হাওর বার্তা ডেস্কঃ আমরা এমন একটা বিশ্বে বাস করতে চাই যেখানে দেশগুলো মানবিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে।’
‘আমার ভয় হলো আমরা যদি সহিংস পদ্ধতিতে গণতন্ত্র অর্জন করি তাহলে ভবিষ্যতে যেকোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এই আইডিয়া বা ধারণা থেকে আমরা কোনোভাবেই রেহাই পাব না।…এটা শুধু আমাদের শক্তিশালী গণতন্ত্র গড়ে তুলতে সাহায্য করে না, এটাও শেখায় যে সহিংসতা কোনো সঠিক পথ নয়।’
অ্যালেন ক্লেমেন্টস-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি মিয়ানমারের গণতন্ত্রের নেত্রী অং সান সু চিকে মার্কিন সাংবাদিক অ্যালেন ক্লেমেন্টস অভিহিত করেছিলেন ক্ষমতাহীনদের ক্ষমতার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে। এর আগে সু চি কারাবন্দী থাকতে ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। নোবেল কমিটি হিংসার বিরুদ্ধে অহিংসা ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছিল।
কিন্তু আজ অহিংসার বিরুদ্ধে হিংসারই উন্মত্ত উল্লাস দেখছি শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সু চির মিয়ানমারে। সেখানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্বই শুধু হরণ করা হয়নি, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, পুরুষদের হত্যা ও নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়ায় রোহিঙ্গারা গেল নির্বাচনে ভোট দিতে না পারলেও তার আন্দোলনকে বরাবর সমর্থন করেছেন।
প্রখ্যাত সুইডিশ সাংবাদিক বারটিল লিন্টনার একবার আলাপচারিতায় আমাকে বলেছিলেন, ১৯৮৮ সালের ২৬ আগস্ট সোয়েডন ময়দানের জনসভার আগে সু চি ছোট পরিসরে যে বৈঠক করছিলেন, তাতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন একজন বর্মি মুসলমান নেতা। শত শত বছর ধরে যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে বসবাস করছে, যে দেশের অর্থনীতিকে তারা সমৃদ্ধ করছে; সে দেশ থেকে আজ তারা বিতাড়িত।
যে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে সু চি ক্ষমতায় এসেছেন, সেই সামরিক শাসক ১৯৮২ সালে সংবিধান সংশোধন করে রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীন মানুষে পরিণত করে। সেই আইনে বলা হয়, যারা ১৮২৩ সালের আগে মিয়ানমার এসেছে, কেবল তারাই সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। ১৮২৪ সালে ইঙ্গো-বার্মা যুদ্ধে বর্মি রাজা পরাজিত হলে পুরো ভূখণ্ড ব্রিটিশ উপনিবেশের অধীনে চলে যায়। তখন আরাকান রাজ্য ছিল পাহাড় ও জঙ্গলাকীর্ণ। ব্রিটিশ সরকার সমতল থেকে বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের সেখানে নিয়ে যায় সেই পাহাড় ও জঙ্গল পরিষ্কার করে আবাদ করতে। সেই থেকে দেশটির স্থায়ী বাসিন্দা তারা। সে সময় এই অঞ্চল থেকে যেমন বাংলাভাষী মানুষ মিয়ানমারে গেছে, আবার ওখান থেকে রাখাইন জনগোষ্ঠীর লোকজন বাংলায় এসেছে। অনেক রাখাইন এখনো পটুয়াখালী, কক্সবাজার, বান্দরবানসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করছে। ব্রিটিশ আমলে যে বহু ভারতীয় তথা বাঙালি মিয়ানমারে জীবিকার তাগিদে যেতেন, বর্মিদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক করেছেন, তার ঈষৎ বিবরণ আছে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত উপন্যাসে।
১৯৪৮ সালে মিয়ানমার (বার্মা) স্বাধীন হওয়ার পরও সেখানে রোহিঙ্গাদের বসবাস করতে কোনো সমস্যা হয়নি। অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো তারাও নাগরিক হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। আদি সংবিধানে ছিল, ১৯৪৮ সালের আগে যারা বার্মায় এসেছে, তারা সবাই দেশের নাগরিক। ১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সামরিক শাসন জারির পর থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর পীড়ন-নির্যাতন শুরু হয়। রাষ্ট্রীয় বাহিনী কিংবা উগ্রপন্থী রাখাইনদের ধাওয়া খেয়ে প্রায়ই তাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে হয়।
আশা করা গিয়েছিল, ২০১৫ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ক্ষমতায় আসার পর রোহিঙ্গাদের দুঃখ শেষ হবে। গণতান্ত্রিক শাসনামলে সামরিক সরকারের জাতিবৈরী নীতি বাতিল করে রোহিঙ্গাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু তা হয়নি।
রোহিঙ্গাদের বিষয়ে দীর্ঘদিন নীরব থাকার পর অং সান সু চি গত বছর জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেন, যাতে বাইরের বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি মিয়ানমার সরকারের প্রতিনিধিরাও ছিলেন। গত ২৪ আগস্ট কমিশন দেশটির প্রেসিডেন্ট থিন কিউএবং রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলর অং সান সু চির হাতে যে প্রতিবেদন জমা দেয়, তাতে রাখাইন রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নতি, রোহিঙ্গাদের নাগরিক স্বীকার করা, তাদের অবাধ চলাচল এবং সব সম্প্রদায়ের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়।
কিন্তু এই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একযোগে ৩০টি পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর চৌকিতে হামলা চালিয়ে ১১ জনকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা নামে একটি জঙ্গি সংগঠন এই হামলার দায় স্বীকার করে। এরপরই নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত এলাকায় ব্যাপক হত্যা, লুট ও অগ্নিসংযোগ চালাতে থাকে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এর নাম দিয়েছে অপারেশন ক্লিনজিং বা নিশ্চিহ্নকরণ অভিযান।
মিয়ানমারে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর চৌকিতেযে সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছে, বিশ্বের প্রতিটি শান্তিকামী মানুষের সঙ্গে আমরাও তার নিন্দা করি। কিন্তু একটি জঙ্গি সংগঠনের হামলাকে কেন্দ্র করে একটি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া, নারী-শিশুসহ নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালানো মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। মিয়ানমার সরকারের দাবি, পাল্টা অভিযানে হামলাকারীরা নিহত হয়েছে, তাদের ঘাঁটিগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরও নিরীহ ও নিরপরাধ রোহিঙ্গাদের প্রতি এই আক্রোশ কেন?
আমরা দেখেছি মিয়ানমার থেকে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে, নাফ নদী পেরিয়ে যারা বাংলাদেশে এসেছে, তাদের চোখে-মুখে আতঙ্ক। এই মানুষগুলো পথের কষ্ট ও ক্ষুধার কথা ভুলে গেছে। অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। মাইন বিস্ফোরণে আহত হয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের বেশির ভাগই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। তাহলে যুবকেরা কোথায়? তাঁরা কি বেঁচে আছেন, না হত্যা করা হয়েছে, সে খবরও জানার উপায় নেই। কেননা মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকার রোহিঙ্গা–অধ্যুষিত অঞ্চলে বিদেশি সাংবাদিক কিংবা ত্রাণকর্মীদের ঢুকতে দিচ্ছে না।
২০১৫ সালের মার্চে ইস্ট ওয়েস্ট সেন্টার আয়োজিত মুক্ত সাংবাদিকতাবিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে ইয়াঙ্গুন গিয়েছিলাম। সেই সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী অং সান সু চি রাষ্ট্রীয় ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে সাংবাদিকদের সাহসের সঙ্গে লিখতে বলেছিলেন। নিঃসংকোচে সত্য প্রকাশের তাগিদ দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ সু চির গণতন্ত্রে আক্রান্ত ও বিপন্ন রোহিঙ্গা এলাকায় সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সরকারি উদ্যোগে একবার যে কয়েকজন সাংবাদিককে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাঁরা দেখেছেন, গ্রামে কোনো মানুষ নেই, ঘরবাড়ি জ্বলছে।
সম্প্রতি অং সান সু চির অফিস থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে টেলিফোন আলাপেও সু চি বলেছেন, রাখাইনে সব সম্প্রদায়ের মানুষ নিরাপদ আছে! মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেনি। তাঁর দাবি, বিদেশি গণমাধ্যমে যেসব লেখালেখি হচ্ছে, টিভি-পত্রিকায় যেসব ছবি দেখানো হচ্ছে তার বেশির ভাগই ‘ভুয়া’। তাহলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে, নদীতে ডুবে মরার ঝুঁকি নিয়ে দেশ ছাড়ছে কেন? মিয়ানমার সরকার কেন বিদেশি সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক ও মানবাধিকারকর্মীদের সেখানে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে না?
অং সান সু চি বলেছেন, সেখানে সব সম্প্রদায়ের মানুষ নিরাপদ আছে। তাঁর এই সব সম্প্রদায় কি রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়ে? তাঁর ভাষায় তারা দেশের ‘নাগরিক’ না হোক, মানুষ তো। যেই সু চি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, যিনি সহিংসা সঠিক পথ নয় বলে অহিংসাকে জীবনের মূলমন্ত্র করেছিলেন, সেই সু চির হাতে আজ এভাবে মানবতা লাঞ্ছিত হবে, আমরা ভাবতে পারি না। একবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত সু চির কাছে রোহিঙ্গা সমস্যার কথা তুললে তিনি তাঁকে সংশোধন করে বলেছিলেন, ‘ওদের রোহিঙ্গা বলবেন না।’ অর্থাৎ নোবেল বিজয়ী নেত্রী তাদের জাতিসত্তাকেই অস্বীকার করছেন। শান্তির নোবেল এত নিষ্ঠুর কেন?
অং সান সু চির মনে রাখা উচিত, তিনি যখন সামরিক জান্তার কারাগারে বন্দী, তখন তাঁর মুক্তির দাবিতে রোহিঙ্গারাও রাজপথে নেমেছিল। আন্দোলন করেছিল। তিনি বলেছিলেন, এক দেশ আরেক দেশের সঙ্গে মানবিক বন্ধন দ্বারা সম্পর্কযুক্ত হয়। কিন্তু গণতন্ত্রের নেত্রী সেই মানবিক বন্ধনের রজ্জুটি নিজ হাতেই ছিঁড়ে ফেললেন।
শক্তিধর দেশগুলো তাদের স্বার্থে মিয়ানমারকে তোয়াজ করছে, মিয়ানমার সরকারের এই দমন-পীড়নে হয় তারা নীরব থাকছে, অথবা ক্ষীণকণ্ঠে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। আবার কেউ কেউ সেখানে মানবিক বিপর্যয়ের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে কথিত জঙ্গিদের ওপর সব দায় চাপাচ্ছে। আমরা যেকোনো জঙ্গি হানা কিংবা সন্ত্রাসী ঘটনার নিন্দা জানাই। এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ যারা ঘটিয়েছে, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। কিন্তু সেই সন্ত্রাসী ঘটনার অজুহাত তুলে রাষ্ট্র তো একটি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে না।
বাংলাদেশ মানবিক বন্ধনকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয় বলেই প্রায় চার দশক ধরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বোঝা বহন করে চলেছে। গত দুই সপ্তাহে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছে। আমরা তাদের সাধ্যমতো সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছি। মিয়ানমারের গণমাধ্যমেই দেখলাম, সাধারণ রোহিঙ্গারা আরসার সঙ্গে নেই বলে জানিয়ে দিয়েছে, তারা এই জঙ্গিগোষ্ঠীকে প্রত্যাখ্যান করেছে (ইরাবতী), তারপরও রোহিঙ্গাদের ওপর এই উৎপীড়ন কেন? তারা নতুন দেশ চায় না, অন্য দেশে আশ্রিত হয়েও থাকতে চায় না, রোহিঙ্গারা চায় যে দেশে তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বসবাস করছে, সে দেশ তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করুক। হিংসা দিয়ে দূরে ঠেলে না দিক।
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির কাছে একটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর এটুকুন চাওয়া কি খুব বেশি মনে হয়? তিনি ক্ষমতাহীনের ক্ষমতার উৎস থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলে ইতিহাস তাঁকেও ক্ষমা করবে না।