হাওর বার্তা ডেস্কঃ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন এবং লাখ লাখ রোহিঙ্গার দেশত্যাগ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুব নড়াচড়া কি টের পাওয়া যাচ্ছে? কিছু পশ্চিমা দেশ বা জাতিসংঘের তরফে কিছু নিন্দা-মন্দ শোনা যাচ্ছে। আর এর বাইরে ক্ষোভ-বিক্ষোভ যা কিছু দেখা যাচ্ছে, তা কিছু মুসলিম দেশের তরফে। আর বাংলাদেশ তো নিজেই ঘটনার শিকার, তাই আমাদের তরফে তো কিছু প্রতিক্রিয়া থাকবেই। মুসলিম দেশগুলোর যাঁরা আওয়াজ তুলেছেন, সেখানে ভাগাভাগি পরিষ্কার। যে যা করছে, তা করছে নিজেদের রাজনীতির হিসাব-নিকাশ বিবেচনায় নিয়ে। মানবিক বিপর্যয় বা সংকট নিয়ে কারও মাথাব্যথা টের পাওয়া যাচ্ছে না।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে সম্ভবত সবচেয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে মালদ্বীপ। মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এরই মধ্যে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। আর বাংলাদেশে এসেছেন তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফার্স্ট লেডি। সৌদি আরবের মুখে রা নেই। তারা কাতারকে কোণঠাসা করতে বা ইয়েমেনে শিয়া সম্প্রদায়ের হুতিদের মারতে যতটা উৎসাহী, রোহিঙ্গা নিয়ে ততটাই নীরব। আর তুরস্ক যেখানে আগ বাড়িয়েছে, সেখানে সৌদি আরব চুপ থাকবে, এটাই তো এখন মুসলিম বিশ্বের রাজনীতি। তুরস্কের ‘সুলতানাতের’ আকাঙ্ক্ষাটা এখন আর খুব রাখঢাকের বিষয় নয়। ‘সুলতান’ হতে চান এরদোয়ান, মুসলিম দুনিয়ার সুলতান।
অনেকের তরফেই এখন দাবি শুনছি, রোহিঙ্গা ইস্যুকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলতে হবে এবং মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এর কিছু গুরুত্ব থাকতে পারে, কিন্তু ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়’ বা ‘আন্তর্জাতিক চাপ’ বলতে আমরা এত দিন যা বুঝে এসেছি, তার এখন আর ‘ভাত’ নেই। বাণিজ্য, অর্থনীতি ও কূটনীতির স্বার্থ মিলেমিশে এখন এমন অবস্থায় গেছে যে ‘আন্তর্জাতিক চাপ’-এর পরিস্থিতি বদলে গেছে। কোন দেশে কেমন নির্বাচন হলো, বিরোধীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন হচ্ছে কি না, কোনো জাতিগোষ্ঠী নির্মূলের শিকার হচ্ছে কি না—এগুলো এখন আর খুব বড় ইস্যু নয়। পশ্চিমা দুনিয়া এসব নিয়ে এখন রুটিন কিছু বিবৃতি দেয়, কখনো কিছু প্রস্তাব পাস করে, এটুকুই। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে শুধু কয়েকটি মুসলিম দেশের তৎপরতার ফল আখেরে খুব ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে না।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যা ঘটছে, তা মানবতার চরম লঙ্ঘন এবং বড় এক মানবিক বিপর্যয়। সেখানে মানুষ মরছে, বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাখ লাখ লোক মরিয়া হয়ে দেশের সীমান্ত পার হচ্ছে। এসব বিষয় আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসুক, সেটা অবশ্যই আমাদের চাওয়া। আর ভূমির সমস্যা ও অর্থনৈতিক চাপ নিতে অক্ষম একটি দেশ হিসেবে যেহেতু আমাদেরই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে হচ্ছে, তা বিশ্ববাসীকে তো আমাদের জানাতেই হবে। কিন্তু কে কোন স্বার্থ নিয়ে এগোচ্ছে, সে ব্যাপারের আমাদের সতর্ক থাকা খুবই জরুরি।
এই অঞ্চলে দুই বড় দেশ আছে, যারা প্রতিযোগী ও প্রতিদ্বন্দ্বী। আশপাশের দেশগুলোতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে তারা অনেকটাই মরিয়া। সেই চীন বা ভারতের তরফে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন নিয়ে আনুষ্ঠানিক কিছু শুনতে পেলাম কি? এমনকি এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সফর করলেন, তখনো না। মিয়ানমার যখন দুনিয়া থেকে নিজেদের আলাদা করে রেখেছিল, তখন চীন ছিল দেশটির ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। মিয়ানমারের খাতির বাড়াতে ভারত যে এখন দেশটিকে কিছু বলবে না, তা বোঝা যায়। আর মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থটিও যথেষ্ট বড়। আর পুরোনো বন্ধু চীন এ নিয়ে কোনো কথা বলবে না, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। চীন সরকারের মুখপত্র হিসেবে বিবেচিত হাওর বার্তাকে এ বিভিন্ন ইস্যুতে আমরা সরকারের অবস্থান টের পাই। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কোনো মন্তব্য বা অবস্থান খুঁজে পাওয়া গেল না। রয়টার্সের বরাতে খালি একটি নিউজ পাওয়া গেল।
গত বছরের (২০১৬) ফেব্রুয়ারি মাসে মিয়ানমার সফরে গিয়েছিলাম। দেশে ফিরে একটি লেখা লিখেছিলাম। তখন বুঝেছিলাম, আমাদের এই প্রতিবেশী দেশটি সম্পর্কে আমরা আসলে কত কম জানি। উল্টোটিও সত্য। তারাও আসলে আমাদের সম্পর্কে কিছুই জানে না। তখন গণতন্ত্র এসে গেছে, বিনিয়োগের জন্য মিয়ানমারের দরজা খুলে গেছে। তখন টের পেয়েছিলাম আমাদের এই পাশের দেশটি বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে।
সেই লেখায় মার্কিন ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও লেখক জেমস রজারের একটি মন্তব্য উল্লেখ করেছিলাম। ২০১২ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘সম্ভবত বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগের সুযোগ হচ্ছে মিয়ানমার। ১৯৬২ সালে মিয়ানমার ছিল এশিয়ার সবচেয়ে ধনী দেশ। ১৯৬২ সালে তারা নিজেদের দরজা বন্ধ করে দেয় এবং এখন তারা এশিয়ার দরিদ্রতম একটি দেশ। আমি এখন সেখানে অপরিসীম সম্ভাবনা দেখছি, কারণ তারা আবার দরজা খুলতে শুরু করেছে। চীন যখন ১৯৭৮ সালে নিজেদের উন্মুক্ত করতে শুরু করে, তখন বিষয়টি যেমন ছিল, এটাও ঠিক তা-ই। তখন অবিশ্বাস্য সুযোগের সৃষ্টি হয়েছিল। আমার মতে, মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও একই জিনিস সত্য।’
মিয়ানমার যা আশা করেছিল, তার চেয়েও অনেক বেশি বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। এখন মিয়ানমারে মূলত জ্বালানি, ম্যানুফ্যাকচার ও টেলিকম খাতে এই বিনিয়োগ হচ্ছে। ২০১৬ সালের শুরুতে দেখেছিলাম, টেলিকম খাতে মূলত কাজ করছেন আমাদের বাংলাদেশের প্রকৌশলী ও কর্মীরা। বিদেশি তেল-গ্যাস কোম্পানি আসছে, আসছে আন্তর্জাতিক হোটেল চেইনগুলো। দেশটিতে ঢল নেমেছে বিদেশি পর্যটকদেরও। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সিএনএন মানির পর্যবেক্ষণ বলেছিল, ২০১৬ সালে যে দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হবে, তার মধ্যে ৩ নম্বরে থাকবে বাংলাদেশ। তবে ২০২০ সালে গিয়ে মিয়ানমার প্রবৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে ৩ নম্বরে চলে আসতে পারে।
মিয়ানমারে প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব নেই। সেখানে বিনিয়োগ কেউ ঠেকাতে পারবে না। পশ্চিমা দেশ ও কোম্পানিগুলো সেই সুযোগ নিতে শুরু করেছে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তাই আন্তর্জাতিক বা পশ্চিমা কোনো ‘চাপের’ বিপদ নেই। বাংলাদেশে নতুন আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য নানা দেশ ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর সূত্রে কিছু সাহায্য- সহযোগিতা মিলতে পারে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের তো আমরা সব সময়ের জন্য পুষতে পারব না, তাই এর সমাধানের পথটি আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা
বহু পুরোনো, এ নিয়ে এরই মধ্যে আমরা যে অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি তা স্বীকার করতেই হবে।
মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী দেশ। নিজেদের মধ্যে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজাই বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় আসল পথ। কাজটি সহজ নয়, পরিস্থিতিকে জটিল করতে অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নানা শক্তির যে নানা ধরনের ও মাত্রার স্বার্থ রয়েছে, তা টের পাওয়া যাচ্ছে। একটি জাতিগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তা যাতে কোনোভাবেই ইসলামি আন্দোলন বা ভাবধারার দিকে ঝুঁকতে না পারে অথবা তাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যাতে কোনোভাবেই ‘মুসলিম জঙ্গি’ আন্দোলনে রূপ না নেয়, সেই দিকটিতে বাংলাদেশের গভীর নজর থাকতে হবে। বাংলাদেশের জন্য এখন এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মুসলিম দুনিয়ার নেতা হতে চায় বা খবরদারি করতে আগ্রহী কেউ যাতে এই চরম দুর্দশার শিকার মানুষগুলোকে নিয়ে কোনো ধরনের রাজনীতি করতে না পারে, সে ব্যাপারে চোখ–কান খোলা রাখার দায়িত্ব আমাদের আছে।
রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী সব সময়ই তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। ফলে সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত জাতির পরিচয় নিয়ে এখন তাদের আশ্রয় খুঁজতে হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ ও সাহায্য সংস্থা একসময় তাদের নিয়ে রাজনীতি করেছে; কিন্তু এই জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কোনো কাজ করেনি। বরং সত্তর ও আশির দশকে সাধারণ শিক্ষাদীক্ষায় তাদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে এমন অভিযোগও রয়েছে। ইয়াঙ্গুনে কাজের সূত্রে থাকেন এমন অনেক বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলে তখন বুঝেছিলাম যে অর্থনৈতিকভাবে ও শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে মিয়ানমারে সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে একধরনের ভীতি আছে। উগ্রবাদী কিছু বৌদ্ধ গোষ্ঠী একে কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাবকে আরও জোরদার করেছে। সেনাশাসনের সময় এই চরমপন্থী বৌদ্ধ গোষ্ঠীগুলো সরকারের যথেষ্ট সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছে বলে জোর অভিযোগ আছে। তারা এখনো সক্রিয় আছে।
প্রতিবেশী দেশ হিসেবে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যতটা সৌহার্দ্যপূর্ণ হওয়া উচিত ছিল, সে ক্ষেত্রে মূল বাধা হচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু। দুই দিন আগের লেখায় (আমরা আসলে কী ভাবছি? হাওর বার্তা ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭) লিখেছিলাম, কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় ঘটনাটিকে উদ্দেশ্যমূলক বিবেচনা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। যে মহল বা যারাই এর পেছনে থাকুক, তাদের এই অসৎ উদ্দেশ্য ঠেকিয়ে দিতে পারে দুই দেশের সরাসরি যোগাযোগ ও আলোচনা। সংঘাত-সহিংসতা ও চরম মানবিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যেও আশার কথা হচ্ছে, দুই দেশের সামনে এখন কফি আনানের প্রতিবেদনটি রয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে মিয়ানমার সরকার নিজ উদ্যোগে এই কমিশন করেছে। দুই দেশের আলোচনা শুরুর ভিত্তি হতে পারে এই প্রতিবেদন।
তবে এর আগে বাংলাদেশকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করতে হবে তা হচ্ছে মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে আসা সব রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিবন্ধন ও তালিকাভুক্তি। একটি গ্রহণযোগ্য এবং ডিজিটালাইজড তালিকা তৈরি করা গেলে দুই দিন আগে বা পরে যখনই আলোচনা শুরু হবে বা আনান কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী দুই দেশের যৌথ কমিশন গঠন করা সম্ভব হবে, তখন তাদের দেশে ফেরা সহজ হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ১৯৮২ সালে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের ব্যাপারে যে আইনই করে থাক না কেন, ১৯৭৭ সালে যে ২ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল, ১৯৭৮ সালে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক চুক্তির অধীনে মিয়ানমার কিন্তু সেই রোহিঙ্গাদের তাদের নাগরিক হিসেবে মেনে নিয়েই বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।