হাওর বার্তা ডেস্কঃ গোটা আগস্ট মাসই বাংলাদেশ ও বাঙালির জন্য জাতীয় শোকের মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এর ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্য দিবালোকে তাঁর দলের অসংখ্য নেতাকর্মীসহ হত্যার জন্য ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ১৯৭৫ সালের ঘাতকদের হত্যাচেষ্টা সফল হয়েছিল। ২০০৪ সালের আগস্ট মাসের হত্যাচেষ্টা সফল হয়নি। আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ তাতে নিহত-আহত হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা আহত হয়েও বেঁচে গেছেন।
যদি তাঁরা বাঁচতে না পারতেন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক দুর্ভাগ্যজনক পটপরিবর্তন ঘটত; যে পটপরিবর্তন ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের মতো এক দীর্ঘস্থায়ী সর্বনাশ ডেকে আনত দেশটির জন্য। ২০০৪ সালের গ্রেনেড-হত্যা ষড়যন্ত্র যদি সফল হতো, তাহলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থার কবরের ওপর যে মধ্যযুগীয় শাসনব্যবস্থা আসন গেড়ে বসত, তা গণতন্ত্র ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য় পরিণত হতো। এখন সুধীসমাজ দেশে মানবাধিকার ও বাক্স্বাধীনতা নেই বলে চিৎকার করছে, সেই চিৎকার করার সুযোগও তাদের থাকত না। বিচারপতিরা দেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই বলে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছেন, তা বলার স্বাধীন পরিবেশও তাঁদের থাকত না।
আসলে দেশে যদি গণতন্ত্র থাকে, সার্বভৌম পার্লামেন্ট থাকে, নিদেনপক্ষে দেশে শক্তিশালী গণ-আন্দোলন থাকে, তাহলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা পায়। শুধু আইন করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষা করা যায় না। তখন ‘কাজির গরু কেতাবে থাকে, গোয়ালে থাকে না। ’ পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে আমরা কী দেখেছি? পাকিস্তানের ফৌজি সরকার তাদের জল্লাদ জেনারেল নামে পরিচিত জেনারেল টিক্কা খানকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করে ঢাকায় পাঠিয়েছিল, প্রবল গণ-আন্দোলনের জোয়ার তখন বাংলাদেশে। সেই আন্দোলনের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী টিক্কা খানকে গভর্নর হিসেবে শপথ পড়াতে অস্বীকৃতি জানান। আবার ২৫ মার্চ রাতে ভয়াবহ গণহত্যা শুরু হওয়ার পর যখন গণ-আন্দোলন সাময়িকভাবে স্তিমিত তখন তিনি কোনো প্রকার আপত্তি না করে টিক্কা খানকে গভর্নর হিসেবে শপথ পাঠ করিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই এ ইতিহাস সবার জানা আছে।
১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের হত্যা ষড়যন্ত্র সফল হয়েছে। এর ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে একই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যা ষড়যন্ত্রটি সফল হয়নি। তাতে দেশে হিংস্র মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার অভ্যুত্থান রোখা গেছে। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের হত্যাকারীদের বেশির ভাগকে শাস্তি দেওয়া গেছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দেওয়া গেছে। আওয়ামী লীগের শাসনে সব দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের উচ্ছেদ না ঘটলেও, দেশ অপশাসন থেকে রাতারাতি মুক্ত না হলেও অন্তত গণতন্ত্রে ও অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী একটি দল এখনো ক্ষমতায় রয়েছে। জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু স্বমর্যাদায় অধিষ্ঠিত এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেছে।
বাংলাদেশের এইটুকু উন্নতিও একাত্তরের পরাজিত ও পঁচাত্তরের হত্যার সহযোগী শক্তির সহ্য হয়নি। তারা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই চক্রান্ত শুরু করেছে এবং এখন দলে ভারী হয়েছে। কিন্তু চক্রান্ত করে সফল হতে পারছে না। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের বর্বর হত্যাভিযান সফল হয়নি। এর ১৩ বছর পর দেশের নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে একটি অবাঞ্ছিত ও অপ্রয়োজনীয় বিরোধ সৃষ্টি করে দেশে রাজনৈতিক সংকট ডেকে এনে নির্বাচনের আগেই এ সরকারকে অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা থেকে সরানো এবারের আগস্ট ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য। হত্যার রাজনীতি দ্বারা বঙ্গবন্ধুর সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটানো গেছে। তাঁর কন্যাকে বারবার হত্যাচেষ্টা দ্বারা বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে উচ্ছেদ করতে না পারায় এখন এ সরকারের প্রতিপক্ষ ও শত্রুপক্ষ দুই পক্ষেরই এই মহামিলন। উদ্দেশ্য সাধনে এই নতুন ‘কাশিমবাজার কুঠি’র গোপন ঘাঁটি এখন ঢাকায়। শাখা ঘাঁটি লন্ডনে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার এক মূল হোতা এখন লন্ডনেই রাজকীয় শান-শওকতে বসবাস করছে।
এই চক্রান্তকারী শিবিরের নেতাদের নামোল্লেখের দরকার নেই। ২০০১ সালে যে চক্রগুলো তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের স্বনিযুক্ত ‘কনসান্স কিপার’ সেজে তাঁকে ঘিরে ফেলে তাঁর সরল বুদ্ধির সুযোগ নিয়ে দেশে অঘটন ঘটিয়েছিল, সেই চক্রগুলোই এখন আরেকটি সাধারণ নির্বাচন সামনে নিয়ে নতুন করে ঘোঁট পাকিয়েছে এবং বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ‘কনসান্স কিপার’ সাজার সুযোগ গ্রহণ করতে চাইছে। পেরেছে কি না আমার জানা নেই। আমাদের বর্তমান প্রধান বিচারপতিও একজন প্রাজ্ঞ বিচারক; কিন্তু সরল মনের মানুষ।
পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনা বাংলাদেশের গণবিরোধী শক্তিগুলোকে উৎসাহিত করেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু পাকিস্তানের ও বাংলাদেশের ঘটনা এক নয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ নানা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারে দণ্ডিত হয়ে পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু তাঁর দলই ক্ষমতায় রয়ে গেছে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির মামলায় আদালতের বিচারে দোষী সাব্যস্ত হননি এবং তাঁর পদত্যাগ করার কোনো কারণও নেই।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ঘটিয়েছিল পার্লামেন্ট। হাইকোর্ট তা বাতিল করেন এবং আপিল আদালত তা বহাল রাখেন। সর্বোচ্চ আদালতের এ রায় সরকার মেনে নিয়েছে। সরকার চাইলে এ রায়ের রিভিউর আবেদন আদালতেই জানাতে পারে। এখানেই বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। এ রায়ের সঙ্গে প্রধান বিচারপতি কিছু পর্যবেক্ষণ (ড়নংবৎাধঃরড়হ) জুড়ে দিয়েছেন, যা বিতর্কমূলক। এ সম্পর্কে সরকার ও প্রধান বিচারপতির মধ্যে আলোচনাক্রমেই বিষয়টির সুরাহা হয়ে যেতে পারে। তিনি যে একদিকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা ও অন্যদিকে জাতির পিতার মর্যাদা রক্ষায় আগ্রহী, তা ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত দীর্ঘ রায়টি পড়লেও বোঝা যায়।
কিন্তু ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি’। হাসিনার নেতৃত্ব ও আওয়ামী লীগের দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা যাদের কাছে অসহ্য; কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কোনো কিছু করতে না পেরে হতাশায় ভুগছে, তারা প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণগুলো পড়ে আবার অন্ধকারে আলো দেখছে। এই পর্যবেক্ষণগুলোকে ইস্যু বানিয়ে আবার দেশে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে ২০০১ সালের মতো ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়। প্রধান বিচারপতির এ পর্যবেক্ষণগুলো আদালতের রায় (যা রায়ের মোটেই অন্তর্ভুক্ত নয়) হিসেবে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরে বিএনপি-জামায়াত জোট আবার আন্দোলনের নামে ষড়যন্ত্রের ঘোঁট পাকাতে চায়।
অন্যদিকে ড. কামাল হোসেনের মতো বর্ষীয়ান আইনজীবী, যাঁর উচিত ছিল সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে এই বিবাদ যাতে জাতীয় সংকট ডেকে না আনে সে জন্য মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেওয়া, তিনিও অন্ধ হাসিনাবিদ্বেষ দ্বারা তাড়িত হয়ে হঠাৎ পর্যবেক্ষণগুলোর সাফাই সাক্ষী হওয়ার ভূমিকায় নেমেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর একটি উক্তিকে অসংলগ্নভাবে উদ্ধৃত করে অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে সাফাই সাক্ষী হওয়ার চেষ্টা করেছেন। এদিক থেকে তথাকথিত সুধীসমাজের ভূমিকাটিও খুব স্বচ্ছ ও সৎ নয়। সাম্প্রতিককালে প্রতিটি জাতীয় সংকটে দেখা গেছে, তাদের সুবিধাবাদী নীতি দেশের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির চক্রান্তে শক্তি জুগিয়েছে।
২০০৪ সালের আগস্টের গ্রেনেড হামলাটি ছিল একটি রক্তাক্ত চক্রান্ত। ২০১৭ সালের আগস্টের চক্রান্তটি রক্তপাতহীন চক্রান্ত। তবে উদ্দেশ্য একই। হাসিনা-নেতৃত্ব ও আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা। পরিণামে দেশের নাজুক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করা। আমিও তাতে শঙ্কিত। আমার কয়েকটি লেখাতেই আমি শঙ্কা প্রকাশ করেছি, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের এই বিরোধে উসকানি দিয়ে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের চক্রান্তের লক্ষ্য ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে অর্থাৎ ১৩ বছর পর সফল করার চেষ্টা চালানো হতে পারে। তারা সে চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সফল হবে কি? বাংলাদেশের ভাগ্যে আবার অন্ধকার কালো নিশা দীর্ঘকালের জন্য নেমে আসবে কি?
অতীত ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে ভাবছি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমরা যে একটি রক্তাক্ত প্রতিবিপ্লব প্রতিহত করতে পারিনি, তার মূল কারণ ছিল এ সম্পর্কে সরকার ও জনগণের অসতর্কতা এবং শত্রুপক্ষের শক্তি সম্পর্কে অসচেতনতা। সদ্য গঠিত বাকশালও এ সময় ছিল অসংগঠিত। ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলাসহ হাসিনাকে হত্যা করার অসংখ্য ছোট-বড় চক্রান্ত যে সফল হয়নি তার কারণ, এ সময় আওয়ামী লীগ একটি সংগঠিত দল এবং দেশবাসীও সচেতন। আমার ধারণা, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে দেশের মানুষ এখন আরো সচেতন।
দেশের মানুষ যদি সচেতন থাকে এবং আওয়ামী লীগ তার সংগঠনশক্তি ধরে রাখতে পারে, আওয়ামী লীগের এক শ্রেণির নেতা ও মন্ত্রী অনবরত দায়িত্বহীন ও উসকানিমূলক কথাবার্তা বলতে না থাকেন, তাহলে প্রধান বিচারপতির কিছু পর্যবেক্ষণকে কেন্দ্র করে যারা পানি ঘোলা করার চেষ্টা করছে, তাদের চেষ্টা সফল হবে না। প্রধান বিচারপতিও তাঁর ধৈর্য, বিচারবুদ্ধি ও দেশপ্রেম দ্বারা এই চক্রান্তরোধে এগিয়ে আসবেন এবং সক্ষম হবেন—এই আশা রাখি।
যারা এ সংকটকে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনার সঙ্গে তুলনা করে উৎসাহিত হচ্ছে, আমি তাদের তুরস্কের সাম্প্রতিক ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণের অনুরোধ জানাই। মেঘ গর্জাতে পারে; কিন্তু সব সময় বজ্রপাত ঘটাতে পারে কি? কালের কণ্ঠ