হাওর বার্তা ডেস্কঃ ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড আক্রমণে আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হয়। আক্রমণের প্রধান টার্গেট শেখ হাসিনা হলেও তিনি বেঁচে যান।
এটাকে অনেকে বলছেন অলৌকিক ঘটনা। কেন ও কারা আক্রমণ করেছে—সেটি এখন আর কারো অজানা নয়। হিসাবটা অতিসহজ ও সরল। শেখ হাসিনা বেঁচে থাকলে, ক্ষমতায় গেলে জাতির পিতার খুনি, যুদ্ধাপরাধী, রাষ্ট্র ও দেশের বিরুদ্ধে যারা ভয়ংকর সব অপরাধ করেছে তারা কেউ রেহাই পাবে না। সবাইকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। গত কয়েক বছরে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু কি বিচিত্র এই দেশ! আত্মস্বীকৃত খুনিদের যাঁরা পুরস্কৃত করেছেন তাঁরা এবং ট্রাকের পর ট্রাক যুদ্ধাস্ত্র চোরাচালানিদের পৃষ্ঠপোষক ও সহযোগীরা এ দেশের রাজনীতিতে বহাল তবিয়তে অধিষ্ঠিত আছেন। এ দায় কার? আমার, আপনার—সবার। ৩০ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে পাওয়া এই মাতৃভূমি, বড় দাম দিতে হয়েছে।সুতরাং সব কিছুর ঊর্ধ্বে দেশ—এ কথা যাঁরা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, তাঁদের এই সত্য উপলব্ধি করতে হবে যে ওই সব রাহুর কবল থেকে রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে মুক্ত করতে না পারলে দেশপ্রেমের কোনো মূল্য থাকে না, সবই ফাঁকা বুলি হয়ে যায়।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের আক্রমণে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী ও নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীদের একাংশ চিহ্নিত হয়েছে। বিচার চলছে। আশা করা যায়, এ পর্যন্ত যারা অভিযুক্ত হয়েছে তারা যথার্থ দণ্ডে দণ্ডিত হবে। কিন্তু অভিযুক্তদের মধ্যে যাঁরা পালের গোদা, তাঁরা অনেকেই পলাতক। শোনা যায়, তাঁরা বিদেশে আছেন। বিদেশে বসে তাঁরা কী করছেন, তা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এর মধ্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও প্রধান নেতা গত ৮-৯ বছর ধরে লন্ডনে বসবাস করছেন। আদালত তাঁকে পলাতক ঘোষণা করেছেন। লন্ডনে তারেক রহমানের কর্মকাণ্ড ও ভূমিকা নিয়ে নানা কথা বাজারে চালু আছে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথাও শোনা যায়। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আইএসআইয়ের জড়িত থাকার কথা এখন আর গোপন কিছু নয়। পঁচাত্তরের রক্তাক্ত অধ্যায়ের বেনিফিশিয়ারি হিসেবে ক্ষমতায় আসা সামারিক শাসক জিয়াউর রহমানের হাত ধরে রাজনৈতিক পুনরুত্থান ঘটে সেসব দল ও রাজনৈতিক পক্ষের, যারা মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে কখনোই মেনে নিতে পারেনি।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল, দীর্ঘ ২১ বছর রাষ্ট্র যেভাবে পরিচালিত হয়েছে ও যাঁরা পরিচালনা করেছেন, তার ও তাঁদের আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির একটা নিখুঁত-নির্মোহ মূল্যায়ন করলে দেখা যাবে, তাঁরা সবাই মিলে চেষ্টা করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের দর্শন ও আদর্শ যেন বাংলাদেশে আর কখনো ফিরে না আসে। পরিণতি, বাংলাদেশ নামের খোলসে আরেকটি পাকিস্তান। তাঁরা পরিপূর্ণ সফল হননি এটা যেমন ঠিক, তেমনি এটিও ঠিক, দেশ ও রাষ্ট্রের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এমন কিছু শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পেরেছেন, যাতে ক্ষমতার বাইরে থেকেও লক্ষ্য অর্জনে তাঁরা যেন লড়াইটা স্বচ্ছন্দে অব্যাহত রাখতে পারেন। সেই চিত্রই এখন দেখা যাচ্ছে। তাঁদের সবচেয়ে বড় সাফল্য রাজনীতিকে তারা আদর্শহীনতার জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছেন। তাতে কাজ হয়েছে এই, ভালো-মন্দের বিচার ও পার্থক্য কোথায় তা বৃহত্তর জনগণ সঠিকভাবে বুঝতে পারছে না। সর্বত্র বিভ্রান্তি। মাইক্রো লেভেল, রাজনীতির মধ্য ও তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ড থেকে বৃহত্তর সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা দুষ্কর, কারা আদর্শের জন্য রাজনীতি করেন, আর কারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে শুধু লুটপাটের জন্য রাজনীতি করেন।
২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুর ঘটনায় ও ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনায় মানুষ হতভম্ব হয়ে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে, কারা প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক ও এক নম্বর দর্শন অসাম্প্রদাযিক রাজনীতির পক্ষে, আর কারাই বা বিপক্ষে। এর জন্য কাকে দুষবেন! ১৯৭৫ সালের পর থেকে ক্ষমতা ও অর্থসম্পদের লোভকে চরিতার্থ করার জন্য ধর্মের অপব্যবহার কিভাবে কাজে দিয়েছে সেটি সবাই দেখেছেন। সামরিক শাসকদ্বয় ধর্মকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত না করলে এমনটি বাংলাদেশে হতে পারত না। নির্বাচনে জিততে ধর্মীয় উন্মাদনা ও টাকার মতো ম্যাজিক ক্ষমতা আর কিছুর নেই। তাতে জাতি, দেশ, রাষ্ট্রের কত বড় ভয়ংকর অধঃপতন হতে পারে সেটি পাকিস্তান, আফগানিস্তানের দিকে তাকিয়েও আমরা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছি। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বজায় রাখার সংগ্রামে এখনো আওয়ামী লীগের বিকল্প রাজনৈতিক পক্ষ তৈরি হয়নি। কিন্তু সেখানেও ওই সব ব্যাকটেরিয়া সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে, যার উদাহরণ রামু ও নাসিরনগর। সুতরাং জনগণই শক্তি, এই বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের দর্শন—গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা পুনঃ প্রতিষ্ঠার পথে রাজনীতির এই দশায় এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনীতির মতো রাষ্ট্রযন্ত্রও সমানভাবে কলুষিত। এটাই সবচেয়ে বড় ভয়ের জায়গা। এসবের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা লড়াই করে চলেছেন ১৯৮১ সাল থেকে, আজ ৪১ বছর ধরে। এই সংগ্রামের চ্যালেঞ্জ ভার্সেস অর্জনের একটা তুলনামূলক মূল্যায়ন চার্ট তৈরি করলে দেখা যাবে এ পথের অগ্রগতি অভাবনীয়। শেখ হাসিনা আজ বিশ্বনেতৃত্বের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।
দারিদ্র্য বিমোচন, জঙ্গি-সন্ত্রাস দমন, জলবায়ু ইস্যু, বিশ্ব শান্তি মিশন ও একই সময়ে সব বৃহৎ শক্তিকে একসঙ্গে বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার করা ইত্যাদি কারণে বিশ্ব মিডিয়ার আলো এখন শেখ হাসিনার ওপর। আরো কিছুকাল শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নেতৃত্বে থাকলে এবং চলমান ধারা অব্যাহত রাখা গেলে মাত্র আর ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের দর্শনে পূর্ণ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত রাষ্ট্রে পরিণত হবে, সে কথা আজ বিশ্বব্যাংকসহ দুনিয়ার বড় সব গবেষণা সংস্থা থেকে বলা হচ্ছে। এই ১০ বছর বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাল। রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ-প্রতিদ্বন্দ্বী থাকা এক কথা, আর শত্রু থাকা অন্য কথা। শেখ হাসিনার প্রতিপক্ষ-প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে রাজনীতির লেবাসে শত্রুপক্ষই আজ অনেক বেশি শক্তিশালী। কারণ তারাই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেছে দীর্ঘকাল। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের হাল ধরার পর প্রায় দুই ডজনবার শেখ হাসিনাকে হত্যা করার চেষ্টা হয়েছে। কারা এই চেষ্টা চালিয়েছে! এ রকম শত্রু সৃষ্টি হোক তা তো নিশ্চয়ই কেউ চাইবে না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, জাতির পিতার খুনি, প্রতিবেশী দেশের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ও তাদের এদেশীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থেই ও দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ হাসিনাকে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। রাষ্ট্রের স্বার্থে তাঁকে আপসহীন ও কঠিন হতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ও ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত খুনিদের কয়েকজন এখনো পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশে অবস্থান করছে। জামায়াত, হেফাজতসহ ধর্মান্ধরা ভালো করেই জানে, শেখ হাসিনা বেঁচে থাকতে বাংলাদেশকে কেউ ধর্মীয় রাষ্ট্র বানাতে পারবে না। তাই বলতে হয়, ‘দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার/লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার। ’
সম্প্রতি ভারতের একজন সিনিয়র সুপরিচিত সাংবাদিকের একটি ভুয়া খবরে সংগত কারণেই বাংলাদেশের মানুষ শঙ্কিত হয়ে ওঠে। এটাও কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ কি না কে জানে! মানুষ চেনা বড় দায়, সবচেয়ে কঠিন কাজ। কার মনে কী আছে আলেমুল গায়েব ছাড়া কারো পক্ষে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। ‘গুজবে বিশ্বাস করতে বলি না, ষড়যন্ত্র ঠেকানো জরুরি’। এই শিরোনামটির সঙ্গে আমিও একমত। রাষ্ট্রনেতাদের জন্য নিরাপত্তা আর রাষ্ট্র ও মানুষের কাছে তাঁদের দায়বদ্ধতার সঠিক সমীকরণ মেলাতে নির্দিষ্ট দাযিত্বপ্রাপ্তরা ব্যর্থ হওয়ার কারণে ইতিহাসের অনেক বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটেছে। বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নে লেনিনের পর স্তালিনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ট্রটস্কি। ট্রটস্কির মেধা ও ব্যক্তিত্বের সামনে স্তালিন সব সময়ই হীনম্মন্যতায় ভুগতেন। তাই ক্ষমতা গ্রহণের পর স্তালিন ট্রটস্কিকে দেশ ছাড়া করেন এবং গোপন পন্থায় হত্যা করার পরিকল্পনা নেন। ট্রটস্কি সব জানতেন এবং সাবধানও থাকতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত সেক্রেটারি সিলভিয়ার প্রেমিক র্যামন মার্কেডারের হাতেই ১৯৪০ সালের ২০ আগস্ট সুদূর মেক্সিকোতে নিজের বাসভবনেই ট্রটস্কি নিহত হন। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই ও ইসরায়েলের মোসাদ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা সংস্থা হয়েও যথাক্রমে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ও প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিনকে কেন রক্ষা করতে পারল না, তার কোনো সদুত্তর আজ পর্যন্ত কেউ জানতে পারল না। ইন্দিরা গান্ধী নিহত হলেন সবচেয়ে বিশ্বস্ত দেহরক্ষীর গুলিতে, নিজ বাসভবনে। ইতিহাসের এসব ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বার্তা দেয়।
নিরাপত্তার প্রশ্নে অন্ধবিশ্বাস ও আত্মীয়-পরিজনের বিবেচনা সব সময় বড় ক্ষতির কারণ হয়েছে। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বেলায় সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে জিরো টলারেন্স সুরক্ষাবলয় সার্বক্ষণিক থাকতে হবে। সব দিকের সব কিছুর যোগ-বিয়োগের পর সামগ্রিক অবস্থান থেকে নিজেই মূল্যায়ন করলে তার শত্রুকেও এ কথা স্বীকার করতে হবে, গত ৮-৯ বছর কোনো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ পিছিয়ে যায়নি; বরং সব ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। গণতান্ত্রিকব্যবস্থায় অনেক কিছুতে দ্বিমত পোষণ ও কঠোর সমালোচনা থাকবে, থাকতে হবে। তবে অ্যাট দ্য এন্ড (শেষে) এ কথা সবাইকে বলতে হবে, বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির স্থায়ী স্থিতিশীলতার জন্য শেখ হাসিনাকে আরো কিছুকাল রাষ্ট্রের নেতৃত্বে থাকতে হবে। পঁচাত্তরের প্রেতাত্মারা এখনো সক্রিয়, সে কথাও সবার সর্বদা মনে রাখতে হবে।