ঢাকা ০৭:৩৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

৩২ নম্বরে অবিরল অশ্রুধারা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:৩০:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ অগাস্ট ২০১৫
  • ৩৭৮ বার

১৫ আগস্ট ১৯৭৫, মধ্যরাত পেরিয়ে ভোর এগিয়ে আসছে পায়ে পায়ে। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ি অভিমুখে রওনা দিয়েছে কয়েকটি ট্যাংক। তিন তলা সেই বাড়ির বাসিন্দারা তখন সবাই নিশ্চিত ঘুমে নিদ্রামগ্ন।

ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে সপরিবারে থাকেন সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ নামের দেশটির স্বপ্নদ্রষ্টা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পশ্চিম পাকিস্তানের কব্জা থেকে মুক্তি লাভ করতে যে স্বপ্নের বীজ বুনতে হয়ছে, সেই স্বপ্নের বীজ এই বাড়ি থেকে অংকুরিত হয়ে ছড়িয়ে গেছে পুরো বাংলাদেশে।

‘বত্রিশ নম্বর’ শিরোনামের কবিতায় লিখেছেন_’বত্রিশ নম্বর ঘিরে দীর্ঘকায় ঋজু উন্নতশির মানুষটির/ কম্বুকণ্ঠী নিনাদে প্রকম্পিত আসমুদ্রহিমাচল_/ এরিনমোর তামাকের গন্ধে ম ম/ বত্রিশ নম্ব্বর সড়কের সেই বাড়িটির আনাচ কানাচ…’। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান মানুষটির সুঠাম দেহ, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব আর শতভাগ বাঙালিয়ানা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। দেশ আর পরিবার নিয়েই তার জীবন। সেই জীবন চিরতরে থমকে গেছে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের প্রিয় বাড়িতে।

দোতলার নিজ বাড়ির বাইরের বারান্দাটি ছিল স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছার খুব প্রিয়। যুদ্ধ আর সংগ্রামের ভেতর দিয়েও তিনি একটু একটু করে সাজিয়েছেন নিজ হাতে প্রিয় সংসার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানও
তাই রাষ্ট্রীয় বাসভবনে যেতে চাননি এই বাড়ি ছেড়ে। স্ত্রী-কন্যা-পুত্র আর পুত্রবধূদের নিয়ে তিনি একই ছাদের নিচে খুব সাধারণভাবেই জীবনযাপন করতে ভালোবাসতেন।
ঘাতকের নির্মোহ বুলেট যখন ঝাঁঝরা করে দিচ্ছিল দেয়াল, সাহসী পুরুষ বঙ্গবন্ধু তখনও বিশ্বাস করতে পারেননি তার বাড়িতে কেউ হামলা করতে আসবে; পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গে তার প্রাণও কেড়ে নেবে নিজের দেশের মানুষ! গুলির আঘাতে সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত তিনি সেনাবাহিনীর ঘাতক জোয়ানদের বোঝাতে চেয়েছেন; সামনে থেকে বাঁচাতে চেয়েছেন পরিবারের সদস্যদের।

বর্তমানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অন্তর্ভুক্ত তৎকালীন বাসভবনটি এখন শুধুই স্মৃতি আর কষ্টের এক জাদুঘর। এখনও সেখানে কান পাতলে শুনতে পাওয়া যায় হাসি-আনন্দমুখর মানুষদের পায়ের আওয়াজ। তাদের ব্যবহৃত জিনিস আর কক্ষগুলোর বাইরে আসুরিক থাবায় থমকে যাওয়া জীবনের দুঃখ- কোলাহল এখন তাড়িয়ে বেড়ায় জাদুঘর দেখতে আসা মানুষদের।

তিন তলা বাড়ির নিচতলায় ছিল বসার ঘর, স্টাডি রুম। বঙ্গবন্ধু নেতাকর্মীদের সময় দিতেন যে কক্ষটিতে সেখানে প্রায় আগের মতোই রাখা আছে সব। তাঁর ছবি, চেয়ার-টেবিল, নৌকার প্রতীক, বুক শেলফবন্দি বই, উপহারের কোরআন শরীফসহ যাবতীয় জিনিস। বাইরের বসার ঘরের সোফাগুলোও সাজানো আছে আগের মতো। দেয়ালে বুলেটের আঘাতে পলেস্তারা খসে গেছে। সেগুলো কাচ দিয়ে বাঁধাই করে রাখা। বাইরের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ঢুকতেই চোখে পড়বে বঙ্গবন্ধুর আদরের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের অ্যাকুয়ারিয়াম। অ্যাকুয়ারিয়ামটিতে এখন নেই কোনো প্রাণের ছোঁয়া। ভেতরে গেলে দেখা যাবে সাজানো আছে পরিবারের খাবার টেবিলটি। গ্গ্নাস, প্লেট, চামচ সাজিয়ে রাখা_ এখানেই বঙ্গবন্ধু আহার করতেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। পাশেই কয়েকটি সোফা, একটা টেলিভিশন। টেলিভিশনের উপর শেখ রাসেলের গ্গ্নোব। এখানেও দেয়াল আর মেঝেতে রয়েছে গুলির দাগ। খাবার ঘরের পাশেই বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষ। দেয়ালে ঝোলানো আছে সেই বছরের ক্যালেন্ডারটি। ১৯৭৫ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের ক্যালেন্ডারের পাতাটি আছে আগের মতো। কাচ-ঘেরা রুমটির ভেতর সাজানো আছে একটা রেডিও, তিন রঙের তিনটি টেলিফোন, দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর ছবি, বেতের তৈরি কয়েকটি মোড়া, খাটের উপর রাখা কোলবালিশ এবং একটি হাতপাখা। আছে বঙ্গবন্ধুর সার্বক্ষণিক সঙ্গী প্রিয় পাইপগুলো। আরও আছে শেখ ফজিলাতুন্নেছার পানের বাটাটি। দেয়াল আর মেঝেতে গুলির দাগ, রক্ত শুকিয়ে গেছে। এই ঘরেই হত্যা করা হয় বেগম মুজিব, শেখ জামাল, তার স্ত্রী রোজি জামাল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল এবং ছোট্ট শেখ রাসেলকে। এই রুমের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে সেই অভিশপ্ত সিঁড়ির দেখা পাওয়া যায়। যেখানে সেই কাল রাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টার রক্তভেজা নিথর দেহ পড়ে ছিল। ঘাতকের ব্রাশফায়ারে তার শরীরে ছিল আঠারোটি গুলির দাগ। সিঁড়ির মেঝে আর দেয়ালজুড়ে বুলেটের ক্ষত।

কাচ দিয়ে ঘেরা সিঁড়ির সেই স্থান বিমর্ষ করে তুলবে যে কাউকে। সিঁড়ির দরজার পাশ দিয়ে সামনে এগোলে শেখ জামালের কক্ষ। শেখ জামাল আর রোজি জামালের বিয়ের সময়কার ছবি, তার সামরিক পোশাক, আলনায় ঝোলানো রোজি জামালের শাড়ি, তাদের ব্যবহৃত খাট, ক্রিকেট ব্যাট, পড়ার টেবিল, শেলফের বই আর শেলফের উপর বেশ কয়েকটি পুতুল সাজানো কক্ষজুড়ে। বাথরুম আর সিলিংয়ে গুলির দাগ সেই রাতের ভয়াবহতার কথাই মনে করিয়ে দেয়।
তিন তলার অর্ধেক ছাদ আর তিন কক্ষের একটিতে থাকতেন শেখ কামাল। তিনি ভালোবাসতেন সঙ্গীত। তার সেতার আর অর্গানটি এখন শুধুই স্মৃতির উপাদান। দেয়ালজুড়ে শেখ কামাল আর তার স্ত্রী সুলতানা কামালের বিয়ের বড় ছবি, সাজানো আছে নানা শোপিস, বই। খাটের ডান পাশে আছে তাদের গ্গ্নাস-প্লেট। সংস্কৃতিপ্রেমী শেখ কামাল স্পন্দন নামে একটি শিল্পীগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার গান শোনার যন্ত্র ও বাদ্যযন্ত্রে আর কোনোদিন বাজবে না সুর_ এ কথা নিচতলায় ঘাতকের বুলেটে প্রাণ হারানোর আগ পর্যন্ত তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি।

ছাদের অন্য দুই কক্ষের একটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বসার ঘর। দেশ-বিদেশের নেতাকর্মীদের সঙ্গে একান্তে আলাপ করতেন এই কক্ষে। পাশেই পরিবারের সবার পড়ার ঘর। পরীক্ষার আগে সবাই এখানে বসে পড়তেন। এখানেই একটা শেলফে থাকত শেখ রাসেলের খেলার সরঞ্জাম।

শোকের আবহে মোড়ানো ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে আগের মতোই সাজানো আছে সব। নিচের রান্নাঘর, বঙ্গবন্ধুর প্রিয় কবুতর ঘর_ সবই আছে আগের মতো। পুরনো ভবনের পেছনে গড়ে উঠেছে বর্তমানে বহু তলবিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের নতুন ভবন। বঙ্গবন্ধুর জীবনের উল্লেখযোগ্য নানা ঘটনা, ছবি আর তথ্যে ভরা জাদুঘরটি হতে পারে সবার জন্য স্মৃতি, শোক আর শক্তির উৎসস্থল।
বঙ্গবন্ধুকন্যা ও বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান দেশের বাইরে ছিলেন বলে। পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু আর ভয়ার্ত শেখ রাসেলের হাসু আপার কাছে যাওয়ার আব্দার এখনও সেখানে দেয়ালে দেয়ালে বাতাসের শরীরে ঘুরে বেড়ায়। ৩২ নম্বরের সেই বাড়ি অবিরল অশ্রুধারা বর্ষণ করে চলেছে গত ৪০ বছরজুড়ে। জাতির এই গভীর ক্রন্দন, অবিরল অশ্রুধারা ঝরে পড়বে অনাদিকাল। বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া স্মৃতির বেদি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খোলা থাকবে প্রত্যেকটি আগামীকাল পর্যন্ত।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

৩২ নম্বরে অবিরল অশ্রুধারা

আপডেট টাইম : ১০:৩০:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ অগাস্ট ২০১৫

১৫ আগস্ট ১৯৭৫, মধ্যরাত পেরিয়ে ভোর এগিয়ে আসছে পায়ে পায়ে। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ি অভিমুখে রওনা দিয়েছে কয়েকটি ট্যাংক। তিন তলা সেই বাড়ির বাসিন্দারা তখন সবাই নিশ্চিত ঘুমে নিদ্রামগ্ন।

ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে সপরিবারে থাকেন সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ নামের দেশটির স্বপ্নদ্রষ্টা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পশ্চিম পাকিস্তানের কব্জা থেকে মুক্তি লাভ করতে যে স্বপ্নের বীজ বুনতে হয়ছে, সেই স্বপ্নের বীজ এই বাড়ি থেকে অংকুরিত হয়ে ছড়িয়ে গেছে পুরো বাংলাদেশে।

‘বত্রিশ নম্বর’ শিরোনামের কবিতায় লিখেছেন_’বত্রিশ নম্বর ঘিরে দীর্ঘকায় ঋজু উন্নতশির মানুষটির/ কম্বুকণ্ঠী নিনাদে প্রকম্পিত আসমুদ্রহিমাচল_/ এরিনমোর তামাকের গন্ধে ম ম/ বত্রিশ নম্ব্বর সড়কের সেই বাড়িটির আনাচ কানাচ…’। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান মানুষটির সুঠাম দেহ, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব আর শতভাগ বাঙালিয়ানা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। দেশ আর পরিবার নিয়েই তার জীবন। সেই জীবন চিরতরে থমকে গেছে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের প্রিয় বাড়িতে।

দোতলার নিজ বাড়ির বাইরের বারান্দাটি ছিল স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছার খুব প্রিয়। যুদ্ধ আর সংগ্রামের ভেতর দিয়েও তিনি একটু একটু করে সাজিয়েছেন নিজ হাতে প্রিয় সংসার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানও
তাই রাষ্ট্রীয় বাসভবনে যেতে চাননি এই বাড়ি ছেড়ে। স্ত্রী-কন্যা-পুত্র আর পুত্রবধূদের নিয়ে তিনি একই ছাদের নিচে খুব সাধারণভাবেই জীবনযাপন করতে ভালোবাসতেন।
ঘাতকের নির্মোহ বুলেট যখন ঝাঁঝরা করে দিচ্ছিল দেয়াল, সাহসী পুরুষ বঙ্গবন্ধু তখনও বিশ্বাস করতে পারেননি তার বাড়িতে কেউ হামলা করতে আসবে; পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গে তার প্রাণও কেড়ে নেবে নিজের দেশের মানুষ! গুলির আঘাতে সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত তিনি সেনাবাহিনীর ঘাতক জোয়ানদের বোঝাতে চেয়েছেন; সামনে থেকে বাঁচাতে চেয়েছেন পরিবারের সদস্যদের।

বর্তমানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অন্তর্ভুক্ত তৎকালীন বাসভবনটি এখন শুধুই স্মৃতি আর কষ্টের এক জাদুঘর। এখনও সেখানে কান পাতলে শুনতে পাওয়া যায় হাসি-আনন্দমুখর মানুষদের পায়ের আওয়াজ। তাদের ব্যবহৃত জিনিস আর কক্ষগুলোর বাইরে আসুরিক থাবায় থমকে যাওয়া জীবনের দুঃখ- কোলাহল এখন তাড়িয়ে বেড়ায় জাদুঘর দেখতে আসা মানুষদের।

তিন তলা বাড়ির নিচতলায় ছিল বসার ঘর, স্টাডি রুম। বঙ্গবন্ধু নেতাকর্মীদের সময় দিতেন যে কক্ষটিতে সেখানে প্রায় আগের মতোই রাখা আছে সব। তাঁর ছবি, চেয়ার-টেবিল, নৌকার প্রতীক, বুক শেলফবন্দি বই, উপহারের কোরআন শরীফসহ যাবতীয় জিনিস। বাইরের বসার ঘরের সোফাগুলোও সাজানো আছে আগের মতো। দেয়ালে বুলেটের আঘাতে পলেস্তারা খসে গেছে। সেগুলো কাচ দিয়ে বাঁধাই করে রাখা। বাইরের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ঢুকতেই চোখে পড়বে বঙ্গবন্ধুর আদরের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের অ্যাকুয়ারিয়াম। অ্যাকুয়ারিয়ামটিতে এখন নেই কোনো প্রাণের ছোঁয়া। ভেতরে গেলে দেখা যাবে সাজানো আছে পরিবারের খাবার টেবিলটি। গ্গ্নাস, প্লেট, চামচ সাজিয়ে রাখা_ এখানেই বঙ্গবন্ধু আহার করতেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। পাশেই কয়েকটি সোফা, একটা টেলিভিশন। টেলিভিশনের উপর শেখ রাসেলের গ্গ্নোব। এখানেও দেয়াল আর মেঝেতে রয়েছে গুলির দাগ। খাবার ঘরের পাশেই বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষ। দেয়ালে ঝোলানো আছে সেই বছরের ক্যালেন্ডারটি। ১৯৭৫ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের ক্যালেন্ডারের পাতাটি আছে আগের মতো। কাচ-ঘেরা রুমটির ভেতর সাজানো আছে একটা রেডিও, তিন রঙের তিনটি টেলিফোন, দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর ছবি, বেতের তৈরি কয়েকটি মোড়া, খাটের উপর রাখা কোলবালিশ এবং একটি হাতপাখা। আছে বঙ্গবন্ধুর সার্বক্ষণিক সঙ্গী প্রিয় পাইপগুলো। আরও আছে শেখ ফজিলাতুন্নেছার পানের বাটাটি। দেয়াল আর মেঝেতে গুলির দাগ, রক্ত শুকিয়ে গেছে। এই ঘরেই হত্যা করা হয় বেগম মুজিব, শেখ জামাল, তার স্ত্রী রোজি জামাল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল এবং ছোট্ট শেখ রাসেলকে। এই রুমের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে সেই অভিশপ্ত সিঁড়ির দেখা পাওয়া যায়। যেখানে সেই কাল রাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টার রক্তভেজা নিথর দেহ পড়ে ছিল। ঘাতকের ব্রাশফায়ারে তার শরীরে ছিল আঠারোটি গুলির দাগ। সিঁড়ির মেঝে আর দেয়ালজুড়ে বুলেটের ক্ষত।

কাচ দিয়ে ঘেরা সিঁড়ির সেই স্থান বিমর্ষ করে তুলবে যে কাউকে। সিঁড়ির দরজার পাশ দিয়ে সামনে এগোলে শেখ জামালের কক্ষ। শেখ জামাল আর রোজি জামালের বিয়ের সময়কার ছবি, তার সামরিক পোশাক, আলনায় ঝোলানো রোজি জামালের শাড়ি, তাদের ব্যবহৃত খাট, ক্রিকেট ব্যাট, পড়ার টেবিল, শেলফের বই আর শেলফের উপর বেশ কয়েকটি পুতুল সাজানো কক্ষজুড়ে। বাথরুম আর সিলিংয়ে গুলির দাগ সেই রাতের ভয়াবহতার কথাই মনে করিয়ে দেয়।
তিন তলার অর্ধেক ছাদ আর তিন কক্ষের একটিতে থাকতেন শেখ কামাল। তিনি ভালোবাসতেন সঙ্গীত। তার সেতার আর অর্গানটি এখন শুধুই স্মৃতির উপাদান। দেয়ালজুড়ে শেখ কামাল আর তার স্ত্রী সুলতানা কামালের বিয়ের বড় ছবি, সাজানো আছে নানা শোপিস, বই। খাটের ডান পাশে আছে তাদের গ্গ্নাস-প্লেট। সংস্কৃতিপ্রেমী শেখ কামাল স্পন্দন নামে একটি শিল্পীগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার গান শোনার যন্ত্র ও বাদ্যযন্ত্রে আর কোনোদিন বাজবে না সুর_ এ কথা নিচতলায় ঘাতকের বুলেটে প্রাণ হারানোর আগ পর্যন্ত তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি।

ছাদের অন্য দুই কক্ষের একটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বসার ঘর। দেশ-বিদেশের নেতাকর্মীদের সঙ্গে একান্তে আলাপ করতেন এই কক্ষে। পাশেই পরিবারের সবার পড়ার ঘর। পরীক্ষার আগে সবাই এখানে বসে পড়তেন। এখানেই একটা শেলফে থাকত শেখ রাসেলের খেলার সরঞ্জাম।

শোকের আবহে মোড়ানো ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে আগের মতোই সাজানো আছে সব। নিচের রান্নাঘর, বঙ্গবন্ধুর প্রিয় কবুতর ঘর_ সবই আছে আগের মতো। পুরনো ভবনের পেছনে গড়ে উঠেছে বর্তমানে বহু তলবিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের নতুন ভবন। বঙ্গবন্ধুর জীবনের উল্লেখযোগ্য নানা ঘটনা, ছবি আর তথ্যে ভরা জাদুঘরটি হতে পারে সবার জন্য স্মৃতি, শোক আর শক্তির উৎসস্থল।
বঙ্গবন্ধুকন্যা ও বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান দেশের বাইরে ছিলেন বলে। পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু আর ভয়ার্ত শেখ রাসেলের হাসু আপার কাছে যাওয়ার আব্দার এখনও সেখানে দেয়ালে দেয়ালে বাতাসের শরীরে ঘুরে বেড়ায়। ৩২ নম্বরের সেই বাড়ি অবিরল অশ্রুধারা বর্ষণ করে চলেছে গত ৪০ বছরজুড়ে। জাতির এই গভীর ক্রন্দন, অবিরল অশ্রুধারা ঝরে পড়বে অনাদিকাল। বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া স্মৃতির বেদি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খোলা থাকবে প্রত্যেকটি আগামীকাল পর্যন্ত।