টানা বৃষ্টিতে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির আবারও অবনতি ঘটেছে। নিচু এলাকাগুলো তলিয়ে যাচ্ছে। সড়কে পানি উঠে বান্দরবানের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এ ছাড়া পাহাড়ধসে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। খাগড়াছড়ির নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। বৃহত্তর সিলেটের অবস্থাও প্রায় একই। আমাদের অফিস, নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা জানান-
বান্দরবান : গত ২৪ ঘণ্টার ভারি বর্ষণে সড়কের ওপর পানি উঠে যাওয়ায় বান্দরবানের সঙ্গে সারা দেশের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ আবারও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গতকাল সকালের দিকে বান্দরবান-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের কেরানীরহাট অংশের বাজালিয়া পয়েন্টে এক ফুট পানি ওঠে। সে সময় কোনোভাবে যানবাহন চলাচল করলেও বিকেলের দিকে পানি বেড়ে যাওয়ায় এই সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে সড়কের ওপর তিন ফুট পানি রয়েছে।
পার্বত্যাঞ্চল-সিলেটে বন্যার অবনতি
গত এক মাসের মধ্যে এ সড়ক চতুর্থবারের মতো বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া স্বর্ণ মন্দিরের কাছে বেইলি ব্রিজ পানিতে ডুবে থাকায় বান্দরবান-রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কও বন্ধ থাকায় বান্দরবান জেলা সদর কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। টানা ভারি বর্ষণে বান্দরবান জেলা সদরের আর্মিপাড়া, মেম্বারপাড়া, ইসলামপুর ও শেরে বাংলানগরসহ বেশ কয়েকটি আবাসিক এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
এ ছাড়া সকালে শহরের দুটি এলাকায় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। এতে সাজিব হোসেন নামে দুই বছরের এক শিশুর মৃত্যু ঘটেছে। আহত হয়েছে আরো তিনজন। উজানে প্রবল বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শঙ্খ ও মাতামুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় গতকাল জেলা প্রশাসকের সভাকক্ষে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া ভারি বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। বান্দরবান মৃত্তিকা ও পানি সংরক্ষণ কেন্দ্র বুধবার সকাল ৯টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে বান্দরবান পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আর্মিপাড়া, মেম্বারপাড়া, ইসলামপুর ও শেরে বাংলানগরের বেশির ভাগ এলাকা চার থেকে পাঁচ ফুট পানির নিচে রয়েছে। এসব এলাকার তিন শতাধিক পরিবার এরই মধ্যে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে।
সিলেট : দুই দিন ধরে সিলেটে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে নগরের নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে উপশহর, তেররতন, আম্বরখানা, নয়াসড়ক, মীরাবাজার, কুয়ারপাড়, বাদামবাগিচাসহ বিভিন্ন এলাকার সড়কে পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালত খোলা থাকলেও ক্রেতা-গ্রাহকদের উপস্থিতি কম ছিল। স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও কমে গেছে দুই দিন ধরে। গতকাল ভোর ৬টা পর্যন্ত বিগত ২৪ ঘণ্টা অর্থাৎ বুধবার ভোর ৬টা থেকে বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা পর্যন্ত সিলেটে ১৪৪ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে স্থানীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইপ্রোলজি বিভাগ জানিয়েছে, সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে টানা বর্ষণের সঙ্গে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটের গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। উপজেলাগুলোর নিচু এলাকা পানিতে ডুবে গেছে। এতে বিপুল পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হয়েছে। লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার তিনটি পাথর কোয়ারি বন্ধ রয়েছে।
তিন উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে গোয়াইনঘাট। উপজেলার বেশির ভাগ এলাকার মানুষ পানিবন্দি। উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান দুটি সড়ক সারী-গোয়াইন ও সালুটিকর-গোয়াইনঘাটের বিভিন্ন অংশ তলিয়ে যাওয়ায় উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
সারী-গোয়াইনঘাট সড়কের লাফনাউট, কমপুর, বেকরা, বার্কীপুরসহ বিভিন্ন অংশ পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার বৃহৎ পাথর কোয়ারি জাফলং বন্ধ রয়েছে।
হবিগঞ্জ : জেলার খোয়াই নদীর পানি বুধবার বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও গতকাল পানি কমতে শুরু করেছে। তবে খুব ধীরে। উজানে এখনো পানি থাকায় নদীর স্রোত অব্যাহত রয়েছে। খোয়াই নদীর পানি নিষ্কাশন, কুশিয়ারা ও সুরমা নদীতে বন্যা থাকায় হাওরে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ সাহিদুল আলম জানান, বিভিন্ন স্থানে ন্যাবতা হারানো ও বাঁধের মধ্যে লোকজন বসতি স্থাপন করায় খোয়াই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ এখন হুমকির সম্মুখীন।
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি : টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে সুরমা নদীসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চল। সুনামগঞ্জ পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৮৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জ পয়েন্টে ১৯৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এদিকে তাহিরপুরে যাদুকাটা পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়ক, বিশ্বম্ভরপুর-সুনামগঞ্জ সড়ক, দোয়ারাবাজার সড়কসহ বিভিন্ন এলাকার অভ্যন্তরীণ সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে।
খাগড়াছড়ি : প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে খাগড়াছড়িতে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। চেঙ্গী ও মাইনী নদীতে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে খাগড়াছড়ি জেলা সদর ও দীঘিনালার মেরুংসহ বিভিন্ন এলাকার নিচু জায়গা পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি বাড়ছে দ্রুত। চেঙ্গী নদীর দুই কূল উপচে পড়ায় জেলা সদরের গঞ্জপাড়া, মুসলিমপাড়া, শান্তিনগর, গোলাবাড়ি, খবংপুড়িয়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকার তিন শতাধিক বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। আরো অনেক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেবল বাড়িঘরই তলিয়ে যায়নি; শহরের প্রধান পরিবহন টার্মিনালে পানি উঠেছে। খাগড়াছড়ির প্রধান সড়কের বিভিন্ন স্থানেও হাঁটু সমান পানি উঠেছে। গত ১০ বছরের মধ্যে এত পানি দেখা যায়নি। এদিকে মাইনী নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় মেরুং বাজারে পানি উঠেছে। আশপাশের এলাকার বহু ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। দীঘিনালা-মেরুং সড়কে পানি ওঠায় আন্তসড়কটিতে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।