষেত্রেও এই নীতি প্রয়োগ হতে পারে।’
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এম সাইদুজ্জামান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘পাচার করা অর্থ ফেরত না আনার কারণে দিন দিন সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকা বাড়ছে। সেখানে টাকা রাখাকে নিরাপদ মনে করেন অবৈধ টাকার কিছু মালিকরা। এ ছাড়াও হুন্ডি, রপ্তানি ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং (কম মূল্য দেখানো) ও আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিংয়ের (বেশি মূল্য দেখানো) মাধ্যমে দেশের টাকা পাচার করা হচ্ছে।’
অর্থ পাচারের প্রবণতা বন্ধে দেশে বিনিয়োগ উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যক্তি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক আমদানি পণ্যের ওপর গভীর নজরদারির পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের কাজের সমন্বয় বাড়ানোর প্রতি তাগিদ দেন প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ।
পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের চেষ্টাই কার্যকর হবে না বলে মনে করনে বিশ্বব্যাংকের ঢাকাস্থ প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হাসান। শনিবার মুঠোফোনে তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সুইস ব্যাংক কালো টাকা মালিকদের নিরাপদ ঠিকানা। এই নিরাপদ ঠিকানাকে নিরাপদহীন করতে হলে কূটনৈতিক তৎপরতা থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা নেই বললেই চলে।’
এ সমস্যার সমাধানের জন্য দুই দেশের মধ্যে চুক্তিভিত্তিক একটি আইনি কাঠামো তৈরি করার মত দেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এই অর্থনীতিবিদ।