হাওর বার্তা ডেস্কঃ সীমান্ত পেরিয়ে এক দিনে হাজার হাজার রোহিঙ্গার প্রবেশের অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখল বাংলাদেশ। মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকার মানুষ গত কয়েক দিন দল বেঁধে বাংলাদেশের উদ্দেশে দুর্গম পথ হেঁটেছে, নদী পাড় হয়েছে। গতকাল সোমবার বেদনার ইতিহাসও তৈরি হলো সীমান্তে। দীর্ঘ যাত্রায় ক্লান্ত, ক্ষুধায় কাতর দুটি শিশু বাংলাদেশে ঢুকেই গতকাল বিকেলে ঢলে পড়েছে মৃত্যুর কোলে।
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ইউপি সদস্য সুলতান আহমদ গতকাল সোমবার রাতে হাওর বার্তাকে এমন করুণ দৃশ্যের কথা জানিয়ে বলেন, ‘ভাই রে, অসহায় মানুষের মৃত্যু হয় চলার পথে; তখন সান্ত্বনা দেওয়ারও সুযোগ থাকে না। একে একে দুই দম্পতির দুটি শিশু আমার চোখের সামনেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে। এ দৃশ্যে বাঙালি-রোহিঙ্গা সবাই কেঁদেছে। ’ তিনি জানান, একটি শিশু ছিল দুগ্ধপোষ্য। বড়জোর দুই বছর বয়স হবে। ক্ষুধার্ত মায়ের বুকে দুধ না পেয়েই শিশুটি মারা যায় বলে তিনি জেনেছেন রোহিঙ্গাদের কাছে।
দ্বিতীয় শিশুটির বয়সও বড়জোর সাড়ে তিন থেকে চার বছর হবে।
টানা সাত দিনের দুর্গম পাহাড়ি পথে কোনো খাবার পায়নি শিশু, নারী ও বৃদ্ধরা। ইউপি সুলতান আহমদ জানান, এই শিশুটিও নাফ নদ থেকে উঠে পালংখালী এলাকার রোহিঙ্গা শিবিরমুখী সড়কে প্রাণ হারায়। হাঁটার পথে এই দুই অবোধ শিশুর মৃত্যুতে এলাকার মানুষও কেঁদেছে।
গতকাল আচমকা হাজার হাজার রোহিঙ্গার ঢলে সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারাও আঁতকে ওঠে। সীমান্তবাসীর ধারণা, শুরুতে যখন রোহিঙ্গার তীব্র স্রোত ছিল তখনো কোনো দিন একসঙ্গে এত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢোকেনি। ‘কমপক্ষে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা আজ (গতকাল) সোমবার এক দিনে ঢুকেছে। কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে একযোগে ঢুকে পড়ে এসব রোহিঙ্গা। ’ হাওর বার্তাকে বলছিলেন সুলতান আহমদ।
গতকাল আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে মংডুর কাউয়ার বিল গ্রামের বাসিন্দা। এ ছাড়া বুচিদং এবং রাশিদং এলাকার রোহিঙ্গারা গতকালের ঢলে ছিল। বিভিন্ন গ্রামের এই রোহিঙ্গারা একসঙ্গে পাড়ি জমিয়েছিল বাংলাদেশের উদ্দেশে। একটানা সাত দিন পাহাড়ি দুর্গম পথে হেঁটেছে এসব দেশত্যাগী মানুষ।
নতুন আসা রোহিঙ্গারা পালংখালী ইউনিয়নের বাঘঘোনা নামক স্থানে নির্মিত শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। এই শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা আজিমুল্লাহ (৫৭) জানান, তিনি বুচিদং শীতলক্ষ্যা এলাকার কোয়ামং গ্রামের বাসিন্দা। স্ত্রী ও ৯ সন্তান নিয়ে ছয় দিন আগে পাড়ি জমান বাংলাদেশের উদ্দেশে। মংডু এলাকায় সেনারা তাঁদের দুই দিন আটকে রেখেছিল। সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে আরো চার দিন পর গতকাল নাফ নদ পাড়ি দিয়ে তাঁরা বাংলাদেশে ঢুকতে সক্ষম হন।
রাখাইনের বুথিডং এলাকা থেকে এক লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশমুখী রয়েছে। গতকালই হাওর বার্তা’র প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়। আগের দিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে পর্যবেক্ষণরত আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, এখনো প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আসছে। বিভিন্ন হিসাব মতে, গত ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে নতুন করে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা এরই মধ্যে পাঁচ লাখ ১৭ হাজারে দাঁড়িয়েছিল। তার সঙ্গে যোগ হলো সোমবার আসা রোহিঙ্গারা।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রবার্ট ওয়াটকিনস বলেছেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা আট লাখের বেশি রোহিঙ্গার জন্য বাংলাদেশে যে বিশাল আশ্রয়শিবির নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা ‘বিপজ্জনক’ হয়ে উঠতে পারে।
রোহিঙ্গাদের আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত অতি জরুরি প্রয়োজন মেটাতে চলতি সপ্তাহেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ১২ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তার আবেদন করেছে জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা। এটি আরো বড় পরিসরে ৪৩ কোটি ৪০ লাখ ডলারের মানবিক সহায়তা আবেদনের অংশ। ত্রাণ সংস্থাগুলোর আশঙ্কা, খাদ্যাভাব থেকে দ্রুতই ব্যাপক হারে অপুষ্টি দেখা দিতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ও আইওএমের নেতৃত্বে গত শনিবার প্রায় ৩০টি সংস্থা ডায়রিয়ার মহামারি ঠেকানোর পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠক করে।
এদিকে স্বাস্থ্য খাতের সংস্থাগুলো আজ মঙ্গলবার থেকে কলেরার টিকাদান কর্মসূচি শুরু করবে। আগামী বছরজুড়ে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী বসতি এবং এর আশপাশের স্থানীয় সম্প্রদায়ের সাড়ে ছয় লাখ ব্যক্তিকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। নতুন ও পুরনো মিলে বাংলাদেশে ইতিমধ্যে মিয়ানমারের রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়।