তুখোড় মেধাবী শাকিলা ফারজানা দেশে ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করেছেন। পরে লন্ডন থেকে অর্জন করেন ব্যারিস্টার অ্যাট ল ডিগ্রি। সাত বছর ধরে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে সুনামের সঙ্গে বিভিন্ন মামলা পরিচালনা করে আসছেন। আইনজীবী পরিচয়ের বাইরে ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানার একটি রাজনৈতিক পরিচয়ও রয়েছে। তিনি বিএনপির মনোনয়নে চট্টগ্রামের হাটহাজারী আসন থেকে নির্বাচিত প্রাক্তন সাংসদ ও হুইপ সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের কন্যা। ব্যক্তিজীবনে বিবাহিতা ব্যারিস্টার শাকিলা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামেরও একজন নেত্রী।
সুপ্রিম কোর্টের পরিচিত মুখ শাকিলা ফারজানা চট্টগ্রামকেন্দ্রিক জঙ্গি সংগঠন ‘শহীদ হামজা ব্রিগেড’কে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। গত মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে ঢাকার ধানমন্ডি থেকে তাকে গ্রেফতার করে চট্টগ্রাম র্যাব-৭-এর একটি দল। একই সময় গ্রেফতার করা হয় তার দুই সহযোগী আইনজীবীকেও। র্যাবের দাবি, ব্যারিস্টার শাকিলা ও তার দুই সহযোগী হামজা ব্রিগেডের ব্লু গ্রুপের নেতাকে ১ কোটি ৮ লাখ টাকা দিয়েছেন। তবে তার পারিবারিক সূত্র ও সহকর্মী আইনজীবীরা জানিয়েছেন, মামলা পরিচালনার অর্থ লেনদেনের অংশ হিসেবে ওই আর্থিক লেনদেনের ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রাম র্যাব-৭-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতা উদ্দিন আহমেদ জানান, ব্যারিস্টার শাকিলা যে শহীদ হামজা ব্রিগেডকে অর্থায়ন করেছেন, তার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই দুই সহযোগীসহ তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। র্যাব অধিনায়ক বলেন, ‘জঙ্গি সংগঠন শহীদ হামজা ব্রিগেড-এর অন্যতম সংগঠক মনিরুজ্জামান ডনের ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনা এবং আদালতে তার দেওয়া জবানবন্দির ভিত্তিতে এই আইনজীবীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। হামজা ব্রিগেডের ব্লু গ্রুপের নেতা মনিরুজ্জামান ডনের ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে গ্রেফতারকৃতরা অর্থ সহায়তা করতেন। শাকিলা ফারজানা ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা করতেন বলেও আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ডন স্বীকার করেছেন।’
র্যাব অধিনায়ক জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি টাকা ব্যাংকে জমা দিলে ফরম পূরণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা সেই সব ফরম পূরণ করেই অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিতেন। র্যাবের তদন্তে দেখা গেছে, শহীদ হামজা ব্রিগেডের ব্লু গ্রুপের নেতা মনিরুজ্জামান ডনের অ্যাকাউন্টে মোট ১ কোটি ৩৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা জমা হয়েছে। এর মধ্যে ১ কোটি ৮ লাখ টাকা জমা দিয়েছেন ব্যারিস্টার শাকিলা ও তার সহযোগী দুই আইনজীবী। শাকিলা দুই দফায় মোট ৫২ লাখ টাকা জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে প্রথম দফায় ২৫ এবং দ্বিতীয় দফায় ২৭ লাখ টাকা দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া অ্যাডভোকেট লিটন ৩১ লাখ টাকা ও অ্যাডভোকেট বাপন দিয়েছেন ২৫ লাখ টাকা। লিটন আর বাপন যে টাকা ব্যাংকে জমা দিয়েছেন, সেই টাকাও শাকিলাই দিয়েছেন বলে র্যাবের ধারণা। হামজা গ্রুপের নেতার হিসাব নম্বরে জমা হওয়া ওই টাকা দিয়েই হামজা ব্রিগেডের নেতা-কর্মীদের বাসাভাড়া, থাকা-খাওয়া, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র কেনাসহ যাবতীয় সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো।
এদিকে, চট্টগ্রামে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে করা অধিকাংশ মামলা হাইকোর্টে চালাতেন বিএনপি নেতা সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের মেয়ে ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা। স্বল্প খরচ ও বেশির ভাগ মামলায় আসামিপক্ষকে সুবিধা নিয়ে দিতে পারার কারণে তার কাছেই ছুটে যেতেন চট্টগ্রামের বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন মামলার আসামিরা। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সরকারবিরোধী আন্দোলনে ভাংচুর, নাশকতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে চট্টগ্রামে বিএনপি-জামায়াত ও জঙ্গি সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সহস্রাধিক মামলার মধ্যে অর্ধেকই পরিচালনা করতেন শাকিলা। এছাড়া ২০০৫ সালে দেশজুড়ে জঙ্গিরা যে সিরিজ বোমা হামলা চালিয়েছিল ওই হামলার ঘটনায় চট্টগ্রামসহ সারা দেশে জেএমবি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা মামলার মধ্যে সাড়ে তিনশ’ মামলা পরিচালনার ভারও ছিল শাকিলার হাতে। জঙ্গিদের মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে তাদের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করা এবং এ সুবাদে জঙ্গি কার্যক্রম ও অর্থায়ন সম্পর্কেও অনেক কিছুই জানেন শাকিলা। শুধু জানেনই না তিনি নিজেই অর্থায়নের মাধ্যমে জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছেন বলে দাবি র্যাবের। শাকিলার পরিবারের পক্ষ থেকে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ অস্বীকার করে বলা হয়েছে- জঙ্গি অর্থায়ন নয়, মামলা পরিচালনার জন্য জঙ্গিরা যে টাকা তাকে দিয়েছিলেন শাকিলা মামলায় সফল না হওয়ায় সেসব টাকা ফেরত দিয়েছেন জঙ্গিদের অ্যাকাউন্টে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদেও এমন কথা বলেছেন শাকিলা। তবে র্যাব দাবি করছে, দেশব্যাপী জঙ্গি কার্যক্রম বিস্তার ও জঙ্গিদের অর্থায়ন সম্পর্কে আরও নতুন নতুন তথ্য দিয়েছেন শাকিলা। জঙ্গিদের বিদেশী অর্থদাতা মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী আল্লামা লিদবি ও আরেকজন বড় ভাই সম্পর্কেও শাকিলার কাছে তথ্য রয়েছে।
শুক্রবার সন্ধ্যায় র্যাব-৭ এর সিও মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জঙ্গি কার্যক্রম সম্পর্কে শাকিলার কাছ থেকে আমরা আরও নতুন নতুন তথ্য পাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে এখনই তা বলতে পারছি না। সময় হলে সব বলব।’ শুক্রবারও দিনভর শাকিলা ও তার দুই জুনিয়রকে র্যাব সদর দফতরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। ঢাকা থেকে বুধবার গ্রেফতারের পর বাঁশখালীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে তাদের ৪ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। শুক্রবার তিন আইনজীবীকে দ্বিতীয় দিনের মতো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে র্যাব বলছে, গ্রেফতার তিনজনই আইনজীবী হওয়ায় জিজ্ঞাসাবাদে তারা অনেক কিছুই কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছেন। জঙ্গি অর্থায়ন নয়, মামলা পরিচালনার জন্য জঙ্গি ক্লায়েন্টদের দেয়া টাকা মামলা সফল না হওয়ায় ফেরত দেয়া হয়েছে- শাকিলার পরিবারের এমন বক্তব্য সম্পর্কে র্যাবের সিইও বলেন, ‘এটা ঠিক নয়। সময় হলে আমরা এর জবাব দেব।’