হাওর বার্তা ডেস্কঃ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে ১৯৯২ সালের নীতিগত সিদ্ধান্ত বর্তমানে গ্রহণযোগ্য নয় এবং বাংলাদেশ তা মানবে না। ১৯৯২ সাল ও ২০১৭ সালের পরিস্থিতি এক নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ অবস্থায় লাখ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ঘোষিত ২৫ বছর আগের সমঝোতা ও নীতিমালা বর্তমান পরিস্থিতিতে কার্যকর হতে পারে না। বাংলাদেশের এই অবস্থানের কথা বিদেশি কূটনীতিকদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী। একইসঙ্গে তিনি রাখাইনে সহিংসতা বন্ধে এবং রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা কামনা করেন। গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় মিয়ানমারসহ ২৮ দেশের কূটনীতিকদের রোহিঙ্গা সংকটের সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
কূটনীতিকদের ব্রিফিং শেষে পররাষ্ট্র মন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। আমরা কাজ করছি। যুদ্ধ করবো না। যুদ্ধ করলে সব ধ্বংস হয়ে যাবে। ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বলে কিছুই থাকবে না। সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে তা প্রমাণ হয়েছে। আমরা আত্মহননের পথ বেছে নেবো না। এদিকে, বাংলাদেশসহ মিয়ানমারের প্রতিবেশী পাঁচ দেশের রাষ্ট্রদূতরা শিগগিরই রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনে যাচ্ছেন। মিয়ানমার সরকার এ সুযোগ দিচ্ছে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ২৬ অক্টোবর মিয়ানমার যাচ্ছেন, এটি আপাতত চূড়ান্ত। এরপর আমারও মিয়ানমার যাওয়ার কথা রয়েছে।
ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশি কূটনীতিকদের উদ্দেশে বলেন, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক যে রাখাইনে নির্যাতন এখনও বন্ধ হয়নি। রাখাইনে নারী, শিশু ও বয়স্কদের ওপর এখনও নির্যাতন চালানো হচ্ছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সেখানে এখনও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসা অব্যাহত রয়েছে। গত ১০ দিনে ৪০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। আর ২৫ আগস্ট থেকে আজ পর্যন্ত এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ২০ হাজারে।
গত ২ অক্টোবর মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অফিসের ইউনিয়ন মন্ত্রী টিন্ট সোয়ে’র সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের কথা উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা তাকে জানিয়েছি বাংলাদেশে ৯ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আছে এবং আমরা চাই সবাই যেন শান্তিপূর্ণ উপায়ে ফেরত যায়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনীতিকদের বলেন, মিয়ানমারের মন্ত্রী প্রস্তাব দিয়েছিলেন ২০১৬ সালের অক্টোবরের পরে যারা বাংলাদেশে এসেছে- যাচাই সাপেক্ষে তাদের প্রত্যাবাসনে তারা রাজি। যাচাইয়ের জন্য তারা ১৯৯২ সালে গৃহীত যৌথ নীতিগত সিদ্ধান্ত ও বিবৃতিকে ভিত্তি হিসেবে ধরার প্রস্তাব করে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত মানা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে তাদের বেশিরভাগেরই বাড়িঘর পুড়ে গেছে এবং প্রায় কারও কাছেই কোনও কাগজপত্র নেই। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষই বলেছে অর্ধেক রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়ে গেছে। যেহেতু রোহিঙ্গাদের কাছে কোনও কাগজ নেই, তাই আমরা চাই কোনও রোহিঙ্গা যদি তাদের বাড়ির ঠিকানা বলতে পারে, যাচাই করার জন্য সেটাই মানদণ্ড হওয়া উচিত। এছাড়া এক্ষেত্রে যৌথ যাচাইকরণ এবং সম্ভব হলে আন্তর্জাতিক সংস্থার সাহায্য নেওয়ার কথা বলেছি। এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে নতুন একটি সমঝোতার প্রয়োজন এবং তার একটি খসড়া মিয়ানমারের মন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে। খসড়া সমঝোতায় আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা নেওয়া এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশ পূর্ণ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য আমরা দুইপক্ষ একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের বিষয়ে একমত হয়েছি। এখন মিয়ানমারের জবাবের অপেক্ষায় রয়েছি। তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে কূটনীতিকদের প্রতি আহবান জানান।
ব্রিফিংয়ে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন ও রাশিয়া এবং অস্থায়ী সদস্য মিশর, ইতালি, সুইডেন ও জাপানের রাষ্ট্রদূত ও মিশন প্রধান, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ভারত, নরওয়ে, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, স্পেন, ভ্যাটিক্যান, মিয়ানমার, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও ব্রুনেই এর রাষ্ট্রদূত ও মিশন প্রধানরা যোগ দেন। এ সময় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক-সহ উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।