ঢাকা ০১:৪০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
সাদপন্থীদের নিষিদ্ধ ও বিচারের দাবিতে মদনে আবারও বিক্ষোভ মিছিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বর্ডারে দুর্নীতির কারণে ঠেকানো যাচ্ছে না ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ আব্রাম না থাকলে তাকে আমার যোগ্য বলেও মনে করতাম না ওমরাহ শেষে গ্রামে ফিরে খেজুর-জমজমের পানি বিতরণ করল শিশু রিফাত বিদেশে প্রশিক্ষণে ঘুরে-ফিরে একই ব্যক্তি নয়, জুনিয়রদের অগ্রাধিকার কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়ে সড়ক ছাড়লেন চিকিৎসকরা রেমিট্যান্সে জোয়ার, ২১ দিনে এলো ২ বিলিয়ন ডলার গণমাধ্যমের পাঠক-দর্শক-শ্রোতার মতামত জরিপ জানুয়ারিতে বুয়েট শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৩ আসামি রিমান্ডে বিয়ের আগে পরস্পরকে যে প্রশ্নগুলো করা জরুরি

মিয়ানমারে গণহত্যা, আমরা কী করতে পারি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০১:২৬:৪৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭
  • ৩২৫ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর যে সুপরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ নির্যাতন চলছে, তাকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, আসল ঘটনা গণহত্যা। নির্বিচারে তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলছে, পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে, আর চলছে নারী ধর্ষণ। কেউ কেউ বলতে চাইছে, এটি সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, বৌদ্ধদের সঙ্গে মুসলমানদের বিরোধ। মোটেই তা নয়, রোহিঙ্গাদের মধ্যে হিন্দুও আছে, তারাও একইভাবে নির্যাতিত হচ্ছে।

মিয়ানমার সরকার প্রচার করছে, রোহিঙ্গারা জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত। ভাবটা এ রকমের যে এরা আইএসের সঙ্গে যুক্ত, তাই দমন করাটা কর্তব্য। সরকার যে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, তা বর্ণবাদী গণহত্যা, যার চরিত্র ফ্যাসিবাদী। মিয়ানমারের সংখ্যাগুরুরা চায় সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করে তাদের ভৌত সম্পদ, জায়গাজমি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ঘরবাড়ি—সবকিছু দখল করে নিজেদের সম্পদ বাড়াবে। এরা লুণ্ঠনকারী।

রোহিঙ্গা বিতাড়নের ঘটনা নতুন নয়। এ কাজ মিয়ানমারের সামরিক স্বৈরশাসকেরা আমোদের সঙ্গেই করত; আশা করা গিয়েছিল যে গণতন্ত্র এলে নিপীড়নের অবসান ঘটবে। বাইরে থেকে আন্তর্জাতিক চাপ ও ভেতরের গণ-আন্দোলনের মুখে সামরিক শাসকেরা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের দখলদারি থেকে পশ্চাদপসরণ করেছে, ক্ষমতায় এসেছেন নির্বাচিত জননেত্রী, ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’, শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারে বিভূষিত অং সান সু চি। কিন্তু তাতে নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি; তাদের ওপর নিপীড়ন বরং বেড়েছে। সামরিক সরকারের উদ্বেগ ছিল সু চির দলের শক্তি ও আন্তর্জাতিক বিরোধিতার মোকাবিলা করা। তারা সে কাজকেই কর্তব্য করে তুলেছিল। এখন যে নির্বাচিত সরকার এসেছে, দেশে-বিদেশে তার কোনো প্রতিপক্ষ নেই, তাই দুর্বল রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিয়ে সেখানে নিজেদের লোকদের বসানোর কাজে তারা মহা উৎসাহে অবতীর্ণ হয়েছে। জবাবদিহির ক্ষেত্রে অবৈধ, দখলদার ও স্বৈরাচারী সামরিক শাসকদের তবু একটা আত্মসচেতনতা ছিল; বৈধ, নির্বাচিত ও জনপ্রিয় সরকারের চিত্তাকাশে সেটুকুও নেই।

অং সান সু চি নিজে প্রথমে নীরব ছিলেন, যেন দেখতে পাচ্ছেন না; পরে তিনি সরব হয়েছেন। উৎপীড়িতের পক্ষে নয়, উৎপীড়কের পক্ষে। তাঁর রূপ এখন জাতীয়তাবাদীর। এই জাতীয়তাবাদ বর্ণবাদী, এর স্বভাবটা পুঁজিবাদী। অতীতে হিটলার ছিলেন এর শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি, বর্তমানে ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই পথেরই পথিক। ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত ইয়াহিয়া খানকে আমরা ওই রূপেই দেখেছি। সামরিক জান্তার হাতে বন্দী অবস্থায় সু চি নিঃসঙ্গ ছিলেন, এখন আর তা নন; এখন তিনি মুক্ত এবং সারা বিশ্বে যত পুঁজিবাদী-ফ্যাসিবাদী শাসক আছেন, সবাই তাঁর সঙ্গী। পুঁজিবাদ এখন রূপ নিয়েছে সংকোচহীন ফ্যাসিবাদের। বিশ্বজুড়ে ফ্যাসিবাদী সুবিধাভোগীরা সুবিধাবঞ্চিতদের ওপর যতভাবে পারা যায় নিপীড়ন করছে। মিয়ানমারেও ওই একই ঘটনা, পোশাকটাই যা আলাদা।

নিপীড়নকারী সরকার বলছে, রোহিঙ্গারা দুষ্কৃতকারী। একাত্তর সালে পাঞ্জাবি হানাদারদের চোখে বাংলাদেশের সব মানুষই ছিল প্রকাশ্য অথবা ছদ্মবেশী দুষ্কৃতকারী। মুষ্টিমেয় লোক ছিল তাদের সহযোগী; তাদেরও তারা সম্ভাব্য দুষ্কৃতকারী বলেই জানত, মুখে যা-ই বলুক না কেন। ‘দুষ্কৃতকারী’দের দমনকাজ একাত্তরে ভীষণভাবে চলেছে। সেটা ছিল গণহত্যা। মিয়ানমার সরকার এখন যা করছে, সেটাও গণহত্যাই। প্রাণভয়ে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল এক কোটি। শরণার্থীদের এই বিপুল বোঝা বহন করা ভারতের পক্ষে মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। তাদের কষ্ট হয়েছে। কিন্তু বিপন্ন মানুষদের তারা আশ্রয় দিয়েছে, খাবার দিয়েছে, যত্ন নিয়েছে। তারা জানত যে শরণার্থীরা শখ করে আসেনি, প্রাণভয়ে পালিয়ে এসেছে। ভারত সরকারের চেষ্টা ছিল, বাংলাদেশিরা যাতে নিরাপদে ও সম্মানের সঙ্গে দেশে ফিরে যেতে পারে, সেটা দেখা। সে জন্য তারা কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছে, বিশ্ববাসীকে সমস্যাটা কী তা জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি সংগ্রহ করেছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তাদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়েছে। আশা করেছে শরণার্থীরা শিগগিরই ফিরে যেতে পারবে। ঘটেছেও সেটাই। নয় মাসেই সমস্যার সমাধান পাওয়া গেছে।

সেদিন বিপন্ন বাংলাদেশিদের সংখ্যা ছিল অনেক। কিন্তু তবু পুঁজিবাদী বিশ্বের সরকারগুলো সাড়া দেয়নি। সেসব দেশের মানুষ ছিল বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে। থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্বের মানুষ নির্যাতনের সবটা খবর পায়নি, যেটুকু পেয়েছে, তা-ও খণ্ডিত। মিডিয়ার পক্ষে যথোপযুক্তরূপে সাড়া দেওয়া সম্ভব হয়নি। মিডিয়া ছিল পুঁজিবাদীদের নিয়ন্ত্রণে এবং পুঁজিবাদীদের ছিল একই রা; সেটি হলো দুষ্কৃতকারীরা রাষ্ট্রের অখণ্ডতা নষ্ট করতে তৎপর হয়েছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করাটা দরকার। মিডিয়ার কর্মীরা ছিলেন সহানুভূতিশীল; নির্যাতনের খবর যতটুকু সম্ভব তাঁরাই বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন।

রোহিঙ্গাদের দুর্ভাগ্য একাধিক। সংখ্যায় তারা অধিক নয়; তারা খুবই দরিদ্র এবং বিশ্বের অবহেলিত একটি প্রান্তে তাদের বসবাস। বিশ্ব তাদের খবর রাখে না, বিশ্ব তাদের গুরুত্ব দেয় না। তাদের পক্ষে বলবে এমন মানুষের ভীষণ অভাব। তদুপরি যে সরকার তাদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে, সেটি গণতান্ত্রিক বলে পরিচিত। গণতান্ত্রিক কেবল এই অর্থে যে এটি ক্ষমতায় এসেছে নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচিত মানেই যে গণতান্ত্রিক নয়, এটি বহুবার বহু ক্ষেত্রে প্রমাণিত হয়েছে, প্রমাণিত হচ্ছে মিয়ানমারেও। ওদিকে বাংলাদেশিদের পাশে তবু ভারত ছিল, রোহিঙ্গাদের পাশে প্রতিবেশী বাংলাদেশও নেই। এমনই তাদের দুর্ভাগ্য।

রোহিঙ্গাদের দুর্দশা পরিসংখ্যানের হিসাবে পরিণত হয়েছে। কতজন এল, কতজন রয়েছে নো ম্যানস ল্যান্ডে, কত লাশ দেখা গেছে নাফ নদীতে ভাসতে—এসব খবর তা–ও পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু ভেতরে কী ঘটছে, তা জানার উপায় নেই। সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে, তাদের উৎসাহও সীমিত, তদুপরি তাদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না পরিদর্শনের। সিরিয়া, লেবানন, ইরাক থেকে হাজার হাজার শরণার্থী যাচ্ছে ইউরোপে, কোথাও পথ খোলা, কোথাও বন্ধ; পানিতে ডুবে ও রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে বহু মানুষ। তাদের মানবিক দুর্দশার খবরটা তবু জানছে বিশ্ববাসী, কিন্তু রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে কী ঘটছে, তা জানানোর উন্মুক্ত উপায় নেই। সিরিয়ার শরণার্থী পরিবারের একটি শিশু অমানবিক বিপদের মধ্যে মুখ থুবড়ে মৃত অবস্থায় পড়ে ছিল সমুদ্রের ধারে; তার ছবি সারা বিশ্ব দেখেছে। শিউরে উঠেছে, ধিক্কার দিয়েছে শিশু হত্যাকারীদের। এমন বর্বরতা রোহিঙ্গাদের একটি-দুটি নয়, বহু শিশুর ভাগ্যে ঘটেছে; কিন্তু তাদের খবর বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছায়নি, পৌঁছালেও তারা প্রাণবন্ত শিশু থাকে না, প্রাণহীন সংখ্যায় পরিণত হয়।

২. উৎপাটিত রোহিঙ্গারা স্রোতের মতো চলে আসছে বাংলাদেশের সীমান্তে। আগেও এসেছে, শত শত; এখন আসছে হাজার হাজার। বাংলাদেশের পক্ষে এত শরণার্থীকে জায়গা দেওয়া কঠিন কাজ। বাংলাদেশ তাহলে কী করবে? নিস্পৃহভাবে যে দেখবে সে উপায় নেই। এই স্রোতকে প্রতিহত করার, আর্ত মানুষকে সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা বাংলাদেশ করছে, কিন্তু সক্ষম হচ্ছে না। হবেও না। বাংলাদেশের পক্ষে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দিয়ে উপায় নেই। প্রথম কারণ, কাজটা হবে অমানবিক; দ্বিতীয় কারণ, কাজটা অসম্ভব।

মানুষ কেন শরণার্থী হয়, বাংলাদেশের মানুষ সেটা জানে। একাত্তরের কথা তাদের পক্ষে কোনো দিনই এবং কোনোভাবেই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। লাখ লাখ বাঙালি যে সেদিন শরণার্থী হয়েছিল, তা কাজের খোঁজে বা সুবিধার লোভে নয়, প্রাণের ভয়ে। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই ঘটেছে। গণহত্যার মুখোমুখি হয়ে তারা বিষয়-সম্পত্তি, ঘরবাড়ি, সহায়-সম্বল, এমনকি আপনজনকেও ফেলে রেখে প্রাণ বাঁচাতেই পালিয়ে আসছে। তারা মারা পড়ছে, হারিয়ে যাচ্ছে, দগ্ধ হচ্ছে। মৃতের লাশ, আহত মানুষ, বিপন্ন শিশু ও বৃদ্ধকে মাথায় করে, কোলে করে নিয়ে তারা ছুটছে আশ্রয়ের সন্ধানে, নৌকা ডুবে যাওয়ায় অনেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। তাদের আশ্রয় না দিলে তারা যাবে কোথায়? আমরা আজ যদি বিপন্ন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দিই, তাহলে কেবল নিজেদের ইতিহাস থেকেই নয়, অন্তর্গত মনুষ্যত্ব থেকেও বিচ্যুত হব।

কিন্তু আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারটা তো সাময়িক। দেখতে হবে গণহত্যা যাতে থামে এবং শরণার্থীরা যাতে নিরাপদে ও সসম্মানে নিজেদের দেশে ফিরে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এর জন্য প্রথম ও প্রধান কাজ ঘটনার বাস্তবতা ও ভয়াবহতা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা। বিষয়টিকে জাতিসংঘ ও নিরাপত্তা পরিষদের কাছে নিয়ে যাওয়া চাই। ঘটনা যে মোটেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয়, সুপরিকল্পিত গণহত্যা, সেটা বুঝিয়ে দিতে হবে। কথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্বুদ্ধ করা চাই, তারা যাতে মিয়ানমারের স্বৈরাচার সরকারের ওপর সব ধরনের চাপ প্রয়োগ করে গণহত্যা থামিয়ে শরণার্থীদের ফেরত নিয়ে যেতে বাধ্য করতে পারে। শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলা করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সব সাহায্য ও পুনর্বাসন সংস্থার কাছ থেকে বস্তুগত সহায়তা চাওয়াটাও যে আশু ও জরুরি কর্তব্যের মধ্যেই পড়বে, সেটা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না।

মূল দায়িত্ব সরকারেরই। কিন্তু সরকারকে উদ্বুদ্ধ করা চাই, যাতে তার আলস্য ভাঙে, সরকার যাতে কালবিলম্ব না করে তার কর্তব্যে ব্রতী হয়। কারা করবেন এ কাজ? নিশ্চয়ই তাঁরা করবেন না, যাঁরা মনে করেন যে রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য একটা উটকো ঝামেলা, অথচ বলতে পারবেন না আমাদের পক্ষে করণীয়টা কী। বড়জোর বলবেন, সীমান্ত প্রহরা আরও জোরদার করতে হবে, ঠেলা-ধাক্কাটা আরও শক্ত হাতে দেওয়া চাই। কিন্তু তাতে তো সমস্যার কোনো সমাধান নেই। প্রাণভয়ে পালানো এসব মানুষ বন্যার স্রোতের মতোই প্রবল, বাঁধের ওপর তারা তো আছড়ে পড়বেই; আর বাঁধটা তো শেষ পর্যন্ত মানবিকই, যতই সে নিশ্ছিদ্র হওয়ার চেষ্টা করুক না কেন। ‘অনুপ্রবেশ’ বলি আর যা-ই বলি, ঘটনা ঘটবেই, এখন যেমন ঘটেছে। শক্ত হৃদয় ওই দলের একাংশ বলবে যে রোহিঙ্গারা নিচু সংস্কৃতির মানুষ, তারা এসে মাদক ব্যবসা করবে, জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত হবে, চুরি-ডাকাতি বাদ রাখবে না, এমনকি ভোটার সেজে রাজনীতিতে পর্যন্ত ঢুকে পড়বে।

এরা ভুলে যায় যে বিপন্ন রোহিঙ্গারা ওই সব কাজ করার জন্য শরণার্থী হয়নি। শরণার্থী হয়েছে বর্ণবাদী সরকারের বন্দুকের মুখে। রোহিঙ্গারা অপরাধ করার জন্য বাংলাদেশে পাড়ি জমায়নি, তাদের স্থানীয় মুনাফালোভীরা নিজেদের স্বার্থে অপরাধে জড়িত করছে। শরণার্থীদের জন্য কাজ নেই, উপার্জনের উপায় নেই, তাই তারা শিকার হচ্ছে মুনাফালোভীদের চক্রান্তে। প্রকৃত অপরাধী হচ্ছে মিয়ানমারের সরকার, যারা এই গণহত্যায় লিপ্ত। পাকিস্তানের বর্তমান শাসকেরা যেভাবে তাদের রাষ্ট্রকে হিন্দুশূন্য করার কাজটা সম্পন্ন করে এখন খ্রিষ্টানশূন্য করার কাজে নেমেছে। মিয়ানমার সরকারও হয়তো তার চেয়েও দ্রুত ও প্রকাশ্য পদ্ধতিতে তাদের রাষ্ট্রকে রোহিঙ্গাশূন্য করার ব্রত নিয়েছে। এ কাজে তারা বিলক্ষণ সফল হবে, যদি না তাদের নিবৃত্ত করা যায়।

বাংলাদেশ সরকারকে তাদের কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্বটা তাই নিতে হবে দেশের বিবেকবান মানুষকেই। অর্থাৎ তেমন মানুষদের, যাঁরা পুঁজিবাদকে চেনেন এবং জানেন যে বিশ্বের অন্যত্র যেমন, মিয়ানমারেও তেমনি শরণার্থী সমস্যাটা মুনাফালোভী ও মনুষ্যত্ববিরোধী পুঁজিবাদীরাই তৈরি করে। তাঁরা জানেন যে ১৯৭১-এর পাকিস্তানি হানাদার ও ২০১৭-এর মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগকর্তাদের ভেতরে নামেই যা পার্থক্য, ভেতরে তারা একই। এ-ও তাদের জানা আছে যে জলবায়ু পরিবর্তনে ধরিত্রী যে এখন বিপন্ন, তার কারণ পুঁজিবাদী বিশ্বের উন্নয়ন তৎপরতা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। পুঁজিবাদবিরোধী মানুষের এখন অনেক কর্তব্য; মূল কর্তব্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাকে ভেঙে সামাজিক মালিকানার ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করা। মিয়ানমারের অসহায় মানুষের পক্ষে দাঁড়ানোটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই দাঁড়ানো বটে। এক কথায় এ দায়িত্ব বামপন্থীদেরই, সারা বিশ্বে এবং বাংলাদেশে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

সাদপন্থীদের নিষিদ্ধ ও বিচারের দাবিতে মদনে আবারও বিক্ষোভ মিছিল

মিয়ানমারে গণহত্যা, আমরা কী করতে পারি

আপডেট টাইম : ০১:২৬:৪৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর যে সুপরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ নির্যাতন চলছে, তাকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, আসল ঘটনা গণহত্যা। নির্বিচারে তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলছে, পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে, আর চলছে নারী ধর্ষণ। কেউ কেউ বলতে চাইছে, এটি সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, বৌদ্ধদের সঙ্গে মুসলমানদের বিরোধ। মোটেই তা নয়, রোহিঙ্গাদের মধ্যে হিন্দুও আছে, তারাও একইভাবে নির্যাতিত হচ্ছে।

মিয়ানমার সরকার প্রচার করছে, রোহিঙ্গারা জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত। ভাবটা এ রকমের যে এরা আইএসের সঙ্গে যুক্ত, তাই দমন করাটা কর্তব্য। সরকার যে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, তা বর্ণবাদী গণহত্যা, যার চরিত্র ফ্যাসিবাদী। মিয়ানমারের সংখ্যাগুরুরা চায় সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করে তাদের ভৌত সম্পদ, জায়গাজমি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ঘরবাড়ি—সবকিছু দখল করে নিজেদের সম্পদ বাড়াবে। এরা লুণ্ঠনকারী।

রোহিঙ্গা বিতাড়নের ঘটনা নতুন নয়। এ কাজ মিয়ানমারের সামরিক স্বৈরশাসকেরা আমোদের সঙ্গেই করত; আশা করা গিয়েছিল যে গণতন্ত্র এলে নিপীড়নের অবসান ঘটবে। বাইরে থেকে আন্তর্জাতিক চাপ ও ভেতরের গণ-আন্দোলনের মুখে সামরিক শাসকেরা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের দখলদারি থেকে পশ্চাদপসরণ করেছে, ক্ষমতায় এসেছেন নির্বাচিত জননেত্রী, ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’, শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারে বিভূষিত অং সান সু চি। কিন্তু তাতে নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি; তাদের ওপর নিপীড়ন বরং বেড়েছে। সামরিক সরকারের উদ্বেগ ছিল সু চির দলের শক্তি ও আন্তর্জাতিক বিরোধিতার মোকাবিলা করা। তারা সে কাজকেই কর্তব্য করে তুলেছিল। এখন যে নির্বাচিত সরকার এসেছে, দেশে-বিদেশে তার কোনো প্রতিপক্ষ নেই, তাই দুর্বল রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিয়ে সেখানে নিজেদের লোকদের বসানোর কাজে তারা মহা উৎসাহে অবতীর্ণ হয়েছে। জবাবদিহির ক্ষেত্রে অবৈধ, দখলদার ও স্বৈরাচারী সামরিক শাসকদের তবু একটা আত্মসচেতনতা ছিল; বৈধ, নির্বাচিত ও জনপ্রিয় সরকারের চিত্তাকাশে সেটুকুও নেই।

অং সান সু চি নিজে প্রথমে নীরব ছিলেন, যেন দেখতে পাচ্ছেন না; পরে তিনি সরব হয়েছেন। উৎপীড়িতের পক্ষে নয়, উৎপীড়কের পক্ষে। তাঁর রূপ এখন জাতীয়তাবাদীর। এই জাতীয়তাবাদ বর্ণবাদী, এর স্বভাবটা পুঁজিবাদী। অতীতে হিটলার ছিলেন এর শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি, বর্তমানে ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই পথেরই পথিক। ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত ইয়াহিয়া খানকে আমরা ওই রূপেই দেখেছি। সামরিক জান্তার হাতে বন্দী অবস্থায় সু চি নিঃসঙ্গ ছিলেন, এখন আর তা নন; এখন তিনি মুক্ত এবং সারা বিশ্বে যত পুঁজিবাদী-ফ্যাসিবাদী শাসক আছেন, সবাই তাঁর সঙ্গী। পুঁজিবাদ এখন রূপ নিয়েছে সংকোচহীন ফ্যাসিবাদের। বিশ্বজুড়ে ফ্যাসিবাদী সুবিধাভোগীরা সুবিধাবঞ্চিতদের ওপর যতভাবে পারা যায় নিপীড়ন করছে। মিয়ানমারেও ওই একই ঘটনা, পোশাকটাই যা আলাদা।

নিপীড়নকারী সরকার বলছে, রোহিঙ্গারা দুষ্কৃতকারী। একাত্তর সালে পাঞ্জাবি হানাদারদের চোখে বাংলাদেশের সব মানুষই ছিল প্রকাশ্য অথবা ছদ্মবেশী দুষ্কৃতকারী। মুষ্টিমেয় লোক ছিল তাদের সহযোগী; তাদেরও তারা সম্ভাব্য দুষ্কৃতকারী বলেই জানত, মুখে যা-ই বলুক না কেন। ‘দুষ্কৃতকারী’দের দমনকাজ একাত্তরে ভীষণভাবে চলেছে। সেটা ছিল গণহত্যা। মিয়ানমার সরকার এখন যা করছে, সেটাও গণহত্যাই। প্রাণভয়ে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল এক কোটি। শরণার্থীদের এই বিপুল বোঝা বহন করা ভারতের পক্ষে মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। তাদের কষ্ট হয়েছে। কিন্তু বিপন্ন মানুষদের তারা আশ্রয় দিয়েছে, খাবার দিয়েছে, যত্ন নিয়েছে। তারা জানত যে শরণার্থীরা শখ করে আসেনি, প্রাণভয়ে পালিয়ে এসেছে। ভারত সরকারের চেষ্টা ছিল, বাংলাদেশিরা যাতে নিরাপদে ও সম্মানের সঙ্গে দেশে ফিরে যেতে পারে, সেটা দেখা। সে জন্য তারা কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছে, বিশ্ববাসীকে সমস্যাটা কী তা জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি সংগ্রহ করেছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তাদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়েছে। আশা করেছে শরণার্থীরা শিগগিরই ফিরে যেতে পারবে। ঘটেছেও সেটাই। নয় মাসেই সমস্যার সমাধান পাওয়া গেছে।

সেদিন বিপন্ন বাংলাদেশিদের সংখ্যা ছিল অনেক। কিন্তু তবু পুঁজিবাদী বিশ্বের সরকারগুলো সাড়া দেয়নি। সেসব দেশের মানুষ ছিল বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে। থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্বের মানুষ নির্যাতনের সবটা খবর পায়নি, যেটুকু পেয়েছে, তা-ও খণ্ডিত। মিডিয়ার পক্ষে যথোপযুক্তরূপে সাড়া দেওয়া সম্ভব হয়নি। মিডিয়া ছিল পুঁজিবাদীদের নিয়ন্ত্রণে এবং পুঁজিবাদীদের ছিল একই রা; সেটি হলো দুষ্কৃতকারীরা রাষ্ট্রের অখণ্ডতা নষ্ট করতে তৎপর হয়েছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করাটা দরকার। মিডিয়ার কর্মীরা ছিলেন সহানুভূতিশীল; নির্যাতনের খবর যতটুকু সম্ভব তাঁরাই বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন।

রোহিঙ্গাদের দুর্ভাগ্য একাধিক। সংখ্যায় তারা অধিক নয়; তারা খুবই দরিদ্র এবং বিশ্বের অবহেলিত একটি প্রান্তে তাদের বসবাস। বিশ্ব তাদের খবর রাখে না, বিশ্ব তাদের গুরুত্ব দেয় না। তাদের পক্ষে বলবে এমন মানুষের ভীষণ অভাব। তদুপরি যে সরকার তাদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে, সেটি গণতান্ত্রিক বলে পরিচিত। গণতান্ত্রিক কেবল এই অর্থে যে এটি ক্ষমতায় এসেছে নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচিত মানেই যে গণতান্ত্রিক নয়, এটি বহুবার বহু ক্ষেত্রে প্রমাণিত হয়েছে, প্রমাণিত হচ্ছে মিয়ানমারেও। ওদিকে বাংলাদেশিদের পাশে তবু ভারত ছিল, রোহিঙ্গাদের পাশে প্রতিবেশী বাংলাদেশও নেই। এমনই তাদের দুর্ভাগ্য।

রোহিঙ্গাদের দুর্দশা পরিসংখ্যানের হিসাবে পরিণত হয়েছে। কতজন এল, কতজন রয়েছে নো ম্যানস ল্যান্ডে, কত লাশ দেখা গেছে নাফ নদীতে ভাসতে—এসব খবর তা–ও পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু ভেতরে কী ঘটছে, তা জানার উপায় নেই। সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে, তাদের উৎসাহও সীমিত, তদুপরি তাদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না পরিদর্শনের। সিরিয়া, লেবানন, ইরাক থেকে হাজার হাজার শরণার্থী যাচ্ছে ইউরোপে, কোথাও পথ খোলা, কোথাও বন্ধ; পানিতে ডুবে ও রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে বহু মানুষ। তাদের মানবিক দুর্দশার খবরটা তবু জানছে বিশ্ববাসী, কিন্তু রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে কী ঘটছে, তা জানানোর উন্মুক্ত উপায় নেই। সিরিয়ার শরণার্থী পরিবারের একটি শিশু অমানবিক বিপদের মধ্যে মুখ থুবড়ে মৃত অবস্থায় পড়ে ছিল সমুদ্রের ধারে; তার ছবি সারা বিশ্ব দেখেছে। শিউরে উঠেছে, ধিক্কার দিয়েছে শিশু হত্যাকারীদের। এমন বর্বরতা রোহিঙ্গাদের একটি-দুটি নয়, বহু শিশুর ভাগ্যে ঘটেছে; কিন্তু তাদের খবর বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছায়নি, পৌঁছালেও তারা প্রাণবন্ত শিশু থাকে না, প্রাণহীন সংখ্যায় পরিণত হয়।

২. উৎপাটিত রোহিঙ্গারা স্রোতের মতো চলে আসছে বাংলাদেশের সীমান্তে। আগেও এসেছে, শত শত; এখন আসছে হাজার হাজার। বাংলাদেশের পক্ষে এত শরণার্থীকে জায়গা দেওয়া কঠিন কাজ। বাংলাদেশ তাহলে কী করবে? নিস্পৃহভাবে যে দেখবে সে উপায় নেই। এই স্রোতকে প্রতিহত করার, আর্ত মানুষকে সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা বাংলাদেশ করছে, কিন্তু সক্ষম হচ্ছে না। হবেও না। বাংলাদেশের পক্ষে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দিয়ে উপায় নেই। প্রথম কারণ, কাজটা হবে অমানবিক; দ্বিতীয় কারণ, কাজটা অসম্ভব।

মানুষ কেন শরণার্থী হয়, বাংলাদেশের মানুষ সেটা জানে। একাত্তরের কথা তাদের পক্ষে কোনো দিনই এবং কোনোভাবেই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। লাখ লাখ বাঙালি যে সেদিন শরণার্থী হয়েছিল, তা কাজের খোঁজে বা সুবিধার লোভে নয়, প্রাণের ভয়ে। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই ঘটেছে। গণহত্যার মুখোমুখি হয়ে তারা বিষয়-সম্পত্তি, ঘরবাড়ি, সহায়-সম্বল, এমনকি আপনজনকেও ফেলে রেখে প্রাণ বাঁচাতেই পালিয়ে আসছে। তারা মারা পড়ছে, হারিয়ে যাচ্ছে, দগ্ধ হচ্ছে। মৃতের লাশ, আহত মানুষ, বিপন্ন শিশু ও বৃদ্ধকে মাথায় করে, কোলে করে নিয়ে তারা ছুটছে আশ্রয়ের সন্ধানে, নৌকা ডুবে যাওয়ায় অনেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। তাদের আশ্রয় না দিলে তারা যাবে কোথায়? আমরা আজ যদি বিপন্ন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দিই, তাহলে কেবল নিজেদের ইতিহাস থেকেই নয়, অন্তর্গত মনুষ্যত্ব থেকেও বিচ্যুত হব।

কিন্তু আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারটা তো সাময়িক। দেখতে হবে গণহত্যা যাতে থামে এবং শরণার্থীরা যাতে নিরাপদে ও সসম্মানে নিজেদের দেশে ফিরে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এর জন্য প্রথম ও প্রধান কাজ ঘটনার বাস্তবতা ও ভয়াবহতা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা। বিষয়টিকে জাতিসংঘ ও নিরাপত্তা পরিষদের কাছে নিয়ে যাওয়া চাই। ঘটনা যে মোটেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয়, সুপরিকল্পিত গণহত্যা, সেটা বুঝিয়ে দিতে হবে। কথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্বুদ্ধ করা চাই, তারা যাতে মিয়ানমারের স্বৈরাচার সরকারের ওপর সব ধরনের চাপ প্রয়োগ করে গণহত্যা থামিয়ে শরণার্থীদের ফেরত নিয়ে যেতে বাধ্য করতে পারে। শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলা করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সব সাহায্য ও পুনর্বাসন সংস্থার কাছ থেকে বস্তুগত সহায়তা চাওয়াটাও যে আশু ও জরুরি কর্তব্যের মধ্যেই পড়বে, সেটা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না।

মূল দায়িত্ব সরকারেরই। কিন্তু সরকারকে উদ্বুদ্ধ করা চাই, যাতে তার আলস্য ভাঙে, সরকার যাতে কালবিলম্ব না করে তার কর্তব্যে ব্রতী হয়। কারা করবেন এ কাজ? নিশ্চয়ই তাঁরা করবেন না, যাঁরা মনে করেন যে রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য একটা উটকো ঝামেলা, অথচ বলতে পারবেন না আমাদের পক্ষে করণীয়টা কী। বড়জোর বলবেন, সীমান্ত প্রহরা আরও জোরদার করতে হবে, ঠেলা-ধাক্কাটা আরও শক্ত হাতে দেওয়া চাই। কিন্তু তাতে তো সমস্যার কোনো সমাধান নেই। প্রাণভয়ে পালানো এসব মানুষ বন্যার স্রোতের মতোই প্রবল, বাঁধের ওপর তারা তো আছড়ে পড়বেই; আর বাঁধটা তো শেষ পর্যন্ত মানবিকই, যতই সে নিশ্ছিদ্র হওয়ার চেষ্টা করুক না কেন। ‘অনুপ্রবেশ’ বলি আর যা-ই বলি, ঘটনা ঘটবেই, এখন যেমন ঘটেছে। শক্ত হৃদয় ওই দলের একাংশ বলবে যে রোহিঙ্গারা নিচু সংস্কৃতির মানুষ, তারা এসে মাদক ব্যবসা করবে, জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত হবে, চুরি-ডাকাতি বাদ রাখবে না, এমনকি ভোটার সেজে রাজনীতিতে পর্যন্ত ঢুকে পড়বে।

এরা ভুলে যায় যে বিপন্ন রোহিঙ্গারা ওই সব কাজ করার জন্য শরণার্থী হয়নি। শরণার্থী হয়েছে বর্ণবাদী সরকারের বন্দুকের মুখে। রোহিঙ্গারা অপরাধ করার জন্য বাংলাদেশে পাড়ি জমায়নি, তাদের স্থানীয় মুনাফালোভীরা নিজেদের স্বার্থে অপরাধে জড়িত করছে। শরণার্থীদের জন্য কাজ নেই, উপার্জনের উপায় নেই, তাই তারা শিকার হচ্ছে মুনাফালোভীদের চক্রান্তে। প্রকৃত অপরাধী হচ্ছে মিয়ানমারের সরকার, যারা এই গণহত্যায় লিপ্ত। পাকিস্তানের বর্তমান শাসকেরা যেভাবে তাদের রাষ্ট্রকে হিন্দুশূন্য করার কাজটা সম্পন্ন করে এখন খ্রিষ্টানশূন্য করার কাজে নেমেছে। মিয়ানমার সরকারও হয়তো তার চেয়েও দ্রুত ও প্রকাশ্য পদ্ধতিতে তাদের রাষ্ট্রকে রোহিঙ্গাশূন্য করার ব্রত নিয়েছে। এ কাজে তারা বিলক্ষণ সফল হবে, যদি না তাদের নিবৃত্ত করা যায়।

বাংলাদেশ সরকারকে তাদের কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্বটা তাই নিতে হবে দেশের বিবেকবান মানুষকেই। অর্থাৎ তেমন মানুষদের, যাঁরা পুঁজিবাদকে চেনেন এবং জানেন যে বিশ্বের অন্যত্র যেমন, মিয়ানমারেও তেমনি শরণার্থী সমস্যাটা মুনাফালোভী ও মনুষ্যত্ববিরোধী পুঁজিবাদীরাই তৈরি করে। তাঁরা জানেন যে ১৯৭১-এর পাকিস্তানি হানাদার ও ২০১৭-এর মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগকর্তাদের ভেতরে নামেই যা পার্থক্য, ভেতরে তারা একই। এ-ও তাদের জানা আছে যে জলবায়ু পরিবর্তনে ধরিত্রী যে এখন বিপন্ন, তার কারণ পুঁজিবাদী বিশ্বের উন্নয়ন তৎপরতা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। পুঁজিবাদবিরোধী মানুষের এখন অনেক কর্তব্য; মূল কর্তব্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাকে ভেঙে সামাজিক মালিকানার ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করা। মিয়ানমারের অসহায় মানুষের পক্ষে দাঁড়ানোটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই দাঁড়ানো বটে। এক কথায় এ দায়িত্ব বামপন্থীদেরই, সারা বিশ্বে এবং বাংলাদেশে।