ঢাকা ০৯:৫৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
জাবিতে পাখি সুরক্ষায় ছাত্রদলের ভিন্নধর্মী উদ্যোগ যে পাখি উড়ন্ত অবস্থায় ডিম পাড়ে, মাটিতে পড়ার আগে বাচ্চা ফুটে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পররাষ্ট্র-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হচ্ছেন যারা প্রাথমিকে শিক্ষার্থীদের খাবার কর্মসূচি চালু করা হবে : উপদেষ্টা উপদেষ্টা ফারুকী-বশিরকে নিয়ে বিতর্ক, যা বললেন মাহফুজ আলম নেতাকর্মীদের রেখে স্বার্থপরের মত পালিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা: রিজভী সেনাবাহিনী কতদিন মাঠে থাকবে, তা অন্তর্বর্তী সরকারই নির্ধারণ করবে: সেনাসদর জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে এলডিসি’র বৈঠকে যা বললেন ড. ইউনূস ঊনপঞ্চাশে আমিশার জীবনে প্রেম আ.লীগ কি আগামী নির্বাচনে আসবে? বিএনপি নেতা ফজলুর রহমান যা বললেন

মানুষের ভালবাসাই সবচেয়ে বড় পাওয়া

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৩৯:০৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২১ অগাস্ট ২০১৫
  • ২২৭ বার

সন্তান জন্ম দেয়ার আগেই ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে একটি মেয়ে। তাকে ‘ক্লিনিক্যালি ডেথ’- বলে দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু নড়াইলের সাধারণ এ মেয়েটিকে দেখতে হাসপাতালে প্রতিদিনই ৩-৪শ’ মানুষের ভিড়। যেখানে এক-দুই ব্যাগ রক্ত পাওয়া মুশকিল, সেখানে ৪০-৫০ জন মানুষ হাজির। সুমি নামের যে মেয়েটির জন্য মানুষের এত ভালবাসা তাকে হয়তো অনেকে চেনেই না। শুধু এতটুকু জানে তার স্বামী হলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। নড়াইল এক্সপ্রেস, জাতীয় দলের অধিনায়ক, সেরা পেসার, দেশের ওয়ানডে ক্রিকেটে ২শ’ উইকেট নেয়া বোলার! এই সব ক্রিকেটীয় অর্জন ছাড়িয়ে মাশরাফির বড় পরিচয় এখন, সবার প্রিয় মানুষ। যে মানুষটির প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার টানে ছুটে আসতে পারে হাজার হাজার মানুষ। কি মাঠে, কি ব্যক্তিগত জীবনে, তার ক্রিকেটার পরিচয়কে ছাপিয়ে গেছে সরল ও উদার মানসিকতা। কিন্তু সবার প্রিয় এ মানুষটির জীবনেও আছে অনেক প্রিয়-অপ্রিয় ঘটনা। প্রাপ্তির আনন্দের সঙ্গে আছে কষ্ট, দুঃখও। তার জীবনের সেই জানা-অজানা ঘটনাগুলো তুলে ধরছেন মানবজমিন-এর স্পোর্টস রিপোর্টার ইশতিয়াক পারভেজ

প্রশ্ন: দীর্ঘ ক্রিকেট জীবনে এখন পর্যন্ত সুখকর ঘটনা কি?
মাশরাফি: ১৫ বছরের অনেক সুখকর স্মৃতিই আছে। একটি-দু’টি বলা কঠিন। কয়েকটার কথাই বলি। প্রথম প্রিয় ঘটনা হলো বাংলাদেশ দলে সুযোগ পাওয়া। এরপর যখন প্রথম টেস্ট জিতলাম। এরপর ২০০৭ সালে ভারতের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের জয়ের ম্যাচ, এবার বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা, বিশেষ করে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দেয়া ম্যাচটা। আর সর্বশেষ আমরা যখন ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়ে ৭ নম্বরে চলে এলাম সেটি। এমন অনেক ঘটনাই আছে। তবে এগুলোই বিশেষ মনে হয় আমার কাছে।
প্রশ্ন: অন্য প্রতিপক্ষের তুলনায় ভারতকে নিয়ে কি আলাদা ভাবনা থাকে?
মাশরাফি: আমি আসলে ভারতকে নিয়ে কখনোই আলাদাভাবে চিন্তা করি না। সব প্রতিপক্ষই আমার কাছে সমান। কারণ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কাউকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। তবে হ্যাঁ, বড় বড় দলের বিপক্ষে জয়টা একটু আলাদা আনন্দ দেয়।
প্রশ্ন: ক্রিকেটে আপনার অপ্রিয় ও কষ্টের ঘটনাগুলো কি?
মাশরাফি: অনেক অপ্রিয় ঘটনা আছে। কিন্তু বিশেষ করে যদি বলতে হয় তাহলে ২০১১ সালে যখন বাদ পড়লাম আর দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ খেলতে পারলাম না সেটি। এখনও সেটি আমার জন্য অনেক কষ্টের। ইনজুরি তো আমাকে কম ভোগায়নি। আমার জীবনের অনেক ছন্দপতন এই ইনজুরির কারণেই। সবচেয়ে কষ্টের ছিল মাঞ্জারুল রানার মারা যাওয়ার ঘটনা। তবে সবকিছুর পরও মানুষের দোয়া ছিল, ভালবাসা ছিল সেই কারণে এই সব থেকে বের হতে পেরেছি।
প্রশ্ন: কোন মাঠে খেলার অনুভূতি অন্যরকম?
মাশরাফি: আমার প্রিয় মাঠের তালিকায় প্রথম থাকবে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। সেই মাঠে খেলার অনুভূতি ছিল অন্যরকম। এরপর মিরপুর শেরে বাংলা মাঠ। আর দেশের বাইরে অ্যাডিলেড, লর্ডস, মোহালি ক্রিকেট গ্রাউন্ড।
প্রশ্ন: এমন কোন মাঠ আছে, যেখানে খেলতে নামলেই বিরক্ত লাগে?
মাশরাফি: বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠগুলোতে খেলতে একটু খারাপ লাগে। এরমধ্যে ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়াম। কি কারণ জানি না। তবে সেই মাঠে নামলেই যেন কেমন একটা বাজে অনুভূতি হয়।
প্রশ্ন: পেসারদের পারফরম্যান্স কতটা অনুপ্রেরণা দিচ্ছে?
মাশরাফি: রুবেল বেশ কয়েকবছর ধরে বেশ খেলছে। ওর সক্ষমতা আছে আরও ভাল করার। এরপর এখন মুস্তাফিজ অনেক প্রতিভাবান, ওর অনেক উজ্জ্বল অভিবষ্যৎ আছে। এখন আল্লাহ্‌ যদি ওকে সুস্থ রাখে, বাঁচিয়ে রাখে তাহলে ও অনেকদূর যাবে। তাসকিনেরও খুব ভাল সম্ভাবনা। দলের বাইরে থাকাদের মধ্যে শফিউল, আল আমিন, রবিউল ইসলামরাও ভাল পেসার। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অনেক পেসার আছে যারা বেশ ভাল করছে। অবশ্যই পেসাররা ভাল করলে আমার বেশ ভাল লাগে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে পেসারদের প্রতিবন্ধকতা কি?
মাশরাফি: অবশ্যই এই দেশের কন্ডিশন একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। এখানে ইচ্ছা করলেই আপনি পেস সহায়ক উইকেট বানাতে পারবেন না। কারণ এখানে উইকেটে ঘাস রাখলেও আবহাওয়া উইকেটকে শুকিয়ে ফেলে। তবে এখন বেশকিছু স্পোর্টিং উইকেট বানানো হচ্ছে। সেটিতে পেসাররা সুবিধা পাচ্ছে। আর এ কন্ডিশনটা সব সময়ই পেসারদের জন্য বেশ কঠিন।
প্রশ্ন: ব্যক্তিগত জীবনে সবচেয়ে বড় অপ্রিয় ঘটনা কি?
মাশরাফি: অবশ্যই বলবো ইনজুরি। এটি আমার জীবনের অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে।
প্রশ্ন: কোন খাবার নাম শুনলেই খেতে ইচ্ছা হয়, আর কোন ধরনের খাবার অপছন্দের?
মাশরাফি: আমি আসলে বাংলা খাবার খেতেই পছন্দ করি। যেমন ভাত, মাছ, ভর্তা, ভাজি এই সব। আর খেতে পারি না পাস্তা, গরুর ভুঁড়ি ও শুঁটকি।
প্রশ্ন: মায়ের নাকি বউ এর রান্না বেশি প্রিয়?
মাশরাফি: অবশ্যই মায়ের। তবে আমি বড় হয়েছি নানা বাড়িতে। যে কারণে আমার মামীর হাতের রান্নাটাই বেশি ভাল লাগে। আর বউতো সব সময় রান্না করে। খারাপ বলবো না, ভালই। আসলে খাবার নিয়ে আমার তেমন কোন আগ্রহ নেই। আমার ক্ষুধা লাগলে আমি সব খাই। সবাই বলে আমি নাকি খাবারের স্বাদ বুঝি না। আমার কাছে খারাপ রান্না সেটি যেখানে লবণ বেশি হয়।
প্রশ্ন: প্রতিদিনই অনুশীলন করছেন, কিন্তু লম্বা একটা সময় খেলা নেই। এটি পারফরম্যান্সে কতটা প্রভাব পড়ে?
মাশরাফি: আসলে প্রফেশনাল ক্রিকেটারদের এটি নিয়ে ভাবার কিছুই নেই। এফটিপি’র কারণে এমনটা হতেই পারে। তবে এটি সত্যি যে লম্বা সময় খেলা না থাকাটা আমাদের জন্য একটু হতাশার। ছয় মাসের এই গ্যাপটা আমাদের জন্য ছন্দপতন তাই খেলায় ফিরতে একটু কষ্ট করতে হবেই।
ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে ভাবনা?
মাশরাফি: দেখুন বোর্ড কিন্তু চেষ্টা করছে আমাদের সবগুলো লীগই করার। আমাদের বেশ কয়েকবছর ধরে এত আন্তর্জাতিক খেলা সেখানে সময়টা ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। মাঠেরও একটি বিষয় আছে। বোর্ড আসলে বেশ ভাল উদ্যোগ নিচ্ছে। এর মধ্যে চারদিনের ম্যাচ নিয়ে তারা গুরুত্ব দিয়েছে। এটি আমাদের টেস্টের জন্য খুব ভাল।
প্রশ্ন: অধিনায়ক হিসেবে মুশফিকুর রহীমকে কিভাবে দেখেন?
মাশরাফি: আমি বলবো সে বাংলাদেশের সেরা অধিনায়ক। তার নেতৃত্বে দল অনেক টেস্ট ও ওয়ানডেতে জয় পেয়েছে। সে অনেক ভাল করছে। একজন ক্রিকেটার হিসেবেই নয়, মানুষ হিসেবেও আমি তাকে নিজের আইডল হিসেবেই দেখি। আমার দৃষ্টিতে সে অসাধারণ।
প্রশ্ন: আপনার অধিনায়কত্বে কি সেই মন্ত্র যে সবাইকে উজ্জীবিত করে?
মাশরাফি: আমি নিজেই বলতে পারবো না যা আমি আসলে কি করি। আমি শুধু বলি বা চিন্তা করি, যে লাল-সবুজের জার্সি আমাদের গায়ে সেটি যেন ছোট না হয়।
প্রশ্ন: দলের কোন বিষয়গুলো কষ্ট দেয় আর কোনগুলো আনন্দ দেয়?
মাশরাফি: আমরা যখন বাংলাদেশের জার্সি পরে নামি তখন আমাদের দিকে সবাই তাকিয়ে থাকে। আমার দেখতে ভাল লাগে, আমাকে আনন্দ দেয় যখন দলের প্রতিটি ক্রিকেটার ম্যাচে শেষ বল পর্যন্ত লড়াই করে। জয়-পরাজয় ভিন্ন কথা। তবে যখন লড়াইয়ের মানসিকতা দেখা যায় না তখনই আমার ভীষণ কষ্ট লাগে।
প্রশ্ন: ক্রিকেটে আপনার প্রিয় ব্যক্তি কে?
মাশরাফি: যদি দেশের ক্রিকেটের কথা বলেন, তাহলে আলাদা করে কারও নাম বলবো না। কারণ আকরাম ভাই, সুমন ভাই থেকে আমি যাদের সঙ্গেই খেলেছি সবার কাছে আমি কিছু না কিছু শিখেছি। সবাই আমার কাছে সেরা। আর যদি বাইরের কথা বলি তাহলে কোর্টনি ওয়ালস আমার প্রিয় ছিল। আর শোয়েব আক্তারকে আমার পছন্দ ছিল তার আগ্রাসনের কারণে।
প্রশ্ন: ক্রিকেট ক্যারিয়ারে কোন হার সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে আর কোনটিতে অনেক আনন্দ পেয়েছেন?
মাশরাফি: ২০১২ সালে এশিয়া কাপের ফাইনালে হারটি আমার জন্য অনেক কষ্টের ছিল। এখনও সেই কষ্টের কখা ভুলতে পারি না। আর সেরা জয় যেটি এখনও আমাকে শিহরিত করে সেটি এই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়টি।
প্রশ্ন: আসন্ন বিপিএল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্য কতটা ভূমিকা রাখবে?
মাশরাফি: আগের দুইবার টাকা নিয়ে যে সমস্যা ছিল, আশা করি এবার সেটি হবে না। আমি মনে করি না বিপিএল হওয়াটা আমাদের জন্য খুব দরকার। এই ফরমেটে খেলার অভিজ্ঞতা আমাদের খুব কম। আর টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিয়ে এখনও ভাবিনি। দেখি হাতে এখনও বেশ সময় আছে। এখনই কিছু বলতে চাই না।
প্রশ্ন: ক্রিকেটার না হলে কি হতেন?
মাশরাফি: আমি জীবন নিয়ে খুব একটা ভাবি না। কারণ কালও মরে যেতে পারি, মৃত্যুর উপর কারও হাত নেই। যে কারণে কি হতাম তা নিয়ে ভাবিনি। এমনকি ক্রিকেট ছেড়ে কি করবো তাও ভাবি না। আমি আসলে এমনই।
প্রশ্ন: এই মুহূর্তে জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কি?
মাশরাফি: একটা মানুষের জীবনে আমি মনে করি প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো সুস্থভাবে বেঁচে থাকা। আল্লাহ্‌ যতদিন হায়াত রেখেছেন প্রথমে সেটি করতে চাই। এরপর আমার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে আছে- তাদের মানুষের মতো মানুষ করাটাও আমার জন্য বেশ বড় চ্যালেঞ্জ। ছেলে ক্রিকেটার হবে নাকি মেয়ে বড় কোন চাকরি করবে তা নিয়ে ভাবি না। আমার প্রথম ভাবনা তারা যেন ভাল মানুষ হয়।
প্রশ্ন: আপনার জীবনের সেরা পাওয়া কোনটি?
মাশরাফি: মানুষের ভালবাসা, এমনকি আমি মনে করি আজ বাংলাদেশ ক্রিকেট যেখানে এসেছে এর অর্ধেকটার জন্য এই মানুষের ভালবাসা ও সমর্থন ছিল। আমি এই দর্শকদের ধন্যবাদ জানাই। আর নিজের কথা বললে- আমাদের আসলে অনেক বড় পরিবার। আমার ফ্রিজের খাবার যখন যার মন চাইছে নিয়ে খাচ্ছে। সারাদিনই কেউ না কেউ আমাদের বাসায় আসছে। আমার বউ প্রথমদিকে অবাক হতো। কারণ এত মানুষ সে কোনদিন দেখেনি। এখন সেও এটি ইনজয় করে। যখন ওর বাচ্চা হবে তখন ও ক্লিনিক্যালি ডেথই বলা চলে। তখন ৩/৪শ’ মানুষ হাসপাতালে ভিড় করতো। ওকে কেউ চিনতো না অথচ রক্তের জন্য ৪০/৫০ জন প্রস্তুত। তখন বুঝেছে আসলে মানুষের ভালবাসা কি? আসলে ভালবাসা দিয়েই এমন ভালবাসা পাওয়া যায়।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

জাবিতে পাখি সুরক্ষায় ছাত্রদলের ভিন্নধর্মী উদ্যোগ

মানুষের ভালবাসাই সবচেয়ে বড় পাওয়া

আপডেট টাইম : ১২:৩৯:০৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২১ অগাস্ট ২০১৫

সন্তান জন্ম দেয়ার আগেই ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে একটি মেয়ে। তাকে ‘ক্লিনিক্যালি ডেথ’- বলে দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু নড়াইলের সাধারণ এ মেয়েটিকে দেখতে হাসপাতালে প্রতিদিনই ৩-৪শ’ মানুষের ভিড়। যেখানে এক-দুই ব্যাগ রক্ত পাওয়া মুশকিল, সেখানে ৪০-৫০ জন মানুষ হাজির। সুমি নামের যে মেয়েটির জন্য মানুষের এত ভালবাসা তাকে হয়তো অনেকে চেনেই না। শুধু এতটুকু জানে তার স্বামী হলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। নড়াইল এক্সপ্রেস, জাতীয় দলের অধিনায়ক, সেরা পেসার, দেশের ওয়ানডে ক্রিকেটে ২শ’ উইকেট নেয়া বোলার! এই সব ক্রিকেটীয় অর্জন ছাড়িয়ে মাশরাফির বড় পরিচয় এখন, সবার প্রিয় মানুষ। যে মানুষটির প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার টানে ছুটে আসতে পারে হাজার হাজার মানুষ। কি মাঠে, কি ব্যক্তিগত জীবনে, তার ক্রিকেটার পরিচয়কে ছাপিয়ে গেছে সরল ও উদার মানসিকতা। কিন্তু সবার প্রিয় এ মানুষটির জীবনেও আছে অনেক প্রিয়-অপ্রিয় ঘটনা। প্রাপ্তির আনন্দের সঙ্গে আছে কষ্ট, দুঃখও। তার জীবনের সেই জানা-অজানা ঘটনাগুলো তুলে ধরছেন মানবজমিন-এর স্পোর্টস রিপোর্টার ইশতিয়াক পারভেজ

প্রশ্ন: দীর্ঘ ক্রিকেট জীবনে এখন পর্যন্ত সুখকর ঘটনা কি?
মাশরাফি: ১৫ বছরের অনেক সুখকর স্মৃতিই আছে। একটি-দু’টি বলা কঠিন। কয়েকটার কথাই বলি। প্রথম প্রিয় ঘটনা হলো বাংলাদেশ দলে সুযোগ পাওয়া। এরপর যখন প্রথম টেস্ট জিতলাম। এরপর ২০০৭ সালে ভারতের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের জয়ের ম্যাচ, এবার বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা, বিশেষ করে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দেয়া ম্যাচটা। আর সর্বশেষ আমরা যখন ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়ে ৭ নম্বরে চলে এলাম সেটি। এমন অনেক ঘটনাই আছে। তবে এগুলোই বিশেষ মনে হয় আমার কাছে।
প্রশ্ন: অন্য প্রতিপক্ষের তুলনায় ভারতকে নিয়ে কি আলাদা ভাবনা থাকে?
মাশরাফি: আমি আসলে ভারতকে নিয়ে কখনোই আলাদাভাবে চিন্তা করি না। সব প্রতিপক্ষই আমার কাছে সমান। কারণ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কাউকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। তবে হ্যাঁ, বড় বড় দলের বিপক্ষে জয়টা একটু আলাদা আনন্দ দেয়।
প্রশ্ন: ক্রিকেটে আপনার অপ্রিয় ও কষ্টের ঘটনাগুলো কি?
মাশরাফি: অনেক অপ্রিয় ঘটনা আছে। কিন্তু বিশেষ করে যদি বলতে হয় তাহলে ২০১১ সালে যখন বাদ পড়লাম আর দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ খেলতে পারলাম না সেটি। এখনও সেটি আমার জন্য অনেক কষ্টের। ইনজুরি তো আমাকে কম ভোগায়নি। আমার জীবনের অনেক ছন্দপতন এই ইনজুরির কারণেই। সবচেয়ে কষ্টের ছিল মাঞ্জারুল রানার মারা যাওয়ার ঘটনা। তবে সবকিছুর পরও মানুষের দোয়া ছিল, ভালবাসা ছিল সেই কারণে এই সব থেকে বের হতে পেরেছি।
প্রশ্ন: কোন মাঠে খেলার অনুভূতি অন্যরকম?
মাশরাফি: আমার প্রিয় মাঠের তালিকায় প্রথম থাকবে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। সেই মাঠে খেলার অনুভূতি ছিল অন্যরকম। এরপর মিরপুর শেরে বাংলা মাঠ। আর দেশের বাইরে অ্যাডিলেড, লর্ডস, মোহালি ক্রিকেট গ্রাউন্ড।
প্রশ্ন: এমন কোন মাঠ আছে, যেখানে খেলতে নামলেই বিরক্ত লাগে?
মাশরাফি: বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠগুলোতে খেলতে একটু খারাপ লাগে। এরমধ্যে ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়াম। কি কারণ জানি না। তবে সেই মাঠে নামলেই যেন কেমন একটা বাজে অনুভূতি হয়।
প্রশ্ন: পেসারদের পারফরম্যান্স কতটা অনুপ্রেরণা দিচ্ছে?
মাশরাফি: রুবেল বেশ কয়েকবছর ধরে বেশ খেলছে। ওর সক্ষমতা আছে আরও ভাল করার। এরপর এখন মুস্তাফিজ অনেক প্রতিভাবান, ওর অনেক উজ্জ্বল অভিবষ্যৎ আছে। এখন আল্লাহ্‌ যদি ওকে সুস্থ রাখে, বাঁচিয়ে রাখে তাহলে ও অনেকদূর যাবে। তাসকিনেরও খুব ভাল সম্ভাবনা। দলের বাইরে থাকাদের মধ্যে শফিউল, আল আমিন, রবিউল ইসলামরাও ভাল পেসার। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অনেক পেসার আছে যারা বেশ ভাল করছে। অবশ্যই পেসাররা ভাল করলে আমার বেশ ভাল লাগে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে পেসারদের প্রতিবন্ধকতা কি?
মাশরাফি: অবশ্যই এই দেশের কন্ডিশন একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। এখানে ইচ্ছা করলেই আপনি পেস সহায়ক উইকেট বানাতে পারবেন না। কারণ এখানে উইকেটে ঘাস রাখলেও আবহাওয়া উইকেটকে শুকিয়ে ফেলে। তবে এখন বেশকিছু স্পোর্টিং উইকেট বানানো হচ্ছে। সেটিতে পেসাররা সুবিধা পাচ্ছে। আর এ কন্ডিশনটা সব সময়ই পেসারদের জন্য বেশ কঠিন।
প্রশ্ন: ব্যক্তিগত জীবনে সবচেয়ে বড় অপ্রিয় ঘটনা কি?
মাশরাফি: অবশ্যই বলবো ইনজুরি। এটি আমার জীবনের অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে।
প্রশ্ন: কোন খাবার নাম শুনলেই খেতে ইচ্ছা হয়, আর কোন ধরনের খাবার অপছন্দের?
মাশরাফি: আমি আসলে বাংলা খাবার খেতেই পছন্দ করি। যেমন ভাত, মাছ, ভর্তা, ভাজি এই সব। আর খেতে পারি না পাস্তা, গরুর ভুঁড়ি ও শুঁটকি।
প্রশ্ন: মায়ের নাকি বউ এর রান্না বেশি প্রিয়?
মাশরাফি: অবশ্যই মায়ের। তবে আমি বড় হয়েছি নানা বাড়িতে। যে কারণে আমার মামীর হাতের রান্নাটাই বেশি ভাল লাগে। আর বউতো সব সময় রান্না করে। খারাপ বলবো না, ভালই। আসলে খাবার নিয়ে আমার তেমন কোন আগ্রহ নেই। আমার ক্ষুধা লাগলে আমি সব খাই। সবাই বলে আমি নাকি খাবারের স্বাদ বুঝি না। আমার কাছে খারাপ রান্না সেটি যেখানে লবণ বেশি হয়।
প্রশ্ন: প্রতিদিনই অনুশীলন করছেন, কিন্তু লম্বা একটা সময় খেলা নেই। এটি পারফরম্যান্সে কতটা প্রভাব পড়ে?
মাশরাফি: আসলে প্রফেশনাল ক্রিকেটারদের এটি নিয়ে ভাবার কিছুই নেই। এফটিপি’র কারণে এমনটা হতেই পারে। তবে এটি সত্যি যে লম্বা সময় খেলা না থাকাটা আমাদের জন্য একটু হতাশার। ছয় মাসের এই গ্যাপটা আমাদের জন্য ছন্দপতন তাই খেলায় ফিরতে একটু কষ্ট করতে হবেই।
ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে ভাবনা?
মাশরাফি: দেখুন বোর্ড কিন্তু চেষ্টা করছে আমাদের সবগুলো লীগই করার। আমাদের বেশ কয়েকবছর ধরে এত আন্তর্জাতিক খেলা সেখানে সময়টা ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। মাঠেরও একটি বিষয় আছে। বোর্ড আসলে বেশ ভাল উদ্যোগ নিচ্ছে। এর মধ্যে চারদিনের ম্যাচ নিয়ে তারা গুরুত্ব দিয়েছে। এটি আমাদের টেস্টের জন্য খুব ভাল।
প্রশ্ন: অধিনায়ক হিসেবে মুশফিকুর রহীমকে কিভাবে দেখেন?
মাশরাফি: আমি বলবো সে বাংলাদেশের সেরা অধিনায়ক। তার নেতৃত্বে দল অনেক টেস্ট ও ওয়ানডেতে জয় পেয়েছে। সে অনেক ভাল করছে। একজন ক্রিকেটার হিসেবেই নয়, মানুষ হিসেবেও আমি তাকে নিজের আইডল হিসেবেই দেখি। আমার দৃষ্টিতে সে অসাধারণ।
প্রশ্ন: আপনার অধিনায়কত্বে কি সেই মন্ত্র যে সবাইকে উজ্জীবিত করে?
মাশরাফি: আমি নিজেই বলতে পারবো না যা আমি আসলে কি করি। আমি শুধু বলি বা চিন্তা করি, যে লাল-সবুজের জার্সি আমাদের গায়ে সেটি যেন ছোট না হয়।
প্রশ্ন: দলের কোন বিষয়গুলো কষ্ট দেয় আর কোনগুলো আনন্দ দেয়?
মাশরাফি: আমরা যখন বাংলাদেশের জার্সি পরে নামি তখন আমাদের দিকে সবাই তাকিয়ে থাকে। আমার দেখতে ভাল লাগে, আমাকে আনন্দ দেয় যখন দলের প্রতিটি ক্রিকেটার ম্যাচে শেষ বল পর্যন্ত লড়াই করে। জয়-পরাজয় ভিন্ন কথা। তবে যখন লড়াইয়ের মানসিকতা দেখা যায় না তখনই আমার ভীষণ কষ্ট লাগে।
প্রশ্ন: ক্রিকেটে আপনার প্রিয় ব্যক্তি কে?
মাশরাফি: যদি দেশের ক্রিকেটের কথা বলেন, তাহলে আলাদা করে কারও নাম বলবো না। কারণ আকরাম ভাই, সুমন ভাই থেকে আমি যাদের সঙ্গেই খেলেছি সবার কাছে আমি কিছু না কিছু শিখেছি। সবাই আমার কাছে সেরা। আর যদি বাইরের কথা বলি তাহলে কোর্টনি ওয়ালস আমার প্রিয় ছিল। আর শোয়েব আক্তারকে আমার পছন্দ ছিল তার আগ্রাসনের কারণে।
প্রশ্ন: ক্রিকেট ক্যারিয়ারে কোন হার সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে আর কোনটিতে অনেক আনন্দ পেয়েছেন?
মাশরাফি: ২০১২ সালে এশিয়া কাপের ফাইনালে হারটি আমার জন্য অনেক কষ্টের ছিল। এখনও সেই কষ্টের কখা ভুলতে পারি না। আর সেরা জয় যেটি এখনও আমাকে শিহরিত করে সেটি এই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়টি।
প্রশ্ন: আসন্ন বিপিএল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্য কতটা ভূমিকা রাখবে?
মাশরাফি: আগের দুইবার টাকা নিয়ে যে সমস্যা ছিল, আশা করি এবার সেটি হবে না। আমি মনে করি না বিপিএল হওয়াটা আমাদের জন্য খুব দরকার। এই ফরমেটে খেলার অভিজ্ঞতা আমাদের খুব কম। আর টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিয়ে এখনও ভাবিনি। দেখি হাতে এখনও বেশ সময় আছে। এখনই কিছু বলতে চাই না।
প্রশ্ন: ক্রিকেটার না হলে কি হতেন?
মাশরাফি: আমি জীবন নিয়ে খুব একটা ভাবি না। কারণ কালও মরে যেতে পারি, মৃত্যুর উপর কারও হাত নেই। যে কারণে কি হতাম তা নিয়ে ভাবিনি। এমনকি ক্রিকেট ছেড়ে কি করবো তাও ভাবি না। আমি আসলে এমনই।
প্রশ্ন: এই মুহূর্তে জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কি?
মাশরাফি: একটা মানুষের জীবনে আমি মনে করি প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো সুস্থভাবে বেঁচে থাকা। আল্লাহ্‌ যতদিন হায়াত রেখেছেন প্রথমে সেটি করতে চাই। এরপর আমার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে আছে- তাদের মানুষের মতো মানুষ করাটাও আমার জন্য বেশ বড় চ্যালেঞ্জ। ছেলে ক্রিকেটার হবে নাকি মেয়ে বড় কোন চাকরি করবে তা নিয়ে ভাবি না। আমার প্রথম ভাবনা তারা যেন ভাল মানুষ হয়।
প্রশ্ন: আপনার জীবনের সেরা পাওয়া কোনটি?
মাশরাফি: মানুষের ভালবাসা, এমনকি আমি মনে করি আজ বাংলাদেশ ক্রিকেট যেখানে এসেছে এর অর্ধেকটার জন্য এই মানুষের ভালবাসা ও সমর্থন ছিল। আমি এই দর্শকদের ধন্যবাদ জানাই। আর নিজের কথা বললে- আমাদের আসলে অনেক বড় পরিবার। আমার ফ্রিজের খাবার যখন যার মন চাইছে নিয়ে খাচ্ছে। সারাদিনই কেউ না কেউ আমাদের বাসায় আসছে। আমার বউ প্রথমদিকে অবাক হতো। কারণ এত মানুষ সে কোনদিন দেখেনি। এখন সেও এটি ইনজয় করে। যখন ওর বাচ্চা হবে তখন ও ক্লিনিক্যালি ডেথই বলা চলে। তখন ৩/৪শ’ মানুষ হাসপাতালে ভিড় করতো। ওকে কেউ চিনতো না অথচ রক্তের জন্য ৪০/৫০ জন প্রস্তুত। তখন বুঝেছে আসলে মানুষের ভালবাসা কি? আসলে ভালবাসা দিয়েই এমন ভালবাসা পাওয়া যায়।